বিশেষ প্রতিবেদন

বন্ধ স্কুল-কলেজ, ক্লাস চলছে শিক্ষকদের কোচিংয়ে

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতির ফের অবনতি ঘটতে থাকায় স্কুল-কলেজে শারীরিক উপস্থিতিতে পাঠদান বন্ধ করা হলেও এর সুযোগ নিচ্ছেন একশ্রেণির শিক্ষক। সংক্রমণ ঠেকাতে যেখানে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সেখানে বাড়িতে বা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিচ্ছেন তারা।

Advertisement

ঢাকাসহ সারাদেশেই এমন কোচিং ক্লাসের চিত্র দেখেছে জাগো নিউজ। এর মধ্যে ঢাকার শীর্ষস্থানীয় স্কুল-কলেজগুলোর আশপাশের অলিগলিতে শিক্ষকদের এমন কোচিং সেন্টারের আধিক্য দেখা গেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, স্কুলের শিক্ষকরা অবৈধভাবে কোচিং সেন্টার গড়ে তুলেছেন। এজন্য তারা ফ্ল্যাট বা বাণিজ্যিক ভবনে রুম ভাড়া নিয়েছেন। ছোট ছোট রুমের মধ্যে গাদাগাদি করে শিক্ষার্থীদের বসিয়ে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যাচ করে পড়াচ্ছেন তারা। রুম ছোট হওয়ায় এক বেঞ্চে বসানো হচ্ছে দু-তিনজন। এতে চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি।

বেইলি রোডে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শাখার পাশে বইঘর গলির শেষ বাড়িতে নটর ডেম কলেজের বিজ্ঞান বিষয়ের এক শিক্ষক নিজের কোচিং সেন্টার গড়ে তুলেছেন। ওই এলাকায় ‘বিপ্লব স্যার’ নামে খ্যাত এই শিক্ষক নিয়মিত সকাল-বিকেল ব্যাচভিত্তিক বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী পড়ান। তবে বর্তমানে স্কুল বন্ধ থাকায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা পড়াচ্ছেন তিনি।

Advertisement

কোচিংয়ে ক্লাস নিচ্ছেন এক শিক্ষক

শনিবার (২৯ জানুয়ারি) দেখা গেছে, ৬৪/এ নম্বর বাড়ির নিচতলায় ছোট একটি রুমে ৩৫ জন শিক্ষার্থীকে পড়ানো হচ্ছে। ছোট ছোট বেঞ্চে দুজন করে শিক্ষার্থী বসানো হয়েছে। কোনো ধরনের স্বাস্থ্যবিধিও মানা হচ্ছে না সেখানে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রুমটি ১২ হাজার টাকা ভাড়ায় নেওয়া হয়েছে। সেখানে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় পড়ানো হয়। প্রতিটি ব্যাচে ৩০-৪০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে, যাদের কাছ থেকে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা করে নেওয়া হয়।

জানতে চাইলে বিপ্লব বলেন, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের অনুরোধে আমি সরাসরি কোচিং ক্লাস নিচ্ছি। এমনিতে নিয়মিত অনলাইনে আমি ক্লাস নিয়ে থাকি। তাদের অনুরোধে কয়েকটি ব্যাচে অফলাইনেও ক্লাস নেওয়া হচ্ছে।

Advertisement

তিনি আরও বলেন, সরকারি নির্দেশনা অমান্য হলেও কিছু করার নেই। অনেক দিন থেকে কোচিং করাই বলে এলাকায় আমার একটি পরিচিতি তৈরি হয়েছে।

ওই বাড়ির বাইরে অপেক্ষমাণ এক নারী অভিভাবকের কাছে জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমার মেয়ে ভিকারুননিসায় নবম শ্রেণিতে পড়ে। গত দুই বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, এখনো বন্ধ। মেয়েটা পিছিয়ে যেন না যায় সে কারণে বিপ্লব স্যারের কোচিংয়ে দিয়েছি। ভিকারুননিসার কয়েকজন স্যারের কোচিংয়েও অন্যান্য বিষয় পড়ছে।

রাস্তাজুড়ে কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন

ওই গলিতেই ভিকারুননিসার ইংলিশ ভার্সনের শিক্ষক তারেক আহমেদ ৬৩/২ নম্বর বাড়ির নিচতলার একটি রুমে কোচিং সেন্টার গড়ে তুলেছেন। সেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ষষ্ঠ থেকে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ব্যাচ করে ইংরেজি পড়ান। প্রতিটি ব্যাচে ২০-৩০ জন করে শিক্ষার্থী রয়েছে। তবে পাশের বাড়িতে সাংবাদিক আসার খবরে ছাত্রছাত্রীদের ছুটি দিয়ে তিনি নিজেও কোচিং থেকে বের হয়ে যান।

এ সময় তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারেক আহমেদ কথা না বলেই চলে যান।

শুধু এ দুই শিক্ষক নন। একই গলিতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অনেক শিক্ষক ওই এলাকায় কোচিং সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। ওই এলাকায় বাইরের অনেক শিক্ষকও কোচিং খুলেছেন। করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় সবারই রমরমা অবস্থা চলছে।

পাশেই সিদ্ধেশ্বরীর ৬৮/১ বাড়ির দ্বিতীয় তলার পাঁচটি রুমে সাব্বির, শাহেদ ও রাকিব নামে তিন ব্যক্তি কোচিং সেন্টার গড়ে তুলেছেন। সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে সেখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলছে ব্যাচভিত্তিক পড়ানো। প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ শিক্ষার্থী পড়ানো হচ্ছে বলে জানা গেছে।

ভেতরে গিয়ে দেখা গেছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের বিজ্ঞানের সব বিষয় পড়ানো হচ্ছে। রুমের মধ্যে ছোট ছোট বেঞ্চে দুজন করে বসিয়ে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে অনলাইন ও অফলাইনে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে সেখানে।

জানতে চাইলে সাব্বির নামের ওই শিক্ষক বলেন, আমরা কোনো স্কুলের শিক্ষক নই। আমাদের জন্য আইন প্রযোজ্য হতে পারে না। সরকারি আইন স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের জন্য হতে পারে। আমরা কেন মানবো? পাশের রুমে থাকা সুফিয়ান নামে আরেক শিক্ষকও একই ধরনের মন্তব্য করেন।

কোচিং স্যারের অপেক্ষায় শিক্ষার্থীরা

রাজধানীর কাকরাইল মোড়ের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী জিয়াম তিন বছর ধরে বইগলির ৬৪ নম্বর বাড়ির নিচতলায় ‘সামি স্যার’র কোচিংয়ে পড়ে। সামি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কোচিং সেন্টার চালান।

ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, নিচতলার ছোট একটি রুমে উইলসের ১৫ জন শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষক আসার অপেক্ষায় কোচিংয়ে বসে রয়েছে। আলাপ হলে জিয়াম বলে, সামি স্যার প্রতি ব্যাচে ২০ থেকে ৩০ জন করে পড়ান। প্রত্যেকের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে সপ্তাহে তিনদিন করে ক্লাস করান।

এই শিক্ষার্থী বলে, বর্তমানে স্কুল বন্ধ থাকায় স্যার আমাদের টেস্ট পরীক্ষা শুরু করেছেন। আজ আমাদের প্রথম দিনের পরীক্ষা দেওয়ার কথা রয়েছে। স্কুল বন্ধ থাকলেও কোচিং নিয়মিত চলছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুননাহার জাগো নিউজকে বলেন, শিক্ষকদের প্রতিদিন স্কুলে আসতে বলা হচ্ছে। তারা আসছেন। তার বাইরে কেউ যদি কোচিং করান তবে আমাদের কিছু করার থাকে না। যারা সরকারি নির্দেশনা অমান্য করবে, তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে দমন করা উচিত।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের চলতি দায়িত্বে থাকা প্রফেসর মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, কোচিং সেন্টার নিয়ে একটি নীতিমালা রয়েছে। সেটি কেউ অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার ওপর জরুরি এ অবস্থায় কোনো সরকারি বা এমপিওভুক্ত শিক্ষক কোচিং করানোর প্রমাণ মিললে দ্রুত সময়ে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে অনেকের নৈতিকতার জায়গাটি নষ্ট হয়ে গেছে। যেখানে এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের সুরক্ষিত রাখতে কাজ করা উচিত, সেখানে তাদের এমন বাণিজ্য মেনে নেওয়া যায় না। এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের মনিটরিং করার নির্দেশনা দেওয়া হবে।

এমএইচএম/এমএইচআর/এইচএ/এমএস