মতামত

যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট ফার্ম: আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি

রাজনীতিতে লবিস্ট ফার্ম এখন নতুন সংযোজন বলা চলে। যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি বিতর্কে জড়িয়েছে। ঘরের বাইরে রাজনীতি না থাকলেও লবিস্ট ফার্ম বিতর্ক দেশের সচেতন মানুষকে অনেক অজানা তথ্য দিচ্ছে। চাঞ্চল্যকর তথ্য সংসদে দিয়েছেন স্বয়ং পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

Advertisement

বিএনপি ও জামায়াত যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৮টি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ দিয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গত ২৬ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে ৩০০ বিধিতে দেওয়া বিবৃতিতে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘বিএনপি ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৪টি এবং ২০১৯ সালে একটি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করে। আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে জামায়াত-বিএনপি তিনটি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করে।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘২০১৪ সালে জামায়াত একটি ফার্ম নিয়োগ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করার জন্য। এজন্য তারা দেড় লাখ ডলার দেয়। বিচার বন্ধে তারা আরেকটি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে প্রভাবিত করার জন্য পিস অ্যান্ড জাস্টিস নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ৩২ হাজার ডলার দিয়ে নিয়োগ করে। বিএনপি ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ২৭ লাখ ডলার, প্রতি বছর প্রতি মাসে রিটেইনার ফি ১ লাখ ২০ হাজার ডলার ব্যয় করেছে।’

‘দুঃখের বিষয় হচ্ছে লবিস্টরা এমন সব বক্তব্য তুলে ধরেছেন, যেগুলো দেশের মানুষ জানলে ধিক্কার দেবে’ যোগ করেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি লবিস্টের মাধ্যমে চিঠি দিয়ে আমেরিকাকে বাংলাদেশে সাহায্য সহায়তা বন্ধ করে দিতে বলেছিল। উন্নয়ন যেন ব্যাহত হয় সেজন্য তারা যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে বলেছে।’

Advertisement

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘মাঠে ময়দানে যারা বিএনপির কর্মী আছেন তারা কেউ চাইবেন না দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাক। তাদের কিছু নেতৃস্থানীয় মানুষ তাদের অগোচরে এমন কাজ করেছেন। বিএনপির সদস্যরাও নিশ্চয় চান না দেশ রসাতলে যাক। তাদের নেতারা কীভাবে এভাবে লেখতে পারেন। শেম অন দেম।’ মোমেন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করা সে দেশের আইনে একটি বৈধ প্রক্রিয়া। ভারত, পাকিস্তান, কাতার সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নে লবিস্ট নিয়োগ দেয়। কিন্তু লবিস্ট নিয়োগের উদ্দেশ্য কী সেটা হলো মুখ্য।’

‘সরকার লবিস্ট নিয়োগ করেনি’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সরকার পিআর ফার্ম নিয়োগ করেছে। একটা হচ্ছে সিনেট, স্টেট ডিপার্টমেন্টে গিয়ে লবি করে, তদবির করে, সরকার সে ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করেনি। সরকার যেটা করেছে অপপ্রচার, মিথ্যা তথ্য যেগুলো ছড়ানো হয় তার বিপরীতে সত্য তথ্যগুলো জানানোর জন্য।'

‘বিজিআর নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ২০১৪-১৫ সালে নিয়োগ দেওয়া হয়। বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা বন্ধের জন্য বিজিআরকে নিয়োগ দেওয়া হয়। দেশের জন্য, দেশের জনগণের জন্য, দেশের মঙ্গলের জন্য এবং বিদেশে দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধের জন্য, অপপ্রচারের বদলে সত্য কথা বলার জন্য বাংলাদেশ সরকার জনগণের মঙ্গলের জন্য যে ধরনের ব্যবস্থা প্রয়োজন সেটা নেবে। তার একটি নমুনা হচ্ছে বিজিআর। তারা অসত্য তথ্য দিচ্ছেন, তখন বিজিআরকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল,’ বলেন তিনি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, ‘বিএনপির কিছু কিছু লোক জাতিসংঘের মহাসচিবকে চিঠি দিয়েছেন বাংলাদেশের সংসদকে অবৈধ ঘোষণা করার জন্য। এ ধরনের কাজ যারা করে তাদের প্রতি ধিক্কার।’ মন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি যে এতগুলো ফার্মে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে এত টাকা ব্যয় করলেন তারা কি তাদের দলের আয় ব্যয়ের হিসাবে দেখিয়েছেন? তাদের সব নেতার সঙ্গে আলোচনা করে কি এই কাজগুলো হয়েছে?’ ‘সরকার ও বিএনপির মধ্যে মতামতের ভিন্নতা থাকতে পারে কিন্তু তাই বলে দেশের অনিষ্ট করা যাবে না,’ যোগ করেন তিনি।

Advertisement

আব্দুল মোমেন বলেন, বিএনপির কিছু কিছু লোক জাতিসংঘের মহাসচিবকে চিঠি দিয়েছেন, বাংলাদেশের সংসদকে অবৈধ ঘোষণা করার জন্য। এ ধরনের কাজ যারা করেন, তাদের প্রতি ধিক্কার। বিএনপি যে এতগুলো ফার্মে, রাষ্ট্রবিরোধী কাজে এত টাকা ব্যয় করলো, তারা কি তাদের দলের আয়-ব্যয়ের হিসাবে দেখিয়েছে? তারা কি তাদের সব নেতার সঙ্গে আলোচনা করে এই কাজগুলো করেছে?

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও তার পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে কোথায় যান, কী করেন, সে খোঁজ নেওয়ার জন্য এফবিআইয়ের প্রতি অ্যাপ্রোচ করেন বিএনপি নেতার ছেলে সিজার। তারা জয়কে অপহরণের ষড়যন্ত্র করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে সিজার ও তার সহযোগীদের সাজা হয়েছে।

আব্দুল মোমেন বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার প্রধানের কাছে প্রায় ১৮টি কমিটির লোকজনকে চিঠি দিয়েছে। চিঠি দিয়ে তারা দেশের সব রকম সাহায্য বন্ধ করতে বলেছেন। তারা এও বলেছেন, বাংলাদেশের কারণে আমেরিকার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। তারা রোহিঙ্গা আশ্রয় দেওয়া নিয়েও অপপ্রচার চালিয়েছে।’

‘বিএনপি বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছে’, এই উত্তাপ যখন দেশজুড়ে তখন ঢাকায় গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে দলটি। সেখানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জ্যেষ্ঠ নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন দাবি করেন, বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করার কথা কখনো চিন্তাই করেনি বিএনপি। তাদের মধ্যে এমন অভিপ্রায় নেই। কিন্তু পরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর করোনামুক্ত হয়েই সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এক প্রশ্নের জবাবে হাসতে হাসতে বলেন, লবিস্ট নিয়োগ করলেও সেটা দেশের ভালোর জন্য, যা কিছু করি, তা দেশকে রক্ষার জন্য।

যদিও মিনিট দশেক পর তিনি আবারও ব্রিফিং করে তার বক্তব্য থেকে সরে আসেন। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বিএনপির সমালোচনায় সরব। কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফখরুল-মোশাররফের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য নিয়ে ভিডিও আপলোড করেছেন। বিষয়টি নিয়ে বিব্রত বিএনপির নেতারা। দুই সিনিয়র নেতার এমন দ্বিমুখী বক্তব্যে তারা কোনো রা না করলেও ভেতরে ভেতরে সমালোচনা করছেন।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/ফারুক/এমএস