করোনা মহামারি সংকটে ধীরগতি দেখা দিয়েছে জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২১ প্রকল্পে। প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে ট্যাব কেনা নিয়ে নতুন করে শুরু হয়েছে টানাপোড়েন। দু-একবার নয়, তিন লাখ ৯৫ হাজার ট্যাব কিনতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রস্তাব চারবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিবিএস এবারই প্রথম ডিজিটাল পদ্ধতিতে ট্যাবের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে জনশুমারি করার পদক্ষেপ নিয়েছিল। এসব ট্যাব কেনায় মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫৩৭ কোটি ১২ লাখ ১০ হাজার ৩৯৫ টাকা।
Advertisement
অর্থনৈতিক ও সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি বিবিএসকে নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করতে বলেছে। সেই ধারাবাহিকতায় গত বুধবার (২৬ জানুয়ারি) টেন্ডার আহ্বান করে বিবিএস। নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করা হলেও ছক পুরোনোই রয়ে গেছে। যে কারণে বারবার ক্রয় কমিটি থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে বিবিএসের প্রস্তাব। বিবিএসের এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন ও পুনঃমূল্যায়ন করার জন্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ), বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি সুপারিশ করে। কিন্তু কারও মতামত গ্রহণ না করে একটি (সিঙ্গেল) লটে প্রায় চার লাখ আইসিটি সামগ্রী কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করে প্রতিষ্ঠানটি। বিষয়টি ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক পর্যন্ত গড়িয়েছে। আহ্বান করা দরপত্র সংশোধনের জন্য পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বরাবর আবেদন করেছেন তারা।
পরিকল্পনামন্ত্রীকে অনুরোধ করে মোস্তাফা জব্বার বলেন, বর্তমান সরকার যেসব উন্নয়নমূলক কাজ করেছে তার কেন্দ্রে রয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। আধুনিক ও ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদনকারী দেশীয় শিল্পের উন্নয়নে বর্তমান সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ কার্যতালিকায় স্থান পেয়েছে। আপনি (পরিকল্পনামন্ত্রী) অবগত আছেন প্রথমে বিবিএস ৩ লাখ ৯৫ হাজার পিস ট্যাবলেট ও ৭২ পিস এয়ারকন্ডিশন সংগ্রহের জন্য দরপত্র আহ্বান করে। বিবিএসের টেন্ডার স্পেসিফিকেশনে কিছু জটিল শর্তারোপ করা হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম শর্ত গত তিন বছরে একটি সিঙ্গেল কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার এ সংক্রান্ত পণ্য কেনার পূর্বঅভিজ্ঞতা থাকতে হবে। ৩ লাখ ৯৫ হাজার পিস ট্যাবলেট ও ৭২ পিস এসি শুধু একটি সিঙ্গেল লটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স অব গুডস অ্যান্ড রিলেটেড সার্ভিসে ট্যাবের র্যাম সাইজ ২ জিবি বা তার বেশি এবং রম সাইজ ৩২ জিবি বা তার বেশি উল্লেখ করা হয়েছে।
পরিকল্পনামন্ত্রীকে মোস্তাফা জব্বারের করা সুপারিশের মধ্যে রয়ছে- দেশীয় প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষে পূর্বঅভিজ্ঞতা হিসেবে গত তিন বছরে একাধিক কার্যাদেশ বা চুক্তির মাধ্যমে কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকার সমজাতীয় আইটি পণ্য (যেমন- মোবাইল, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ এবং আইটি অ্যাক্সেসরিস) সরবরাহের বিষয়টি প্রতিস্থাপন করা। একটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ দরপত্র শুধু একটি সিঙ্গেল লটে অন্তর্ভুক্ত না করে কমপক্ষে চারটি লটে বিভক্ত করে প্রতিযোগিতামূলক লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা। ট্যাবের কার্যকারিতা ও কার্যক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য র্যাম সাইজ ৪ জিবি বা তার বেশি এবং রম সাইজ ৬৪ জিবি করা, যাতে একটি টেকসই এবং গুণগত মানসম্পন্ন ট্যাব সরবরাহ নিশ্চিত হয়। একই দাবি করেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী পলকও। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের দাবি আমলে নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী সিপিটিইউকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন।
Advertisement
পরিকল্পনামন্ত্রী সিপিটিইউকে আহ্বান করা দরপত্রে কারিগরি বিনির্দেশের কিছু শর্ত সহজীকরণ করতে বলেছেন। মোস্তাফা জব্বার ও প্রতিমন্ত্রী পলকের সুপারিশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে বলেও সিপিটিইউকে মতামত দিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী।
পরিকল্পনামন্ত্রীর মতামতের আলোকে সিপিটিউই জানায়, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর) ২০০৮-এর বিধি ৪৮ অনুযায়ী কোনো ক্রয়ে সুনির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা নির্ধারণের এখতিয়ার ক্রয়কারীর, যা এখানে বিবিএসের। এ বিষয়ে আদর্শ দরপত্র দলিল ই-পিজিথ্রির ইলেকট্রনিক ট্যাক্স ডিডাকশন অ্যাট সোর্স (ই-টিডিএস) ক্লজ ১৫ (বি) (১) এ বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া বিধি ১৫ ও বিধি ১৭ তে একক কাজকে একাধিক কাজে বিভক্তীকরণের বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা আছে। এছাড়া বিধি ২৯ অনুসরণপূর্বক কোনো সুনির্দিষ্ট ক্রয়ে কারিগরি বিনির্দেশ প্রস্তুত করার দায়িত্ব ক্রয়কারীর। সেক্ষেত্রে এখন এটিকে চাইলে বিবিএস একাধিক লটে বিভক্ত করতে পারে, তাতে কোনো বাধা নেই।
তবে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সিপিটিইউর সুপারিশ না মেনে সিঙ্গেল লটেই প্রায় চার লাখ ট্যাব কিনতে যাচ্ছে বিবিএস। এ নিয়ে গত ২৬ জানুয়ারি পুনঃদরপত্র আহ্বান করেছে প্রতিষ্ঠানটি। পুনঃদরপত্রের কারিগরি বিনির্দেশ ও শর্তাবলিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে প্রতিস্থাপন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিনকে অনুরোধ করেছেন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি মো. শাহিদ উল মুনীরও। তিনি বলেন, যেহেতু ক্রয় প্রতিযোগিতা না থাকায় গত ২৫ আগস্ট সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ কমিটি পুনঃদরপত্রের সুপারিশ করেছে। সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পূর্বঅভিজ্ঞতা হিসেবে গত তিন বছরে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে একক কার্যাদেশের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার পূর্বঅভিজ্ঞতার পরিবর্তন করে ৬০ কোটি টাকা করা দরকার। এটা না করলে এক থেকে দুটি কোম্পানি টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে পারবে, যা উন্মুক্ত দরপত্রের যথার্থতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
এদিকে, জনশুমারি প্রকল্পে ধীরগতি নিয়ে বিব্রত পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। আগামীকাল (৩০ জানুয়ারি) চার লাখ ট্যাব কেনার প্রস্তাব যাবে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায়। এরপর অনুমোদন না পেলে বিষয়টি সর্বোচ্চ মহলে গড়াবে বলে দাবি মন্ত্রীর।
Advertisement
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জাগো নিউজকে বলেন, জনশুমারি প্রকল্প নিয়ে আমি বিব্রত। দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে আমি। জনশুমারির ওপর সরকারের সব ধরনের উন্নয়ন পদক্ষেপ নির্ভর করে। এই কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি স্বস্তি পাচ্ছি না।
সিঙ্গেল লটে প্রায় চার লাখ ট্যাব কেনা প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, সিঙ্গেল লটে কিনবে না পাঁচটা লটে কিনবে এটা দেখার সময় নেই। আমি চাই দ্রুত কাজটা যাতে হয়। সিঙ্গেল লটে কিনলেও আপত্তি নেই, একাধিক লটে কিনলেও নেই। তবে আইন ও বিধি অনুযায়ী সব হতে হবে। এবার যদি ট্যাব কেনা না হয় তবে আমি সরকারের উচ্চ মহলে যাবো, এছাড়া পথ দেখছি না।
‘জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২১’ প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে ১ হাজার ৭৬১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ছিল ১ হাজার ৫৭৮ কোটি ৬৮ লাখ এবং প্রকল্প সাহায্য ছিল ১৮১ কোটি ১১ লাখ টাকা। কিন্তু সাহায্যের টাকা না পাওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় কমানো হচ্ছে। নতুন করে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হচ্ছে ১ হাজার ৫৭৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।
‘পপুলেশন অ্যান্ড হাউজিং সেনশাস-২০২১’ প্রকল্পের আওতায় ষষ্ঠ জনশুমারি অনুষ্ঠিত হবে। স্যাটেলাইট ইমেজের মাধ্যমে ২০২১ সালে ষষ্ঠ ডিজিটাল জনশুমারি করা হবে। এ পদ্ধতিতে দেশের একটি থানাও বাদ পড়বে না। স্যাটেলাইট ইমেজ দেখে জনশুমারিতে সারাদেশে ৪ লাখ গণনাকারী তথ্য সংগ্রহ করবেন। শিক্ষিত বেকারদের জনশুমারি প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হবে।
এমওএস/এমআরআর/এএসএম