প্রতিবছর শীত এলেই জলাশয়, হাওড়, খাল-বিল ভরে যায় নানা রং-বেরঙের নাম না জানা পাখিতে। পরিযায়ী বা পরিযায়ী পাখি নামেই আমরা চিনি তাদের। পরিযায়ী পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে আমাদের দেশে হাজির হয় নিজেদের জীবন বাঁচাতে।
Advertisement
আসাম, হিমালয়, সাইবেরিয়া, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ পশ্চিম চীনের মালভূমি, রাশিয়া, ফিনল্যান্ড, তিব্বতের উপত্যকা প্রভৃতি অঞ্চলে এসব পাখিদের বসবাস। শীতকালে এসব দেশে মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডা ও তুষারপাত হয়। অধিকাংশ সময় তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে থাকে।
তাছাড়া তীব্র শীতে খাবারের অভাবও দেখা যায়। সব মিলিয়ে পাখিদের থাকা ও খাবার সংগ্রহ করা তুলনামূলক কঠিন হয়ে পড়ে।
তখন পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে চলে আসে যেসব অঞ্চলের ঠান্ডা কম সেদিকে। এদেশের বিভিন্ন স্থানেও পাড়ি জমায় পরিযায়ী পাখিরা।
Advertisement
এদের মধ্যে আছে বালিহাঁস, পাতিহাঁস, লেজহাঁস, পেরিহাঁস, চমাহাঁস, জলপিপি, রাজসরালি, লালবুবা, পানকৌড়ি, বক, শামুককনা, চখপখিম সারস, কাইমা, শ্রাইক, গাঙ কবুতর, বনহুর, হরিয়াল, নারুন্দি, মানিকজোড়া অন্যতম।
এ সময় অনেকেই পরিবার ও শিশুদেরকে নিয়ে পরিযায়ী পাখি দেখতে যান। তবে জানেন কি, কোথায় কোথায় গেলে দেখতে পাবেন পরিযায়ী পাখিদের?
ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের এলাকা
ঢাকার ভেতরে পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে পিলখানা, মিরপুর চিড়িয়াখানা ও মিরপুর ক্যান্টনমেন্টের পার্শ্ববর্তী লেকে। তবে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখিকে দেখতে যেতে হবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
Advertisement
পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হওয়া নয়নাভিরাম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে ২০১৪ সালে ঘোষণা করা হয় পরিযায়ী পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে।
সিলেটের হাওড় এলাকায়
হাওড়, নদী ও পাহাড়সমৃদ্ধ সিলেটে পরিযায়ী পাখিগুলো খুঁজে পায় পরম আশ্রয়। সিলেট বিভাগজুড়ে বিস্তৃত হাকালুকি হাওড়, মৌলভীবাজারের বাইক্কা বিলে দেখতে পাবেন পরিযায়ী পাখি।
এ ছাড়াও হাইল হাওড় ও পাত্রখোলা লেক, সুনামগঞ্চের টাঙ্গুয়ার হাওড় ও রোয়া বিলে প্রতি বছরই মুখরিত হয়ে উঠে পরিযায়ী পাখির কলকাকলিতে।
চট্টগ্রামের দ্বীপাঞ্চল
বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সন্দীপ, উড়ির চর ও চরণদ্বীপ পরিযায়ীদের পাখি দেখার জনপ্রিয় জায়গা।
এ ছাড়াও বহুল পরিচিতি পেয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত নোয়াখালী জেলার নিঝুম দ্বীপ, হাতিয়া দ্বীপ, চর ওসমান বা শাহেবানিচর, চর পিয়া, বয়ার চর ও চরভাটা।
পর্যটন শহর কক্সবাজারের মহেশখালী ও সোনাদিয়া, টেকনাফের সেন্টমার্টিন দ্বীপ, শাহপরীর দ্বীপ ও হোয়াইক্যংও শীতের সময়টাতে ভরে ওঠে রঙ-বেরঙের পরিযায়ী পাখিতে।
বরিশালের চরাঞ্চল
বৃহত্তর বরিশালের দুর্গাসাগর, ভোলা জেলার মনপুরা দ্বীপ, চর কুকরি-মুকরি, ডাল চরে শীত এলেই আনাগোনা বেড়ে যায় পরিযায়ী পাখির।
একই সঙ্গে সুন্দরবনের দক্ষিণ উপকূল চরমানিক কালকিনি বা চর নিজাম জায়গাগুলো লোকারণ্যে পরিপূর্ণ হলেও শীতের এ সময়টায় নাম না জানা হরেক রকম পরিযায়ী পাখির দেখা পাওয়া যায়।
পটুয়াখালী জেলার জনপ্রিয় পর্যটন স্থান কুয়াকাটার পাশাপাশি খেপুপাড়া বা কলাপাড়া, চরমন্তাজ, সোনার চর, এমনকি আগুনমুখা নদী, গলাচিপা নদীতেও জলকেলি দেখা যায় পরিযায়ী পাখির।
দেশের মধ্য ও উত্তরাঞ্চল
বাংলাদেশের উত্তরের জেলা নীলফামারীর নীলসাগর, সিরাজগঞ্জের হুরা, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটর জুড়ে বিস্তৃত চলন বিলে দেখতে পাবে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখি।
এ ছাড়াও পঞ্চগড়ের ভিতরগড় ও পদ্মার চরে প্রতি শীতে দেখা যায় পরিযায়ী পাখিদের ঝাঁক। আবার মধ্যাঞ্চলের নেত্রকোণার কলমকান্দার হাওর, কিশোরগঞ্জের নিকলি হাওর ও কলাদিয়াও বেশ সুপরিচিত পরিযায়ী পাখি দর্শনের জন্য।
পরিযায়ী পাখির অবাধ বিচরণের স্বার্থে সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সারাদেশে ১২টি অভয়ারণ্য থাকার কথা। তবে অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হলো, প্রকৃতপক্ষে অভয়ারণ্য বলতে যা বুঝায় তা আজ পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে গড়ে ওঠেনি।
১৯৭৪ সালের প্রণীত বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনের ২৬ ধারা অনুযায়ী পাখি শিকার ও হত্যা দণ্ডনীয় অপরাধ।
এ আইন থাকার পরেও বেআইনিভাবে শিকার হচ্ছে পরিযায়ী পাখি। শুধু তাই নয়, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, ফসলে অতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগের মাধ্যমে পরিযায়ী পাখিদের কাঙ্ক্ষিত পরিবেশকে প্রতিকূল করে তোলা হচ্ছে।
একশ্রেণির লোভী শিকারীর নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে প্রতি বছরই প্রাণ হারাচ্ছে হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আসা দুর্লভ প্রজাতির পরিযায়ী পাখিগুলো।
কখনো জালের ফাঁদ পেতে, কখনো বা বিষটোপ দিয়ে, আবার কখনো ছররা গুলি দিয়ে শিকার করে বাজারে নিয়ে যায় বিক্রির জন্য। এমনকি কেউ কেউ শখের বশেও ধরে চলেছেন পরিযায়ী পাখিদের।
ফলে অতীতের তুলনায় বাংলাদেশে এই পাখিদের সংখ্যা কমছে। পর্যটকদের অনেকে পাখির খুব কাছে চলে গিয়ে চমকে দেয়।
কেউ আবার দূর থেকে ঢিল মেরে আতঙ্কিত করে পাখি উড়ে যাওয়ার দৃশ্য উপভোগ করতে চায়। এতে পাখির অবাধ বিচরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রকৃতির সৌন্দর্য্যের হাতছানি আদিম ও অকৃত্রিম। তবে সেই সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে গিয়ে তা নষ্ট করা উচিত নয়। পরিযায়ী পাখি শুধু অপরূপ প্রকৃতির অংশ নয়; পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
তাই তাদের আশ্রয়স্থলকে বাঁচাতে পরিযায়ী পাখির জন্য প্রণীত আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে পরিযায়ী পাখিদের বিচরণ স্থানগুলোতে বসবাসরত মানুষদেরও।
এইকই সঙ্গে যারা পরিদর্শনে যাচ্ছেন তাদেরও যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে এই নৈসর্গিক বিস্ময়কে টিকিয়ে রাখতে।
লেখক: রায়হান আহমেদ তামীম,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে
জেএমএস/এমএস