ইউক্রেন উত্তেজনায় হুমকি-পাল্টা হুমকি দিয়ে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে কোনো সময় ইউক্রেনে হামলা চালানোর নির্দেশ দিতে পারেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সেই হামলা প্রতিহত করতে ন্যাটো জোটের অংশীদার ইউক্রেনে ৯০ টনের মতো সামরিক সহায়তা পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রও। সামরিক সহায়তা না পাঠালেও ইউক্রেনে মানবিক সহায়তা অব্যাহত রেখেছে জার্মানি।
Advertisement
এই উত্তেজনার মুহূর্তে ইউক্রেনকে তার ন্যাটো মিত্রদের থেকে বিভাজিত করতে ক্রেমলিনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র কী হতে পারে তা নিয়ে চলছে আলোচনা। বিশ্লেষকদের ধারণা প্রাকৃতিক গ্যাসকেই এক্ষেত্রে বড় অস্ত্র বানাতে পারে মস্কো। ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটো গোষ্ঠী যদি ‘বৈরী আচরণ’ করে, তবে রাশিয়া তাদের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে ইউরোপে, তাহলে বড় বিপাকে পড়বে গোটা মহাদেশ। রাশিয়ার গ্যাসলাইন ইউক্রেনের ওপর দিয়েই ইউরোপে গেছে।
ইউরোপের এই উদ্বেগের কারণ ইতোমধ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছে রাশিয়া। তাদের সামরিক ট্যাঙ্কসহ সৈন্যরা ইউক্রেন সীমান্তে জড়ো হওয়ার পরপরই মস্কো প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। অথচ ইউরোপের দেশগুলোর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে জ্বালানি চাহিদা পূরণের প্রাণকেন্দ্র হলো রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাস। এর মধ্যে আবার প্রচণ্ড শীতকালীন আবহাওয়া পরিস্থিতি বিরাজ করছে ইউরোপজুড়ে। ফলে জ্বালানির উৎস নিয়ে গোটা মহাদেশেই এক ধরনের চাপা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
পরিস্থিতি আঁচ করে এ বিষয়ে রাশিয়াকে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নেড প্রাইস এক টুইটার বার্তায় বলেছেন, ‘গ্যাস সরবরাহ ও ট্রানজিট কখনোই রাজনৈতিক হাতিয়ার হতে পারে না। আমরা আশা করবো ইউক্রেনের পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। রাশিয়ার উচিত নিজেদের নির্ভরযোগ্য গ্যাস সরবরাহকারী বলে প্রমাণ করা।’
Advertisement
মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) বাইডেন প্রশাসনের তরফ থেকে মস্কোকে সতর্কবার্তা দিয়ে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক গ্যাসের বাজারে সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটলে কেবল রাশিয়ার নিজেরই ক্ষতি হবে। কারণ, রাশিয়ার কেন্দ্রীয় বাজেটের প্রায় অর্ধেক যোগান আসে তেল ও গ্যাস রপ্তানির আয় থেকে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরও পুতিনের দেশ থেকে কয়েক দশক ধরে জ্বালানি সরবরাহ অব্যাহত আছে ইউরোপে। তবে চলমান সংকট ও উত্তেজনার ধারাবাহিকতায় রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন চালিয়ে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হলে গ্যাস বন্ধ করে দেওয়ার দিকে যেতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা রাশিয়ার গ্যাসের বিকল্প খোঁজার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছে। ইউরোপিয়ান নেতারা ইতোমধ্যেই গ্যাস এবং বিদ্যুতের আকাশছোঁয়া দাম নিয়ে উদ্বিগ্ন।
বাইডেন প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্মকর্তা সম্প্রতি বলেছেন, এই দুশ্চিন্তা ভর করার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার শীর্ষ প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনকারী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। একইভাবে অভ্যন্তরীণভাবে তাদের সরবরাহ ক্ষমতা অটুট রাখা এবং ইউরোপীয় ক্রেতাদের জন্য তাদের প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ সাময়িকভাবে বৃদ্ধি করার বিষয়েও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, আগামী সোমবার (৩১ জানুয়ারি) কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল-থানিকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সেখানে ইউরোপে কাতারের প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হতে পারে।
Advertisement
বাইডেন প্রশাসনের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, জ্বালানি সরবরাহকে যদি রাশিয়া অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে তবে এটির অর্থনৈতিক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তাদের ওপরেও। তাদের একরৈখিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ইউরোপের যেমন গ্যাস প্রয়োজন তেমনি তাদের তেল ও গ্যাস সরবরাহ করে বিপুল অর্থ উপার্জন দরকার।
কিন্তু রাশিয়ান নীতিনির্ধারকরা বলছেন, মার্কিন নেতাদের হুমকি মোতাবেক যদি তাদের দেশকে সুইফট নামে পরিচিত আন্তর্জাতিক ব্যাংক প্রক্রিয়াকরণ সিস্টেম থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, তখন তারাও প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেবেন।
রাশিয়ার পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের ভাইস স্পিকার নিকোলাই ঝুরাভলেভ একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, যদি রাশিয়া সুইফট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তাহলে আমরা মুদ্রা পাবো না। আবার ক্রেতারা, বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলো আমাদের পণ্যগুলোও পাবে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্যাস নিয়ে ইউরোপের এই জটিলতার মধ্যে পড়ার কারণ রাশিয়ার ওপর দীর্ঘমেয়াদী নির্ভরশীলতা, বিকল্প তরলীকৃত গ্যাসের নতুন পাইপলাইন কিংবা তরলীকৃত গ্যাস আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় স্থাপনার সীমাবদ্ধতা ছাড়াও নানাবিধ জটিলতা।
এদিকে রাশিয়া থেকে সরাসরি জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহের জন্য ‘নর্ড স্ট্রিম-টু’ পাইপলাইন প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে রাশিয়া থেকে সরাসরি জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ করার কথা রয়েছে। ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে যাওয়া গ্যাস পাইপলাইনটি এক হাজার ২২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। যা নির্মাণে সময় লেগেছে পাঁচ বছর, ব্যয় হয়েছে ১১০০ কোটি মার্কিন ডলার। তবে লাইনটি দিয়ে এখনো গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়নি। জার্মানির সরকারের এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছে তাদের অনেক মিত্র দেশ। তারা বলছে, এটি রাশিয়ার ওপর জার্মানির নির্ভরতাকে আরও গভীর করবে।
এসএন্ডপি গ্লোবাল প্ল্যাটসের ইউরোপীয়ান গ্যাস বিশ্লেষণী ম্যানেজার জেমস হাকস্টেপ বলেছেন, যদি প্রশ্ন করা হয় রাশিয়ার গ্যাসের ওপর ইউরোপ কতটা নির্ভরশীল? এই প্রশ্নের সংক্ষেপে উত্তর হচ্ছে ‘খুব’।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের তথ্য বলছে, ১৯৭০ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ইউরোপ প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি শুরু করে। সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে সেই নির্ভরতা আরও বেড়েছে। বছরে এখন ৪০ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস ইউরোপে সরবরাহ করে রাশিয়া। কিন্তু রাশিয়া দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির অধীনে প্রায় অর্ধেক গ্যাস সরবরাহ করে আসছে। ফলে অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার কারণে ইউরোপীয় দেশগুলোতে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে প্রায় ছয় বা সাত গুণ বেড়েছে।
রাশিয়া ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয়। তারপর থেকে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে সরকারি বাহিনী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে সংঘাত চলছে। সম্প্রতি ইউক্রেন সীমান্তে বিপুল সেনাসমাবেশ ঘটিয়েছে রাশিয়া। পশ্চিমাদের আশঙ্কা, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে সরকারি বাহিনী ও বিচ্ছিন্নবাদীদের মধ্যে লড়াইয়ের সুযোগ নিয়ে সেখানে সামরিক অভিযান চালানোর ছক কষছে রাশিয়া। যদিও বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করছে মস্কো।
এই সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের জন্য ইউরোপের কতটা ত্যাগ স্বীকার করা উচিত তা নিয়ে আঞ্চলিক নেতারা এরই মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার মুহূর্তে রাশিয়া এর আগেও ২০০৬ এবং ২০০৯ সালে ইউক্রেনের জন্য গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। যেটি বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করে ইউরোপে।
এসএনআর/এইচএ/এএসএম