মতামত

লজ্জা আমাদের ভূষণ ছিল!

এ-কথাটি লিখতে আমি লজ্জাবোধ করছি না। আমাদের সমাজের প্রায় সর্বক্ষেত্রে এই ভূষণটি আজকাল আর দেখতে পাচ্ছি না। সমাজের তৃণমূল স্তরের মানুষদের মধ্যেও এই বোধ উধাও বলতে হচ্ছে। তাদের কথা তো আমরা মনেই রাখি না। সমাজের মধ্যম স্তরের মানুষ যারা, যাদেরকে আমরা মধ্যবিত্তবান বলে মনে করি বা বিবেচনা করি, তাদের মধ্যেও এই মানবিক বোধের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি।

Advertisement

গবেষণগণ বলতে পারবেন, লজ্জা নামক অনুভূতি বা সামাজিক ন্যায়বোধের সঙ্গে জড়িত মানুষের ভেতরে কেমন পর্যায়ে আছে। আমরা জানতাম এবং এখনো জানি, শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মনে এই বোধ সবচেয়ে তীব্র। লজ্জিত হবেন ভেবে তাদের অনেক আচরণ সীমা অতিক্রম করে না। কথা-বার্তায়, আচার-আচরণে, সামাজিকতা রক্ষায় ওই শিক্ষিত প্রজন্ম আজো লজ্জাকেই ভূষণ হিসেবে গ্রহণ করে চলেছেন।

কিন্তু সব সেক্টরে কি সেই সব শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত প্রজ্ঞাবানদের লজ্জিত হতে দেখা যায়? যায়, আবার কাউকে কাউকে লজ্জা পেতে দেখছি না আমরা। মনে হচ্ছে সমাজ-সংসার থেকে মানবিক ওই অনুভূতি বিলোপ হতে শুরু করেছে।

লজ্জিত হবার বিষয়টি বিলোপ হয়েছে রাজনীতি থেকে অনেককাল আগেই। বিশেষ করে রাজনীতিকরা যখন থেকে তার অনুসারীদের কথা দেন যে ক্ষমতায় গিয়ে তিনি/তারা এ-সব কাজ করবেন, কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তারা সেটা করেন না, ভুলে যান বা খেলাপ করে বসে থাকেন, তখন একবারও তাদের মনে ওয়াদা বরখেলাপের জন্য লজ্জা এসে তাকে জড়িয়ে ধরে না। লজ্জা হরণের সূচনা সেখান থেকেই।

Advertisement

ওয়াদা যখন লঙ্ঘিত হয় এবং তার জন্য জনগণের সামনে করজোরে ক্ষমা চাইতে হয় না বা জবাবদিহি করতে হয় না, পরবর্তী নির্বাচনের কথা ভেবেও যখন তারা জনগণকে দেয়া ওয়াদা শরণ করে জবাবদিহি করেন না, তখন আমরা বুঝতে পারি, ওই রাজনীতিকদের জনগণের ভোটের দরকার পড়ে না। তারা নানান কায়দা কৌশলে, ছলে-বলে-কলে-কৌশলে ক্ষমতার মসনদে চড়ে বসেন। সেটা যে অবৈধ এবং লজ্জাজনক, সেটাও তারা উপলব্ধি করেন না। এইগুলোই ভূষণ-ত্যাগের নমুনা।

আমাদের দেশেরই কেবল নয়, পৃথিবীর রাজনৈতিক সমাজের সিংহভাগ মানুষ মধ্যবিত্তের। ওই মধ্যবিত্তবানেরাই শিক্ষিত শ্রেণি, তাদের শিশু-কিশোররাই শিক্ষিত হয়ে প্রশাসনের কিংবা রাজনীতির হাল ধরেন কিংবা তাদেরই প্রতিনিধিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ও শিক্ষক হন, কিন্তু সংস্কৃতির সিংহপুরুষ বা নারী হিসেবে বরিত হন। এরাই আমাদের প্রাতঃস্মরণীয় মানব সন্তান। তারাই আমাদের আগামি দিনের দিক-নির্দেশক, অগ্রগামি চিন্তার অগ্রসৈনিক, আমাদের সাংস্কৃতিক সৌন্দর্যের অধিনায়ক, নেতা। আমরা তাদেরই মানসপুত্তলি। কিন্তু আমরা হারিয়ে বসেছি আমাদের মহার্ঘ সম্পদ ‘ ভূষণ ’। এই ভূষণ কিভাবে হাত ছাড়া হয়ে যায় তারই একটি নমুনা এই নিউজটি।

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে ছয় দিনের বেশি সময় ধরে চলমান আমরণ অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহারের জন্য ‘সম্মিলিত অনুরোধ’ জানিয়েছেন আন্দোলনরত কয়েক শ শিক্ষার্থী। তবে অনশনকারীরা এ অনুরোধে সাড়া দেননি। অনশনকারীরা বলেছেন, তাঁরা আমরণ অনশন চালিয়ে যাবেন।

১৩ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়টির বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অসদাচরণসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েক শ ছাত্রী। একপর্যায়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা চালায়। পুলিশ শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে এবং তাঁদের লক্ষ্য করে শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোঁড়ে। পরে এই আন্দোলন উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রূপ নেয়। [প্রথম আলো/২৬/২০২২]

Advertisement

সংক্ষেপে এই হলো সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির পদত্যাগ দাবির সর্বশেষ পরিস্থিতি। কেন এমন হলো শাবিপ্রবি’র বিষয়টি। আমার মনে পড়ছে, ভিসি ফরিদউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন সরকার যদি চায় বা বলে তাহলে তিনি পদত্যাগ করবেন।

এর উত্তরে এটাই বলা যায়, একজন ভিসির মর্যাদা কি সরকারের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করে? তাঁর নিজের আত্ম- মর্যাদাবোধটি কোথায় গেল? তিনি কি সরকারের প্রতিনিধি? নাকি তিনি একজন শিক্ষক এবং একজন ছাত্র প্রতিনিধি, যার নেতৃত্বে ওই বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালিত হচ্ছে।

অভিযোগ উঠেছিল সিরাজুননেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। তার পদত্যাগ চাইছিলো ওই হলের কয়েকশ ছাত্রী। তিনি ছাত্রীদের সম্পর্কে কুমন্তব্য ও অসদাচরণ করেছিলেন। ভিসি সেই বিচার না করে তাকে বহাল রাখেন। একজন শিক্ষক, যিনি জ্ঞানের প্রতিপালক ও মানুষ গড়ার কারিগর, তিনি কিভাবে মাস্তানদের লেলিয়ে দিতে পারেন তারই শিক্ষার্থীর ওপর? ধরে নিলাম তিনি এ-কাজ করেননি।

তাহলে ছাত্রলীগের শিশুরা কি এমনি খেলাচ্ছলে মেয়েদের ওপর হামলা চালিয়েছিল? ধরে নিলাম তিনি যেহেতু সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত, তাই তার পাশে শক্তি হিসেবে ছাত্রলীগ দাঁড়াবেই। আগেও আমরা ছাত্রলীগের এ-রকম সুকর্ম আমরা দেখেছি।

ভিসি ফরিদউদ্দিন আহমেদ জ্ঞান চর্চার প্রাঙ্গণে পুলিশ ডেকে এনে তারই ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর পুলিশি লাঠিপেটা করেন। একজন শিক্ষকের কি এই কুকর্মের জন্য সামান্যতম শরম জাগেনি মনে? পুলিশ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়েছে। পুলিশ তো মানুষ নয়, তারা কি হুকুমের দাস কেবল? তাদের মনের ভেতরে কি মানবিকতা ও সম্ভ্রমবোধ নেই?

তারা যে জনগণের সেবক বা তাদের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত ও নিয়োগপ্রাপ্ত এই জ্ঞান কি তাদের প্রশিক্ষণের সময় দেয়া হয়নি? তাদেরকে কি কেবল শেখানো হয় যে তাদের প্রভু হচ্ছে সরকারের লোকজন। তারা যা বলবেন, যে আদেশ দেবেন, সেই আদেশই নতমস্তকে মেনে চলতে হবে?

এমনও তো হতে পারে ওই পুলিশের সন্তানও ওই আন্দোলনে রয়েছে। আবার এটাও তো বলতে পারি আমরা যে ওই ছাত্রছাত্রীরা তো তাদেরই সন্তানতুল্য শিক্ষার্থী?

একজন শিক্ষকের পক্ষে এ-রকম করার মনোবৃত্তি তখনই জন্মে যখন তিনি হারিয়ে ফেলেন তার প্রকৃত ভূষণ। তিনি যে শিক্ষক সেই মর্যাদা তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি যে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক, সেটাও তিনি ভুলে গেছেন।

আসলে এই সংকট ঘনীভূত করেছেন ভিসি ফরিদউদ্দিন আহমদ নিজেই। যে সমস্যার সমাধান হতে পারতো অসদাচরণকারী প্রাধ্যক্ষকে বিচারের আওতায় এনে কিংবা তাকে ওই পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে। সেই সমস্যাকে তিনি টেনে নিয়ে এসেছেন নিজের মানসিক অপকর্মের ওপর।

তিনি যে ওই বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর মতো দক্ষ ও দূরদর্শী প্রশাসক হবার মতো যোগ্যতা রাখেন না, ভিসির পদই তার কাছে প্রধান, তাই তিনি ছাগলের মতো খুট্টি ধরে আছেন। সরকার বা প্রধানমন্ত্রী না বলা পর্যন্ত তিনি পদত্যাগ করবেন না। ভূষণ যে তার চলে গেছে কোথায় তা তিনি টের পাননি।

শেষ খবর পাওয়ার পর্যন্ত ছাত্ররা শাবিপ্রবির সাবেক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের অনুরোধে গতকাল বুধবার সকালে অনশন ভেঙেছেন। তবে ভিসির পদত্যাগের দাবিতে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।

লেখক : কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/এএসএম