একুশে বইমেলা

বইমেলা ও প্রকাশনা শিল্প টিকে থাকার লড়াই

মো. রহমত উল্লাহ

Advertisement

ফেব্রুয়ারি মাস ভাষার মাস। এ মাসেই জমে ওঠে বাঙালির প্রাণের মেলা, অমর একুশে বইমেলা। বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাষাচর্চায় উদ্ভাসিত হয়ে গভীর শ্রদ্ধায় জাতি স্মরণ করে মহান ভাষা শহীদদের। অমর একুশে বইমেলা বাঙালির চেতনা জাগরণের মেলা।

গতবছর করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলা একাডেমি অমর একুশে বইমেলা আয়োজন না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পরবর্তীতে লেখক-প্রকাশকের অনুরোধে করোনা সংক্রমণ কমবে ভেবে ফেব্রুয়ারির বইমেলা মার্চ মাসে শুরু হয়।

খুবই দুর্ভাগ্য, বইমেলা শুরুর পরে অতি দ্রুতই করোনার প্রাদুর্ভাব চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়তে থাকে। যে কারণে বইমেলায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। করোনা সংক্রমণ চরমভাবে বেড়ে যাওয়ায় সারাদেশে লকডাউন হয়। গণপরিবহন থেকে শুরু করে অফিস-আদালত সবকিছু বন্ধ থাকলেও পাঠকশূন্য বইমেলায় প্রকাশকদের স্টল খোলা রাখতে হয়। কারণ লকডাউনেও বইমেলা খোলা থাকে।

Advertisement

যার অভিজ্ঞতা খুবই তিক্ত এবং কষ্টদায়কও বটে। কারণ একদিকে লকডাউন আর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ। অন্যদিকে বইমেলা চলছে! এমন অবস্থায় কীভাবে মানুষ বইমেলায় আসবে? কীভাবে পছন্দের বইপত্র সংগ্রহ করবে। যার ফলে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রকাশনা শিল্প।

করোনায় মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতির চাকা চালু করতে সরকার ক্ষুদ্র-মাঝারি সব ধরনের ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দেন। সরকারের সহযোগিতায় আমাদের বিপর্যস্ত অর্থনীতির চাকা আবার ঘুরে দাঁড়ায়। যা সত্যিই খুব প্রশংসনীয় সফলতা সরকারের।

অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি করোনায় প্রকাশনা শিল্পও ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এই খাতে কোনো সরকারি সহযোগিতা জোটেনি। পায়নি কোনো ধরনের প্রণোদনার সুযোগ-সুবিধা। তাই প্রকাশনা শিল্পের অস্তিত্ব চরম সংকটের মুখে পড়েছে। এই শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় সরকারের সুদৃষ্টির প্রয়োজন। তা না হলে হারিয়ে যাবে ক্ষুদ্র-মাঝারি প্রকাশনা শিল্প। যা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের ধারাবাহিকতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা।

এরই মধ্যে বছর ঘুরে চলে এলো আমাদের প্রাণের অমর একুশে বইমেলা ২০২২। সম্পন্ন হয়েছে বাংলা একাডেমির সমস্ত প্রস্তুতি। যদিও করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার কারণে মেলা ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আশা করছি বাংলা একাডেমি মেলা আয়োজনের নতুন তারিখ ঘোষণা করবে।

Advertisement

প্রতিবারের ন্যায় এবারও প্রকাশকরা নতুন নতুন বই প্রকাশের নানা কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন। করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নতুন করে বিনিয়োগ করেছেন প্রকাশকরা।

এরই মধ্যে করোনার অতি সংক্রামক ওমিক্রন হানা দিয়েছে। করোনার প্রকোপ বাড়ায় ভীষণ দুশ্চিন্তার ছায়া পড়েছে প্রকাশনা শিল্পে। কারণ গতবছরের ক্ষতি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এর মধ্যে আবার নতুন করে ক্ষতির আশঙ্কা।

হঠাৎ করোনা অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় বইমেলা হওয়া না হওয়া নিয়ে শুরু হয়েছে অনিশ্চয়তা। প্রকাশকদের মধ্যেও রয়েছে ভিন্ন মত। কেউ মেলায় অংশগ্রহণের পক্ষে, আবার কেউ করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার বইমেলা না হওয়ার মত প্রকাশ করেন। এমন অবস্থায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ২ সপ্তাহের জন্য বইমেলা স্থগিত করেছে।

করোনার কষাঘাতে প্রকাশনা শিল্পের নিভু নিভু অবস্থা। এমন সংকটাপন্ন মুহূর্তে প্রকাশনা শিল্পকে বাঁচাতে সরকারি সহযোগিতা অবশ্যক। আমি বিশ্বাস করি, সংস্কৃতিবান্ধব, বইবান্ধব ও প্রকাশনাবান্ধব বর্তমান সরকার এ করোনার সময়ে প্রকাশনা শিল্পকে বাঁচাতে উদ্যোগী হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা আামদের প্রকাশনা শিল্পকে বাঁচাতে অচিরেই কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে আশা করছি।

করোনাকালে প্রকাশনা শিল্পকে অন্তত কিছুটা সহায়তার জন্য প্রাথমিকভাবে একটি পদক্ষেপ নিতে পারে সরকার। আর তা হচ্ছে, জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সারাদেশে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নারে’ বই ক্রয়ের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রাথমিক সরকারি বিদ্যালয়ে শিশুদের উপযোগী বই ক্রয়ের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানাই।

মেধাবী জাতি গঠনে সৃজনশীল বইয়ের বিকল্প নেই। তা ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস এবং জাতির পিতার নীতি আদর্শ ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আর এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের জন্য প্রকাশনা শিল্পকে বাঁচাতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

অন্যদিকে আমি খুদে পাঠক সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সৃজনশীল বই দেওয়ার জোর দাবি জানাই। যেন আমাদের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে উঠতে পারে। তবেই বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর সুফল আমাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে। আমি মনে করি, এতেই গড়ে উঠবে সুশিক্ষিত একটি জাতি। গড়ে উঠবে সোনার বাংলা।

লেখক: যুগ্ম-নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি।

এসইউ/এমএস