নতুন বছরের শুরু থেকেই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট চোখ রাঙাচ্ছিল। গত কয়েকদিন ধরে দেশে করোনার দৈনিক সংক্রমণও হঠাৎ বাড়তে শুরু করে। এই কলামটি লেখা পর্যন্ত (শুক্রবার) মহামারি শুরুর পর থেকে দেশে এ পর্যন্ত মোট ১৬ লাখ ৫৩ হাজার ১৮২ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। ভাইরাসটিতে মারা গেছেন ২৮ হাজার ১৮০ জন। আক্রান্তদের মধ্যে মোট সুস্থ হয়েছেন ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৮৪৫ জন। দেশের এমতো অবস্থায় করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন রোধে আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও অনুরূপ ব্যবস্থাগ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
Advertisement
গত শুক্রবার (২১ জানুয়ারি) এ নির্দেশনাসহ ছয়টি জরুরি নির্দেশনা জারি করেছে। নির্দেশনাগুলোর ১ও ২ নম্বরে বলা হয়েছে ২১ জানুয়ারি (শুক্রবার) থেকে আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সকল স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনুরূপ ব্যবস্থাগ্রহণ করবে। এবং ৩ নম্বর নির্দেশনায় বলা হয়েছে রাষ্ট্রীয়/সামাজিক/রাজনৈতিক/ধর্মীয় সমাবেশ/অনুষ্ঠানে ১০০ জনের বেশি সমাবেশ করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যারা যোগ দেবেন তাদের অবশ্যই ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট/২৪ ঘণ্টার মধ্যে পিসিআর সার্টিফিকেট আনতে হবে।
এখন কথা হচ্ছে যে, ৩ নম্বর নির্দেশনা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয়/সামাজিক/রাজনৈতিক/ধর্মীয় সমাবেশ/অনুষ্ঠানে ১০০ জনের বেশি সমাবেশ করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যারা যোগ দেবেন তাদের অবশ্যই ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট আনতে হবে। রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্ষেত্রে যদি এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার সুযোগ থাকে তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও এমন সিদ্ধান্ত কেন বহাল থাকবে না? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তো আরো সচেতন ব্যক্তিদের চলাচল।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাইমারি, মাধ্যমিক স্তরের কথা বাদ দিলাম তারা ছোট, কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার পর তারাই কি ঘরে থাকবে? না থাকতে পারবে? অন্যান্য জায়গার মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও সীমিত পরিসরে ক্লাসের ব্যবস্থা করা হোক। সকল শিক্ষার্থীকে স্বাস্থ্যবিধি পরিপূর্ণভাবে মানার জন্য কঠোর ব্যবস্থা করা হোক। সকল নিয়ম কানুন মেনে সশরীরে ক্লাস পরীক্ষা চালু থাকুক। ক্লাসে ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট দেখিয়ে প্রবেশ করানো হোক। আর সমাবেশে ১০০ লোকের অধিককে না করেছেন। যেখানে ১০০ লোক নিয়ে সমাবেশ করা যায় সেখানে একটা ক্লাসে ৫০ জন নিয়ে ক্লাস করা সম্ভব।
Advertisement
এবার আসুন ৪ ও ৫ নম্বর নির্দেশনায়, যেখানে বলা হয়েছে সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিল্পকারখানায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবশ্যই ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট গ্রহণ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে দায়িত্ব বহন করবে এবং বাজার, মসজিদ, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট, রেলস্টেশনসহ সবধরনের জনসমাবেশে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। মানে সব জায়গা গুলোই সচল আছে।
সব কিছুই চলবে তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে,মাস্ক পরিধান করে এবং ভ্যাকসিনের সার্টিফিকেট গ্রহণ করে চলাফেরা করতে হবে। হ্যা খুবই ভালো কথা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাফেরা করবে সবাই। এটা ভালো দিক। কিন্তু প্রশ্ন একটাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্টরা কি এই নিয়ম-কানুন গুলো মানতে নারাজ ছিল যে হঠাৎ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিলেন? মনে হয় না কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যবিধি মানতে অস্বীকার করেছিল তাহলে হঠাৎ করেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ কেনো?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করলেই কি শিক্ষার্থীরা-শিক্ষকরা নিরাপদ? তা অবশ্যই না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করলে শুধু ওই প্রতিষ্ঠানই বন্ধ থাকবে। পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করবে শিক্ষার্থীরা এবং শিক্ষকরা। অন্যদিকে শুধু যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই বন্ধ রাখা হয় আর সব কিছু স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকে তাহলে কি লাভ হবে আমাদের?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করলেই যে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ হয়ে গেলো তা কিন্তু না। কেননা প্রত্যেক শিক্ষার্থীই একটি পরিবারের সদস্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে সে বাড়িতে থাকবে কিন্তু তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা আয়-রোজগারের জন্য ঠিকই বাইরে যেতে বাধ্য। সেখান থেকেও অসুস্থ হতে পারে সে সুতরাং সে ঘরে থেকেও নিরাপদ না।
Advertisement
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধে সমস্যা যে এতটুকুই তা নয়। এ সমস্যার গভীরতা অনেক বেশি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে অনেক গুলো বিষয় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সচল থাকলে কোটি মানুষের আয়-রোজগারের পথ সচল থাকে।পরিবার পরিজন নিয়ে তারা দুমুঠো ভাত খেতে পারে তিনবেলা। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেই স্বাভাবিকভাবে তাদের পরিশ্রমী হাতদুটো চলে যায় মাথায়। চিন্তা,হতাশা গ্রাস করে তাদের। এই চিত্র খুব কাছ থেকে দেখেছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে আমাদের থেকে বেশি চিন্তা করে তারা। এ বিষয়টা খুবই বেদনা দায়ক। একটু ঠান্ডা মাথায় বিষয়গুলো ভাবা উচিৎ।
অবশ্যই মন্ত্রিপরিষদ অনেক বিজ্ঞ। অনেক ভেবে চিন্তেই হইতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু কোনদিক থেকে ভেবেছেন জানিনা। সশরীরে ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ করে সব কিছু যদি অনলাইনেই করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তাহলে বাংলাদেশের পেক্ষাপটে এটা আরেকবার ভুল হবে। বর্তমান প্রজন্ম এবং আগামীর প্রজন্মকে এর ফল ভোগ করা লাগবে। গত এক বছরে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম অর্থাৎ পাঠদান সম্ভব হলেও পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয় নি।
অনেকেই বলবেন যে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে আমিও বলবো হয়েছে কিন্তু সেটা সিকি পরিমাণ বাকি জায়গা গুলোতে নেওয়া হয়েছে অ্যাসাইনমেন্ট। এটাকে মূলত পরীক্ষা বললে ভুল হবে। গত এক বছরে অনলাইন ক্লাসের স্বাদ আমরা খুব ভালোমতো পেয়েছি। ডিভাইস না থাকা, নেটওয়ার্ক না থাকা, ডাটা না থাকা, পর্যাপ্ত পরিমাণ পরিবেশ না থাকাসহ নানা প্রতিবন্ধকতার স্বীকার হতে হয়েছে আমাদের। এসব প্রতিবন্ধকতার কারনে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দিকে ক্লাসের উপস্থিতির উপর নম্বর না থাকার ঘোষণা দিলেও পরবর্তীতে সেই কথা রাখেনি শিক্ষকরা। পছন্দের ছাত্র অনুযায়ী নিজের ইচ্ছামতো নম্বর বসিয়ে রেখেছেন। ফলে বেগ পেতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। অমরা অনলাইনে ক্লাস করেছি ঠিকই কিন্তু আমরা পরীক্ষা দিতে পারিনি অনলাইনে ফলে দুই সেমিস্টারের পরীক্ষা একই সাথে দেওয়া লেগেছে।
অন্যদিকে করোনার প্রথম ছুটিতে দীর্ঘদিন পনেরো মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শুধু গত বছরেই ৫০ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আত্নহত্যা করেছে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই ৫০ জন! আরো অনেক হিসাবের বাইরে আছে যাদের পরিসংখ্যান আমাদের সামনে আসে না। এর পরেই আছে দারিদ্র্য এবং বেকারত্ব। সেই ভয়াবহ দিন কি আবার দেখতে হবে আমাদের? আমরা আবারও সেই পথেই হাঁটছি।
মানছি শিক্ষার্থীদের সুস্থতার জন্য, তাদের নিরাপদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করলেন কিন্তু আসলেই কি আমরা নিরাপদে থাকতে পারছি? করোনাভাইরাসের কারনে গত ১৫ টা মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিলো। নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রনের তান্ডব শুরু হয়েছে। শিক্ষাজীবন থেকে একটা বছর চলে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে অন্যসব কিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছিলো। এবারও ঠিক তাই। দেশের অন্য সব কিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে কিন্তু হঠাৎ করেই বন্ধ করা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সব কিছু খোলা রেখে হঠাৎ করেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার মানে কি?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি করোনার উৎপাদন কেন্দ্র যে এটাকে বন্ধ করলে আর করোনা উৎপাদন হবে না,বা এখান থেকেই করোনা ছড়াচ্ছে এটা বন্ধ করলে বাকি সব নিরাপদ হয়ে যাবে? ঠান্ডা মাথায় একবার শিক্ষার্থীদের কথা ভাবুন, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলির কথা ভাবুন। যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে হলেও সশরীরে ক্লাস পরীক্ষা চালু রাখুন। জনসচেতনতা গড়ে তুলুন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাই একমাত্র সমাধান হতে পারে না।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।imranhossain64.bd@gmail.com
এইচআর/এমএস