কোভিড ভাইরাসের বিবর্ধিত ছবি আমরা সবাই দেখেছি। এ ভাইরাসের গোটা শরীরজুড়ে থাকে অনেক স্পাইক। ইংরেজি ‘স্পাইক’ শব্দটির বাংলায় একটি অর্থ হয় গজাল বা পেরেক। ভাইরাসের বিবর্ধিত ছবিতে যেসব স্পাইক বা গজালসদৃশ জিনিস দেখা যায়, সেগুলো আসলে প্রোটিন। কেতাবি ভাষায় এগুলোকে তাই বলা হয় ‘স্পাইক প্রোটিন’। বলা চলে, এগুলোই সকল নষ্টের গোড়া।
Advertisement
কোভিড-১৯ ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করা মাত্রই তাণ্ডব শুরু করে দেয় না বা দিতে পারে না। তাণ্ডব শুরু করার জন্য এই ভাইরাসের চাই মানুষের শরীরের কোনো কোষে প্রবেশ করা। কোষে প্রবেশ করতে না-পারলে ভাইরাস কিছুক্ষণের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যায়। তো, ভাইরাসের গায়ের ওই স্পাইক প্রোটিনগুলো একে মানবকোষে প্রবেশ করতে সাহায্য করে।
এগুলো অনেকটা ‘চাবি’র মতো কাজ করে; মানবকোষের ‘তালা’ খুলে ভিতরে প্রবেশ করতে ভাইরাসকে সাহায্য করে। চীনা বিজ্ঞানী চাং লিনছি ও তার গবেষণাদল যখন কোভিড রোগীর চিকিত্সায় ব্যবহার-উপযোগী একটি অ্যান্টিবডি ককটেইল ড্রাগ তৈরির গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন, তখন তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ভাইরাসকে মানবকোষে প্রবেশে বাধা দেওয়া।
প্রফেসর চাং লিনছি
Advertisement
প্রফেসর চাং লিনছি চীনের সেরা ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিনের গ্লোবাল হেল্থ অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস রিসার্চ সেন্টার এবং কম্প্রিহেনসিভ এইডস রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক। তিনি ১৯৯২ সালে স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের রকফেলার ইউনিভার্সিটিতে প্রায় ৯ বছর কাজ করেন। পরে, ২০০৭ সালে তিনি ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।
বিগত তিন দশক ধরে তার গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল এইডস ভাইরাসের উত্স ও বিস্তার এবং এতে আক্রান্তদের জন্য কার্যকর চিকিত্সাপদ্ধতি আবিষ্কার করা। সাম্প্রতিককালে তিনি মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম করোনাভাইরাস (এমইআরএস-কো ভি), ইবোলা, জিকা, অ্যাভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়েও গবেষণা করেন।
সর্বশেষ তিনি গত দু’বছর ধরে কাজ করছেন কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিত্সায় কার্যকর একটি ড্রাগ তৈরির জন্য। বলা বাহুল্য, তিনি ও তাঁর দলের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে; তাঁরা একটি কার্যকর অ্যান্টিবডি ককটেইল ড্রাগ তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁরা দু’বছরের কম সময়ে, প্রফেসর চাংয়ের ভাষায়, দশ বছরের কাজ করেছেন।
চাং লিনছি ও তাঁর গবেষণাদলের সদস্যবৃন্দ
Advertisement
প্রফেসর চাং ও তাঁর দলের গবেষণাকাজ চলেছে ব্রি সায়েন্সেস (Brii Sciences), ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও চীনের শেনচেন শহরের তৃতীয় গণহাসপাতালের যৌথ উদ্যোগে। তাঁদের গবেষণায় শেষ পর্যন্ত যে ড্রাগ বা ওষুধটি আবিষ্কৃত হয়, সেটির কেতাবি নাম ‘মনোক্লোনাল নিউট্রালিজিং অ্যান্টিবডি ককটেইল’ (monoclonal neutralizing antibody cocktail)। নানান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর, ২০২১ সালের ৮ই ডিসেম্বর, চীনের সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগ কোভিডে আক্রান্ত রোগীদের চিকিত্সায় এই ড্রাগের জরুরি ব্যবহার অনুমোদন করে।
কোভিড রোগীর চিকিৎসায় অ্যান্টিবডির ব্যবহার আগেও হয়েছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চিকিত্সায়ও অ্যান্টিবডি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু চীনের তৈরি ড্রাগটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি দুটি অ্যান্টিবডির সমন্বয়ে তৈরি এবং এখন পর্যন্ত তৈরি সবচেয়ে কার্যকর কোভিড ড্রাগ। এ ড্রাগটি তৈরি করা হয়েছে ‘এমুবারভামাব’ (amubarvimab) ও ‘রমলাসেভিমাব’ (romlusevimab) নামক দুটি অ্যান্টিবডির সমন্বয়ে। আগে এ দুটি অ্যান্টিবডির নাম ছিল যথাক্রমে বিআরআইআই-১৯৬ ও বিআরআইআই-১৯৮।
অ্যান্টিবডি রোগ প্রতিরোধ করে। আজকাল সারা বিশ্বজুড়ে কোভিডের টিকা দেওয়া হচ্ছে। এই টিকার মূল কাজই হচ্ছে শরীরে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরি করা। কোভিড টিকা যে-অ্যান্টিবডি তৈরি করে, সেটি কোভিড ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানবদেহের পক্ষে লড়াই করে। প্রফেসর চাং ও তাঁর দল সর্বমোট ২০৬টি এন্টিবডি থেকে ওই দুটি অ্যান্টিবডি বাছাই করেন। কাজটা সহজ ছিল না। প্রতিটি অ্যান্টিবডি অনন্য।
দুই শতাধিক অ্যান্টিবডি থেকে সেরা দুটি বাছাই করা তাই ছিল চ্যালেঞ্জিং। এই বাছাইকাজের সময় তারা এমন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দুটি অ্যান্টিবডিকে বাছাই করেন, যেগুলো মানবদেহের সেসব অংশকে চিহ্নিত করতে সক্ষম, যেখানে বসে কোভিড ভাইরাস কোষকে আক্রমণ করে। তারপর তারা পরীক্ষা করে দেখেন যে, এ দুটি অ্যান্টিবডি একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করে ভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরির ক্ষমতা নষ্ট করে দিতে পারে কি না। এসব যাচাই-বাছাই করে তাঁরা দুটি অ্যান্টিবডি চিহ্নিত করেন এবং তৈরি করেন অ্যান্টিবডি ককটেইল ড্রাগ।
কোভিড ভাইরাসের মডেল হাতে প্রফেসর চাং
যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা ও ফিলিপিন্সের ১১১টি কেন্দ্রে এ ওষুধের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রালায় চালানো হয়। ফলাফল সন্তোষজনক। গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে, কোভিডে আক্রান্ত উচ্চ ঝুঁকির রোগীর শরীরে এই ককটেইল ড্রাগ প্রয়োগ করা হলে মৃত্যুর আশঙ্কা ৮০ শতাংশ কমে যায়। চীনের এ ড্রাগ যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেল্থ আয়োজিত বৈশ্বিক ট্রায়াল প্রোগ্রামেও অংশগ্রহণ করে এবং এ ধরনের অন্যান্য ড্রাগের তুলনায় ভালো পারফরমেন্স দেখায়।
প্রফেসর চাং জানান, এই ড্রাগ মূলত হালকা ও মাঝারি উপসর্গযুক্ত রোগী এবং ডায়াবিটিস ও হার্টের সমস্যাযুক্ত কোভিড রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য। এটি শুধু কোভিড ভাইরাসকে মানবকোষে প্রবেশে বাধা দেয়, তা নয়, বরং এটি মানুষের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতাকেও বাড়ায়। কারণ, যে-কোনো অ্যান্টিবডি মানুষের শরীরের রোগ-প্রতিরোধকব্যবস্থার অংশ। এই ড্রাগ মানুষের শরীরে প্রয়োগ করার সাথে সাথে কাজ শুরু করে এবং ৯ থেকে ১২ মাস কার্যকর থাকে।
যেমনটি আগেই উল্লেখ করেছি, এই ড্রাগের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়েছে চীনের বাইরে। কারণ, ততদিনে মহামারি নিয়ন্ত্রণে চলে আসায় ট্রায়ালে অংশ নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত রোগী চীনে ছিল না। আর তাই এই প্রজেক্ট একটি আন্তর্জাতিক রূপ পায়। চীনা টিকার চাহিদা যেমন বিশ্বব্যাপী, তেমনি এই নতুন ককটেইল অ্যান্টিবডি ড্রাগের চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে। অনেক দেশ ইতোমধ্যেই এই ড্রাগ পেতে আগ্রহ দেখিয়েছে। আশা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ সংস্থা (এফডিএ) খুব শিগগিরই এই ড্রাগ সেদেশে ব্যবহারের অনুমোদন দেবে।
কোভিড-১৯ ভাইরাস
অবশ্য, চাহিদা যতই থাকুক, এখনই এ ড্রাগ আন্তর্জাতিক বাজারে পাওয়া যাবে না। এর জন্য আরও কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, একটি ট্রিটমেন্ট গাইডলাইন এখনও তৈরি হয়নি। সেটি তৈরি করার কাজ চলছে। আবার, ওষুধের মজুত, পরিবহন ও উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশও সৃষ্টি করতে হবে। সাধারণভাবে এ ওষুধ তৈরিতে সময় লাগে দুই থেকে তিন মাস। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ওষুধের অগ্রিম ক্রয় বা বুকিং সিস্টেম চালুর কথাও ভাবছে।
কোভিড-১৯ ভাইরাস প্রতিনিয়ত রূপ বদলাচ্ছে। সহসা এর কবল থেকে পুরোপুরি রেহাই মিলবে, এমনটা আশা করা যায় না। তাই, বিশ্বব্যাপী চীনে তৈরি অ্যান্টিবডি ককটেইল থেরাপির মতো অন্যান্য চিকিত্সার চাহিদা থাকবে। বিশেষ করে, চীনা ওষুধের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আগ্রহটা তুলনামূলকভাবে বেশি। এটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ, বিশ্বে চীন মহামারি মোকাবিলায় সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছে। এখনও চীনে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ছাড়ায়নি; মৃতের সংখ্যাও ছাড়ায়নি ৫ হাজারের কোঠা। মহামারি প্রতিরোধে নেওয়া বিভিন্ন চীনা উদ্যোগ সফল হয়েছে; সফল হয়েছে কোভিডে আক্রান্তদের চিকিত্সায় চীনের বিভিন্ন পদ্ধতিও।
চীনের অ্যান্টিবডি ককটেইল ড্রাগ আবিষ্কারক প্রফেসর চাং লিনছি এইডস নিয়েই মূলত গবেষণা করে আসছিলেন। ককটেইল থেরাপি এইডসে আক্রান্তদের জীবনমান অনেক উন্নত করেছে। কিন্তু এ প্রাণঘাতী রোগের একটি কার্যকর চিকিৎসাপদ্ধতি বা একটি টিকা আবিষ্কার প্রফেসর চাংয়ের মতো বিজ্ঞানীদের স্বপ্ন। কাজটা সহজ নয় মোটেই। কিন্তু এ ফিল্ডের অন্যান্য বিজ্ঞানীর মতো প্রফেসর চাংও কাজ করে যাবেন এ স্বপ্ন পূরণের জন্য। বলা বাহুল্য, কোভিড রোগীর চিকিৎসায় অ্যান্টিবডি ককটেইল ড্রাগের আবিষ্কার তাকে সামনে এগিয়ে যেতে অতিরিক্ত উৎসাহ যোগাবে।
লেখক: বার্তাসম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।alimulh@yahoo.com
এইচআর/এএসএম