সাইফুল ইসলাম সুমন
Advertisement
সুদ শব্দটি উর্দু। এর আরবি প্রতিশব্দ হলো- الرِّبٰوا। অনেকের দৃষ্টিতে রিবা ও সুদ সমার্থবোধক শব্দ। না, ‘রিবা’ শব্দটি আরও ব্যাপক অর্থবোধক। ‘সুদ’ রিবার একাংশ মাত্র। সুদকে ইংরেজিতে বলা হয় ইন্টারেস্ট (interest) বা ইউজারি (usury)। ‘রিবা’র অর্থ হলো- বেশি হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া, অতিরিক্ত, সম্প্রসারণ, মূল থেকে বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
সুদ কী?
ইসলামি শরিয়তে লেনদেনের ক্ষেত্রে চুক্তির শর্তানুযায়ী শরিয়াহ সম্মত কোনোরূপ বিনিময় ব্যতীত মূলধনের উপর অতিরিক্ত যা কিছু গ্রহণ করা হয়; তাকে সুদ বলে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধের শর্তে কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য বা অর্থের বিপরীতে পূর্ব নির্ধারিত হারে যে বেশি পরিমাণ পণ্য বা অর্থ আদায় করা হয়, সেটিই ‘সুদ’। হাদিসে এসেছে-
Advertisement
হজরত উবায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, কোনো কর্জ থেকে কোনো ফায়দা নিলে ঐ ফায়দা এক ধরনের রিবা।’ (বায়হাকি)
আবার একই শ্রেণিভুক্ত পণ্যের পারস্পরিক লেনদেনের সময় চুক্তি মোতাবেক অতিরিক্ত যে পরিমাণ পণ্য গ্রহণ করা হয়, তাকেও রিবা বা সুদ বলা হয়। যেমন ধরুন-
আপনার কাছ থেকে কেউ ১০ টাকা ধার নিল, প্রয়োজন শেষে ওই লোকের কাছ থেকে যদি আপনি ১০ টাকার পরিবর্তে ১১ টাকা গ্রহণ করেন তাহলে যে বাড়তি ১ টাকা গ্রহণ করেছেন সেটি-ই সুদ। কিন্তু যদি ১০ টাকা ধার দেয়ার পরে ওই লোকের প্রয়োজন শেষে তার সমপরিমাণের চেয়ে বেশি দামে অন্য কোন পণ্য গ্রহণ করেন তাহলে সেটা সুদ হবে না।
এক কথায় একই জিনিস ধার দিলে তা সমপরিমাণের চেয়ে বৃদ্ধি করে আনা যাবে না, তবে একই পণ্যের পরিবর্তে অন্য কোনো পণ্য বৃদ্ধি করে আনা যাবে।
Advertisement
সুদ কি হারাম?
হ্যাঁ, সুদ হারাম। মহান আল্লাহ তাআলা সুদকে হারাম করেছেন এবং ব্যবসাকে হালাল করেছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য করে অর্থ উপার্জন করা সুন্নাহ আর সুদের কারবার করে অর্থ উপার্জন করা সম্পূর্ণ হারাম। আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
اَلَّذِیۡنَ یَاۡکُلُوۡنَ الرِّبٰوا لَا یَقُوۡمُوۡنَ اِلَّا کَمَا یَقُوۡمُ الَّذِیۡ یَتَخَبَّطُهُ الشَّیۡطٰنُ مِنَ الۡمَسِّ ؕ ذٰلِکَ بِاَنَّهُمۡ قَالُوۡۤا اِنَّمَا الۡبَیۡعُ مِثۡلُ الرِّبٰوا ۘ وَ اَحَلَّ اللّٰهُ الۡبَیۡعَ وَ حَرَّمَ الرِّبٰوا
‘যারা সুদ খায়, তারা তার ন্যায় (কবর থেকে) উঠবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, ব্যবসা তো সুদের মতই। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৭৫)
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে (সুদের কারবারিকে) পাগল বা উন্মাদ বলেছেন; যারা বলে, ব্যবসা তো সুদের মতোই। যেমন- ‘মানুষকে জিন আক্রমণ করলে যেমন মানুষ জ্ঞানহীন বা উন্মাদ হয়ে যায়; ঠিক তেমনই যারা সুদ গ্রহণ করে তারা শয়তানের স্পর্শের কারণে পাগল বা উন্মাদ হয়ে যায়।’
সুদ হারাম কেন?
এদিকে আল্লাহ তাআলা ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম। ব্যবসায় যে অতিরিক্ত অর্থ আসে তা ব্যবসায়ীর মেধা, শ্রম ও সময়ের বিনিময়ে আসে। তাই তো আল্লাহ তাআলা ব্যবসাকে হালাল করেছেন। কিন্তু সুদ হারাম কেন?
সুদ হারাম হওয়ার কারণ হলো- সুদের যে অতিরিক্ত অর্থ আসে তার জন্য মেধা ও শ্রম ব্যয় করতে হয় না। সময় শেষে তা থেকে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করা হয়। এতে যে ব্যক্তি কর্জ গ্রহণ করে; ওই ব্যক্তির জন্য অতিরিক্তি অর্থ আদায় করা ‘জুলুম’।
অথচ আল্লাহ তাআলা কত সুন্দরভাবেই না ঘোষণা করেছেন
یَمۡحَقُ اللّٰهُ الرِّبٰوا وَ یُرۡبِی الصَّدَقٰتِ ؕ وَ اللّٰهُ لَا یُحِبُّ کُلَّ کَفَّارٍ اَثِیۡمٍ
‘আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ কোনো অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালবাসেন না।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৭৬)
মহান আল্লাহ এ আয়াতে বান্দাদের সুদ থেকে বিরত থাকার প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি সুদকে ধ্বংসশীল হিসেবে ঘোষণা করেছেন। সুদকে পরিহার করার কথা বলেছেন। কারণ সুদে বরকত আসে না। সুদ গ্রহণকারী উপর নেমে আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিশাপ। পাশাপাশি দানের প্রতি উৎসাহিত করেছেন। কারণ দান করলে সম্পদে বরকত লাভ হয়। দানশীল ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন।
দানের ফজিলত
দানের একটি আমলেই আল্লাহ বান্দাকে রিজিক দান করেন। আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে ঘোষণা করেন-
قُلۡ اِنَّ رَبِّیۡ یَبۡسُطُ الرِّزۡقَ لِمَنۡ یَّشَآءُ مِنۡ عِبَادِهٖ وَ یَقۡدِرُ لَهٗ ؕ وَ مَاۤ اَنۡفَقۡتُمۡ مِّنۡ شَیۡءٍ فَهُوَ یُخۡلِفُهٗ ۚ وَ هُوَ خَیۡرُ الرّٰزِقِیۡنَ
‘(হে রাসুল! আপনি) বলুন, ‘নিশ্চয়ই আমার রব তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা রিজিক প্রশস্ত করেন এবং সঙ্কুচিত করেন। আর তোমরা যা কিছু আল্লাহর জন্য ব্যয় (দান) কর; তিনি তার (দানের) বিনিময় দেবেন এবং তিনিই (দানের বিনিময়ে) উত্তম রিজিকদাতা।’ (সুরা সাবা : আয়াত ৩৯)
কত সুন্দর ও সুস্পষ্ট ঘোষণা এটি। আমলটি হলো- আল্লাহর দেওয়া রিজিক থেকে তাঁরই পথে ব্যয় করা। যারা আল্লাহর দেওয়া সম্পদ থেকে ব্যয় করবে; আল্লাহ তাআলা তাদের বিনিময় দেবেন। আর সেই বিনিময় হলো উত্তম রিজিক।
সুদের ভয়াবহতা ও শাস্তি
সুতরাং সুদ থেকে বিরত থাকা ঈমানদারের একান্ত আবশ্যক কাজ। সুদের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। হাদিসের একাধিক বর্ণনা থেকে তা প্রমাণিত-
১. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা সুদ খায়, সুদ দেয়, সুদের হিসাব লেখে এবং সুদের সাক্ষ্য দেয় তাদের উপর আল্লাহর লানত এবং এ অপরাধের ক্ষেত্রে প্রত্যেকে সমান অপরাধী।’ (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি)
২. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সুদের গুনাহ ৭০ প্রকার; তন্মধ্যে সবচেয়ে কম ভয়ংকর বা ছোটটি হলো- একজন লোকের তার আপন মায়ের সঙ্গে ব্যভিচারের সমান।’ ( ইবনে মাজাহ, বায়হাকি)
৩. নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা ৪ ধরনের লোকদের জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেবেন না-
> যারা অভ্যাসগতভাবে মাতাল;
> সুদ গ্রহণকারী;
> অন্যায়ভাবে ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাৎকারী;
> বাবা-মার প্রতি অবাধ্যতাকারী/অমনোযোগী।’
সুতরাং ‘সুদ’কে ‘না’ বলুন। ব্যবসাকে ‘হ্যাঁ’ বলুন। কল্যাণের জীবিকা পেতে দান করুন। কষ্ট যত বেশিই হোক না কেন; প্রয়োজন যত বেশিই হোক না কেন; নিজের প্রয়োজন ও কষ্টের কথা মহান আল্লাহকে বলুন। তিনিই সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন। ধারণাতীত জায়গা থেকে দান করবেন সাহায্য ও রিজিক।
মুমিন মুসলমানের উচিত, সুদের লেনদেনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রেখে ব্যবসা করে হালাল পন্থায় জীবিকা নির্বাহ করা। দুনিয়ার জীবনে সুদসহ আল্লাহর সব নিষেধাজ্ঞাকে নিজেদের জীবনে মেনে চলা। সুদ পরিহার করা। সুদের ভয়াবহতা ও শাস্তি থেকে নিজেদের হেফাজত করা। কোরআনের বিধান মোতাবেক জীবন পরিচালনা করা।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সুদের কারবার থেকে হেফাজত করুন। সুদের ভয়াবহতা ও শাস্তি থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
লেখক : গণমাধ্যম কর্মী ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ সাংবাদিক সমিতি।
এমএমএস/এএসএম