ওমিক্রনের ঢেউ ক্রমেই বাড়ছে, ধারণ করছে অশুভ পরিস্থিতি। এরকম দুর্যোগপূর্ণ সময়ে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আন্দোলনে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। একসাথে আন্দোলনে নেমেছে কয়েক হাজার ছাত্র। দাবি আদায়ে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে তারা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে।
Advertisement
সমাধানের পথে না হেঁটে ছাত্র আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্য ভুল করে বসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন; পুলিশ কর্তৃক গুলি-টিয়ারশেল ছুড়ে আন্দোলনরত সাধারণ ছাত্রদের ওপর, দেদারসে হয় লাঠিচার্জ, ছাত্রদের রক্তে রক্তাক্ত হয় বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর থেকে শুরু হয় ছাত্রদের একদফার আন্দোলন– ভিসি ফরিদ উদ্দিনসহ তার প্রশাসনের পদত্যাগ।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের প্রান্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম। প্রযুক্তি খাতে নানা উদ্ভাবন এবং উৎকর্ষ সাধনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা বলতে গেলে উল্লেখযোগ্য অবস্থানে। এখানে যারা পড়তে আসেন তারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেই আসেন। শুধু শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়; দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে চড়াই-উতরাই ও চ্যালেঞ্জ থাকায় খেটে খাওয়া নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং অতিদরিদ্র পরিবারের ছাত্ররা এখানে চান্স পায়। এমন সব পরিবার থেকে ছাত্ররা উঠে আসে যে, তাদের পক্ষে টিউশনি করে মেটাতে হয় পড়াশোনার খরচ।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে হওয়ায় একদিকে টিউশন পাওয়া যেমন দুরূহ, অন্যদিকে পড়ার পাশাপাশি কোনো একটা কাজ করে যে পড়াশোনার খরচ মেটাবে সেই সুযোগ অনুপস্থিত। ফলে শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ অংশকে নির্ভর করতে হয় পরিবার অথবা শিক্ষাবৃত্তির ওপর। বিশ্ববিদ্যালয়টির নানা অবদান থাকলেও ছাত্রদের জন্য ব্যবস্থা করা যায়নি পর্যাপ্ত আবাসিক হলের, যে কয়েকটি আছে তাতে লেগে রয়েছে নানান সংকট।
Advertisement
কয়েকদিন ধরে তিন দফা দাবিতে ছাত্ররা আন্দোলন করে আসছিল। তাদের দাবিগুলো ছিল– বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ কমিটির পদত্যাগ, দায়িত্বশীল ও ছাত্রীবান্ধব প্রাধ্যক্ষ কমিটি নিয়োগ এবং হলের যাবতীয় অব্যবস্থাপনা নির্মূল করে সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করা।
ছাত্রীদের সাথে হল প্রশাসনের দুর্ব্যবহার থেকে এই আন্দোলনের সূত্রপাত। আগের নানা অনিয়ম-পরবর্তী শেষ পর্যন্ত দুর্ব্যবহারের শিকার হয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট শুরু থেকে আন্দোলনে থাকলেও ছাত্রদের ওপর পুলিশি আক্রমণ ও সহিংসতার পর নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
কোভিড-১৯ এর কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিগত দুই বছরে হয়েছে শিক্ষার অপূরণীয় ক্ষতি। অথচ সামান্য ঘটনা নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতেই জারি করা হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের নোটিশ। বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীরাও বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকাল বন্ধের নোটিশ প্রত্যাখ্যান করে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। আন্দোলনকালীন সময়ে শিক্ষার্থীরা পুলিশ প্রশাসনকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানিয়েছেন; বিপরীতে পুলিশ তার জবাব দিয়েছে গুলির বিনিময়। ভয় দেখাতে ব্যবহার করা হচ্ছে রায়টকার, জলকামান।
ছাত্র আন্দোলন দমনে পুলিশের পাশাপাশি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে প্রস্তুত রাখা হয়েছে একাধিক নিরাপত্তা বাহিনী। তাহলে ছাত্ররা তাদের দাবি নিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে পারবেন না? যে শিক্ষক ছাত্রদের দিকে বন্দুকের নল তাক করার নির্দেশ দেন সে শিক্ষক হয় কি করে! সন্তানদের শত শত মাইল দূরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে এরকম পরিস্থিতিতে অভিভাবকরা কি চিন্তামুক্ত থাকতে পারেন? দুর্ব্যবহার বা অসহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব বা সহ্যক্ষমতার অভাব থাকলে তারা শিক্ষকতা পেশায় আসবেনই কেন? শিক্ষকরা আমাদের গুরুজন, পরম শ্রদ্ধেয়। তারা আমাদের দ্বিতীয় মা-বাবা। ছাত্র যতো বড় অন্যায় করুক না কেন, একজন সত্যিকারের শিক্ষক কখনোই শিক্ষার্থীদের প্রতি গুলির নির্দেশ দিতে পারেন না; শিক্ষার্থীর রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারেন না। অথচ বাস্তবতা পুরোপুরি উল্টো।
Advertisement
বারবারই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর এ সম্পর্কে ভাঙন ধরেছে! এমন একটা যুগে আমরা প্রবেশ করেছি যে, শিক্ষক ছাত্রদের সাথে মিশতে অনীহা বোধ করেন। ক্যান্টিনে খাওয়া থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে চড়া পর্যন্ত সব রকমের সুবিধার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ছাত্রদের সাথে দূরত্ব তৈরি করেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমন সব আচরণ করা হয় যেন ছাত্ররা তাদের প্রজা। অধিকন্তু এই একই শিক্ষক বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে গিয়ে সেখানকার ছাত্রদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণে সংকীর্ণতা রাখেন না।
শিক্ষক যদি এরকমের অসৌজন্যমূলক-আক্রমণাত্মক হবেনই তখন তাকে গুরুতরভাবে মনে রাখা প্রয়োজন– রাষ্ট্রের শিক্ষা কার্যক্রম সচল এবং শিক্ষার্থীর প্রয়োজনে শিক্ষক দরকার হয়, শিক্ষকের প্রয়োজনে কখনোই শিক্ষাব্যবস্থা নয়। ছাত্রদেরও স্মরণ রাখা চাই যে শিক্ষকই আমাদের শ্রদ্ধেয়, প্রধান পথনির্দেশক।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা হল প্রাধ্যক্ষের অসহযোগিতামূলক আচরণ এবং নানা অনিয়মের তৎপরবর্তী হল কমিটির পদত্যাগের আন্দোলনে নেমেছেন। হামলার শিকার হলে রূপ নিয়েছে ভিসির পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন। ছাত্র আন্দোলনে গুলি-টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে আন্দোলন দমন অসম্ভব, বরং অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের এজেন্ডা শিক্ষার সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ। মহামারির ভিতরে শ্রেণিকক্ষ ছেড়ে আর যেন তাদের রাস্তায় না নামতে হয়। গুরুতর জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে দ্বিতীয় কোনো এজেন্ডা তৈরির আগেই ছাত্রদের দাবির প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারা সবার জন্যই মঙ্গল। সুষ্ঠু সমাধান প্রত্যাশা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, ঢাকা।
এইচআর/এএসএম