বিএনপির এবারের ৫ জানুয়ারির জনসভায় দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তৃতা দেশের মানুষকে নিঃসন্দেহে স্বস্তি এনে দিয়েছে। এক বছর আগেও এইদিনে একই উপলক্ষে তিনি যে কর্মসূচির সূচনা করেছিলেন তাতে রাজনীতির ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন কলঙ্কজনক ঘটনা হিসেবেই লিপিবদ্ধ থাকবে। টানা তিন মাসের তথাকথিত অবরোধে যেভাবে পেট্রোল বোমা দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে তা সভ্য সমাজে ঘটতে পারে না। দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু আর পাঁচ শতাধিক মানুষকে আহত করার দায় বিএনপি কখনোই এড়াতে পারবে না। বোধকরি ইতিহাসের ছাত্ররা অতীতে বা ভবিষ্যতেও অমন আত্মঘাতী রাজনৈতিক কর্মসূচির উদাহরণ দ্বিতীয়টি খুঁজে পাবে না। এক বছরের মধ্যেই বিএনপি দেশের মানুষের মনোভাব বুঝতে পেরে এবার যে সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছে তা যদি ধরে রাখা যায় অদূর ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের বিজয় তথা জনগণেরই বিজয় হবে। একইদিনে আওয়ামী লীগও রাজধানীর দুই জায়গায় সমাবেশ করেছে। এই দুই দলের ঐতিহ্য অনুযায়ী রাস্তায় মিছিল নিয়ে যে যার সমাবেশে যাওয়ার সময় একটু উত্তেজনা ছড়ানোরই কথা। কিন্তু এবারের ৫ জানুয়ারি সেরকম কিছুই ঘটেনি। এতে এটাই প্রমাণ হয়েছে যে সদিচ্ছা থাকলে পাশাপাশি বা মুখোমুখি বা পাল্টাপাল্টি সমবেত হয়েও শান্তিপূর্ণ থাকা যায়। দেশের মানুষ এটাই চায়। এবার সারাদেশের মানুষ যে ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে একটু উৎকণ্ঠায় ছিল না তা বলা যায় না। ভয়ে অনেক মানুষ রাজধানীতে যানবাহন বের করেনি। একারণে তিনটি বিরাট সমাবেশ হওয়ার পরও যানজট তেমন প্রকট হয়নি যা আগের দিন এক ছাত্রলীগের মিছিলের কারণেই শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছিল। দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় পর খালেদা জিয়া মঙ্গলবার এত বড় সমাবেশে বক্তৃতা দিলেন। তিনি একবারও বলেননি, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল করা হোক কিংবা সরকার অবৈধ। তিনি সরকারের পদত্যাগও দাবি করেননি। তাই খালেদা জিয়ার এবারের বক্তৃতা বিশেষভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এছাড়া এক সপ্তাহও পার হয়নি দেশের ২৩৪ টি পৌরসভায় ভোটাভুটি হয়েছে, যেখানে বিএনপির ভরাডুবির কারণ খুঁজলে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মতো যথেষ্ট উপাদান পাওয়া যায়। এমনই প্রেক্ষাপটে ৫ জানুয়ারি রাজধানীতে একটি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ঘটানো অভিনন্দনই পাওয়ার যোগ্য। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বললেন, জ্বালাও পোড়াও ভাঙচুর নয়, বিএনপি সত্যিকারের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চায়। আমরা বিশ্বাস করতে চাই আগুনে পোড়া মানুষগুলোর কষ্ট উপলব্ধি করে খালেদা জিয়া ওই কথা বলেছেন। এবং শিক্ষা নিয়েছেন জ্বালাও পোড়াও আগুন দিয়ে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। তার কাছে ভবিষ্যতে আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কর্মসূচিই আশা করতে পারি। পাশাপাশি এটিও আশা করতে পারি ভবিষ্যতে একটি মানুষও রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে হত্যা করা হবে না। সরকারকে খালেদা জিয়া বলেছেন, “বন্ধ করেন… অনেক কিছু করেছেন, কোনো কিছুতে এগুতে পারেননি, লাভবান হননি। আসুন সংলাপ করে আলোচনা করে তার মধ্য দিয়ে একটা সমাধান বের করে আনি, গণতন্ত্র আনি। যাতে দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ বের করা যায়।”এই দাবি যেকোনো রাজনৈতিক দল যেকোনো সময়ই করতে পারে। আর আলোচনার উদ্যোগ নেয়ার আহ্বানতো গণতন্ত্রেরই অংশ। যে আলোচনার আহ্বান শেখ হাসিনা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ফোন করে দাওয়াত দিয়েছিলেন, খালেদা জিয়া সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে আজ তিনি নিজেই আলোচনার অনুরোধ জানাচ্ছেন। এটাকে আমরা ইতিবাচক রাজনীতির দিকে বিএনপির পা বাড়ানো বলেই মনে করি। খালেদা জিয়া সরকারকে উদ্দেশ করে বলেছেন, “সঠিক পথে আসুন, গণতন্ত্রের পথে আসুন। না হলে কিন্তু জনগণ কখন জেগে উঠবে বলা যায় না।… জনগণকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।” খুবই খাঁটি কথা বলেছেন। জনগণ জেগে ওঠলে যে ঠেকিয়ে রাখা যায় না এটা অন্তত তিনি বুঝতে পেরেছেন। কখন কার বিরুদ্ধে যে জনগণ জেগে ওঠবে আসলেই বলা মুশকিল। জনসভায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তিনি দেশে ‘রাজতন্ত্র কায়েম করার’ চেষ্টার অভিযোগ এনেছেন। ভবিষ্যতে যেন তাঁর বিরুদ্ধেও কেউ এরুপ অভিযোগ আনতে না পারে নিশ্চয় তিনি সেটি স্মরণ রাখবেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে বলেছেন, ‘‘তিনি কী এমন লাট সাহেব হয়ে গেছেন যে কারও সঙ্গে কথা বলবেন না? অভিযোগের সমাধান করবেন না?” “তারা অর্থব ও মেরুদণ্ডহীন।’’ এমন কথাও বলেছেন। নির্বাচন কমিশন যে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনা তা এরইমধ্যে প্রমাণিত। কোনোদিন বিএনপি ক্ষমতায় আসলে আতীতের মত যেন মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশন না বানায় সেই আশাই করবে জাতি। তবে ‘‘লাট সাহেব’’ জাতীয় শব্দ একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখে মানায় না। অন্য রাজনৈতিক দলের কর্মীদের ‘হয়রানি-নির্যাতনের’ জন্য সরকার পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করছে বলেও খালেদা জিয়ার অভিযোগ। অভিযোগ সত্য। অতীতে তিনিও একই ভাবে পুলিশকে ব্যবহার করেছেন। ভবিষ্যতে করবেন না বলেই আমরা ধরে নেবো। খালেদা জিয়া বলেছেন, “আমরা একসঙ্গে থাকতে চাই। বাংলাদেশ ছোট্ট একটি দেশ। আমরা যদি সকলে মিলে-মিশে থেকে কাজ করি, বাংলাদেশকে আমরা একটি সুন্দর দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব।” পুরো বক্তৃতায় এটিই সবচে সুন্দর উচ্চারণ। এরচেয়ে ভালো কোনো কথাই হতে পারে না। ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বা জনপ্রশাসনের কারও ‘চাকরি যাবে না’ বলেও তিনি অভয় দিয়েছেন। গত বছর এ দিনে তিনি তাদের ‘‘গোপালি’’ বলে গাল দিয়েছিলেন। জেলার নামও পাল্টে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই এজন্য তিনি অনুতপ্ত। খালেদা জিয়া বলেছেন, “আমরা কোনো প্রকার জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেব না। যারাই এগুলো করবে, তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে। বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে অন্য দেশের ওপর হামলা করা… আমি আমার মাটি অন্য দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য দেব না।”অতীতে শুধু প্রশ্রয়ই নয় জঙ্গিবাদকে লালনও করেছে বিএনপি জামায়াত সরকার। এবং সেটির ফলও পেয়েছে। সেকথা মাথায় রেখে যদি খালেদা জিয়া জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় না দেয়ার ঘোষণা দেন তাহলে অবশ্যই তাকে সাধুবাদ জানাতে হবে। তবে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গিবাদ দমন করা সম্ভব নয়। এটি যদি তার দল বুঝতে পারে তাহলে সেদিনই এই কথা বিশ্বাসযোগ্য হবে। আর বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে না দেয়ার কথা বলে তিনি ভারতকে যে বার্তা দিতে চেয়েছেন তাও অভিনন্দন পাওয়ার মত। কারণ বিএনপির আমলে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে এদেশে উলফা আস্তানা গেড়ে বসেছিল। সেটি ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায়ই প্রমাণিত। ভবিষ্যতে কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় না দেয়ার অঙ্গীকার ভারত কতোটা বিশ্বাস করবে সেটি ভারতের বিষয়। তবে ভিনদেশি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দিয়ে যে ভালো ফল পাওয়া যায় না, এটি যে সংকট বাড়ায় তা অনুধাবন করতে পারার জন্য আবারো ধন্যবাদ। খালেদা জিয়া বিদ্যুৎ-গ্যাস ও জ্বালানি তেলে দাম কমানোর দাবি জানিয়েছেন। তার এই দাবি পূরণের আন্দোলনের ডাক দিলে বোধকরি দেশের সকল মানুষই অংশ নেবে। সরকারের দখলি মনোবৃত্তির কারণে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ‘রুদ্ধ’ হয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন খালেদা জিয়া।যেদেশের বুদ্ধিজীবীরা দলদাসের মতো আচরণ করেন সেদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কতোটুক অর্থবহন করে সে নিয়ে প্রশ্ন ওঠতেই পারে। শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, সিভিল সার্ভিসে বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। সরকার দু-একটি ক্যাডারকে প্রাধান্য দিচ্ছে। যথার্থই বলেছেন তিনি। সরকার প্রশাসন ক্যাডারকে যেহারে তোষণ করে চলেছে তার কারণ ওই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। একতরফা নির্বাচনের বৈতরণী পার করতে সহায়তা করার পুরস্কার সরকার বেশিই দিয়ে দিচ্ছে। এর ফলও পাবে সরকার। মঙ্গলবাবের সমাবেশে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করলে জাতি আরো খুশি হতো। তবে ওই বিচার নিয়ে এতদিন যে অভিযোগ করে এসেছেন খালেদা জিয়া এবার তা না করেও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। আর মঙ্গলবারের সমাবেশের সৌন্দর্য্যের অন্যতম দিকটি হলো- এটি ছিল সম্পূর্ণ রাজাকারমুক্ত একটি সমাবেশ। এইচআর/পিআর
Advertisement