মো. হারুনুর রশিদ ৩৮তম বিসিএসে রেলওয়ে (পরিবহন ও বাণিজ্যিক) ক্যাডারে উত্তীর্ণ হন। তার জন্ম নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলায়। বাবা মো. মজিবুল হক চাকরিজীবী ছিলেন। মা জুলেখা বেগম গৃহিণী। হারুন ২০০৬ সালে নোয়াখালীর ছাতারপাইয়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০০৮ সালে নোয়াখালীর চৌমুহনী সরকারি এস এ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
Advertisement
বর্তমানে তিনি রেলওয়ে প্রশিক্ষণ একাডেমিতে প্রশিক্ষণরত। সম্প্রতি তার বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: আপনার শৈশবের গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই— হারুনুর রশিদ: আমার শৈশবের একটি অংশ কেটেছে রংপুরের শ্যামপুর সুগার মিলস কোয়ার্টারে। বাবার চাকরিসূত্রে আমরা সেখানে ছিলাম। পরে নোয়াখালী গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। সেখানেই আমার হাইস্কুল আর কলেজ। গ্রামের ছেলেরা যেভাবে মাঠে-ঘাটে দৌড়ে দাপিয়ে শৈশব কাটায়, আমার বেলায়ও তেমনটি হয়েছে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা বিশেষ করে ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁক ছিল অনেক বেশি।
জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?হারুনুর রশিদ: আমি যেহেতু নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি, জীবনে বাধা-বিপত্তি খুবই স্বাভাবিক ছিল। তবে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেয়েছিলাম প্রথমবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে। গ্রাম থেকে ঢাকায় কোচিং করতে গিয়েছিলাম। কোনো ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষায় টিকিনি। এলাকায় ভালো ছাত্রের তকমা লাগা ছেলেটির ও তার পরিবারের কাছে বিষয়টি ছিল হতাশাজনক! শেষে বাড়ি না ফিরে ঢাকার দৈনিক বাংলা মোড়ে একটি কম্পিউটার এক্সেসরিজ দোকানে চাকরি নিলাম। চাকরির পারিশ্রমিক ছিল আমার মেস খরচ মেটানো আর সপ্তাহে ২০০ টাকা! প্রথম ৬ মাস কাজ শেখাবে বলে এ ব্যবস্থা। সেখানে থেকেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। ধরে নিয়েছিলাম এভাবেই হয়তো চাকরির সঙ্গে টেনেটুনে পড়াশোনা চলবে। মাস চারেক চাকরি করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এলাকার এক বড় ভাইয়ের সহায়তায় টিউশন ম্যানেজ করে চাকরি ছেড়ে আবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হতে পারলে জীবনের গল্পটা হয়তো অন্যরকম হতো।
Advertisement
জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে? হারুনুর রশিদ: একেবারে ছোটবেলায় এ স্বপ্ন দেখেছি এমনটা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার শেষদিকে এসে বিসিএস ক্যাডার হতে চেয়েছি।
জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি নিয়েছেন কীভাবে? হারুনুর রশিদ: আসলে পড়াশোনা শেষ করে বিসিএস ক্যাডার হব, এমন চিন্তা-ভাবনা ছিল না। আমি চেয়েছিলাম ব্যাংকার হতে। এর পেছনের অবশ্য কারণ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মনে হতো বিসিএস ক্যাডার হওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। পরে অনার্স ৩য় বর্ষের শেষদিকে এসে আমার কয়েকজন কাছের বড় ভাইকে (বিশ্ববিদ্যালয়ের) বিসিএস ক্যাডার হতে দেখে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। তারপর থেকেই মূলত বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। অনার্স পরীক্ষার কিছুদিন পরই ৩৭তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ছিল। প্রথমবারের চেষ্টায় প্রিলি পাস করি। লিখিত পরীক্ষার জন্য হাতে সময় ছিল মাত্র তিন মাসের মতো! নতুন বিপত্তি ঘটলো মাস্টার্স পরীক্ষা নিয়ে। মাস্টার্স পরীক্ষার মাত্র ১৫ দিন পরই লিখিত পরীক্ষা ছিল। সে যাত্রায়ও বেঁচে গেলাম। ভাইবার মাত্র ৬ দিন আগে বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনে (বিএইচবিএফসি) সিনিয়র অফিসারের চাকরি পাই। যা আমাকে আত্মবিশ্বাস নিয়ে ভাইবা বোর্ডে যেতে সাহায্য করেছে। ৩৭তম বিসিএসে আমি বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে যোগদান করি। যোগদানের আগেই ৩৮তম বিসিএসের প্রিলি এবং লিখিত পরীক্ষায় পাস করি। যদিও বিএইচবিএফসিতে চাকরি করে লিখিত পরীক্ষা দিতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। যা হোক, সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় এবং নিজের চেষ্টার বদৌলতে ৩৮তম বিসিএসে রেলওয়ে (পরিবহন ও বাণিজ্যিক) ক্যাডারে নিয়োগ পাই।
জাগো নিউজ: পর্দার আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে?হারুনুর রশিদ: আসলে আমার পরিবার সব সময়ই আমার সঙ্গে ছিল। আলাদা করে বলতে গেলে, আমার বাবা এবং বড় বোনের কথা বলতে হবে। আমার বাবা নিজে পড়াশোনা করেও দুর্ভাগ্যক্রমে তার কর্মজীবনকে সেভাবে সাজাতে পারেননি। তাই তিনি চাইতেন আমি যেন ভলো কিছু করি। আর আমার বড় বোন সব সময় আমাকে উৎসাহ জোগাতেন।
জাগো নিউজ: নতুনরা বিসিএস প্রিলির জন্য কীভাবে প্রস্তুতি শুরু করবেন?হারুনুর রশিদ: বিসিএস প্রিলির প্রস্তুতি একেক জনের জন্য একেক রকম। নতুনদের ক্ষেত্রে করণীয় হলো বিসিএস প্রিলির সিলেবাস ধরে কোন কোন বিষয়ে নিজের শক্তিমত্তা এবং দুর্বলতা আছে তা খুঁজে বের করা। তারপর যে সব বিষয়ে শক্তিমত্তা আছে বলে মনে হয়, তা যাচাই করতে বিগত বছরের প্রশ্ন সম্বলিত একটি বই সংগ্রহ করে মডেল টেস্ট দিয়ে নিশ্চিত হওয়া। বিষয়ভিত্তিক প্রস্তুতির জন্য যে কোনো প্রকাশনীর এক সেট বই সংগ্রহ করতে হবে। বাংলা ব্যাকরণ অংশের জন্য সিলেবাসের নির্ধারিত অধ্যায়গুলো, ৯ম-১০ম শ্রেণির ব্যাকরণ বই বা ভালো লেখকের বই থেকে পড়া যেতে পারে। আধুনিক সাহিত্য অংশের জন্য যে কোনো প্রকাশনীর বই, প্রাচীন ও মধ্যযুগ অংশের জন্য ভালো বই পড়া যেতে পারে। ইংরেজি ব্যাকরণ অংশের জন্য টোফেল খুবই কার্যকর। পাশাপাশি শব্দভান্ডারের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কাজ করতে হবে। গণিতের জন্য ৯ম-১০ম শ্রেণির সাধারণ গণিত ও উচ্চতর গণিত থেকে সিলেবাস নির্ধারিত অধ্যায়ভিত্তিক সমাধান শক্ত ভিত্তি তৈরি করে দেবে। গণিতে দুর্বলতা থাকলে তা কাটিয়ে ওঠার জন্য বারবার অনুশীলন করতে হবে। বাংলাদেশ বিষয়াবলী ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর জন্য বইয়ের পাশাপাশি দৈনিক পত্রিকার তথ্য ও সম্পাদকীয় ভালোভাবে পড়তে হবে। সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধ অংশ খুব গুরুত্ব দিয়ে পড়তে হবে। দৈনন্দিন বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং কম্পিউটার অংশের জন্য বইয়ের পাশাপাশি আপডেট তথ্য রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে গৎবাঁধা পড়াশোনা না করে কৌশলী হয়ে পড়লে প্রিলির বাছাই পরীক্ষায় সহজে পাস করা যায়।
Advertisement
জাগো নিউজ: প্রিলি শেষ করার পর বিসিএস লিখিত প্রস্তুতি নিয়ে আপনার পরামর্শ কী?হারুনুর রশিদ: প্রিলি পাস করার পর লিখিত পরীক্ষার জন্য হাতে সময় খুব কম পাওয়া যায়। প্রিলির পড়ার সাথে সাথেই গণিতের শর্টকাট না করে নিয়ম শিখে নিলে তা লিখিত পরীক্ষায় কাজে দেয়। একইভাবে বাংলাদেশ বিষয়াবলী ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর প্রিলির তথ্যমূলক পড়া লিখিত পরীক্ষায় সহায়তা করে। প্রিলির সময়ই সংবিধান ভালোভাবে পড়লে তা সময় বাঁচিয়ে দেয়। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ অংশের জন্য আলাদা করে রেফারেন্স বই পড়তে হবে। নিয়মিত পত্রিকা ও সম্পাদকীয় পড়লে বাংলা, ইংরেজি রচনা, বাংলাদেশ বিষয়াবলী ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর প্রস্তুতি অনেকখানি হয়ে যায়। সর্বোপরি একজন চাকরিপ্রার্থী হিসেবে নিজের মেধা মনন ও একাগ্রতার মেলবন্ধনই তাকে সফলভাবে দেশের এ সর্বোচ্চ চাকরির পরীক্ষায় সফল করতে পারে।
জাগো নিউজ: বিসিএস ভাইবার প্রস্তুতি কেমন হতে হয়? হারুনুর রশিদ: ভাইবার জন্য কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। ক্যাডার চয়েজ অনুযায়ী প্রথম দুটি ক্যাডারের চাকরির বিষয়ে একজন চাকরিপ্রার্থী হিসেবে যতটুকু জানা সম্ভব জানতে হবে। সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধ ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে জানতে হবে। অনার্সে নিজের পঠিত বিষয় সম্পর্কে বেসিক তথ্য মাথায় রাখতে হবে। ভাইভা বোর্ডে সুন্দরভাবে নিজেকে উপস্থাপন করা, মার্জিত বাচনভঙ্গি ও সুন্দর আচরণ করা। এ কয়েকটি বিষয়ের ওপর নজর রাখলে একজন চাকরিপ্রার্থী ভাইবা বোর্ডে ভালো করবে বলে আশা করা যায়।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?হারুনুর রশিদ: রেল যেহেতু একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান, তাই জনগণ যাতে এ সেবা সঠিকভাবে পায়; তার জন্য প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী হিসেবে নিজের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টাই করবো। রেলযোগাযোগকে আধুনিক ও জনবান্ধব করার জন্য সরকারের নির্দেশনায় বাংলাদেশ রেলওয়ে যে কাজ করছে, তার অংশ হিসেবে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করব।
এসইউ/জেআইএম