আমরা যা কিছু নতুন করতে চাই তার মান বা উচ্চতাকে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চাই। এই চাওয়াটা আমাদের ঘাটতিকে উঁচুতে তুলে আনার এক অনন্য স্বপ্নের আশা থেকে জাত হয়েছে। তার মানে আমরা স্বপ্ন দেখতে জানি এবং আমরা সেই সব স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টাও করি। সে-সব চেষ্টার বেশকিছু প্রকল্পের রূপায়ণ হয়েছে/হচ্ছে এবং আরও কিছু স্বপ্নে কাজ হাতে নিচ্ছে সরকার এবং সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও।
Advertisement
এই যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক ওয়াদাদানকারীদের বাইরে থেকে নিজেদের ব্যক্তিগত প্রণোদনায়-উদ্যোগে গড়ে তুলতে চাইছে এমন কিছু সেবাদানের প্রকল্প, যা আমাদের ধনবান ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের চেতনায় ছিল। বেসরকারি স্তর থেকেও যে ধনবান না হয়েও যে সেবাদানের আয়োজন করা যায় বোধহয় তার প্রথম ও প্রধান প্রণোদনাকারীর নাম ডা. ইবরাহিম, যিনি দেশের প্রথম স্বাপ্নিক—ডায়াবেটিস হাসপাতাল সৃষ্টি করে দেখিয়েছেন যে স্বপ্ন রচনায় অর্থ প্রয়োজন হয় বটে, তবে অর্থ ছাড়াও ইচ্ছা ও প্রবল আকাঙক্ষা বাস্তবায়নে সব থেকে বেশি প্রয়োজন।
ডা. ইবরাহিম পল্টনে, তার বাসার সামনেই শুরু করেছিলেন একটি টিনের শেডবাড়িতে ডায়াবেটিক সমিতির ছোট হাসপাতাল। তার ওই অনন্য সাধারণ প্রণোদনায় এগিয়ে এসেছিল তৎকালীন সরকার। ডায়াবেটিক সমিতির জন্য জমি বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার শাহবাগে আজকের ইবরাহিম কার্ডিয়াক ও মেডিকেল কলেজের জন্য।
তবে, আজ ব্যবসায়িক অনেক প্রতিষ্ঠানই চিকিৎসাসেবার প্রতিষ্ঠান করেছে রাজধানীতে, রাজধানীর বাইরে, প্রত্যন্ত এলাকায়, কিশোরগঞ্জে প্রয়াত জহিরুল ইসলাম, পাবনায় অন্য একজন মানবসেবক। তার নাম এখন মনে পড়ছে না বটে, তবে সেই প্রত্যন্ত এলাকায় হাসপাতাল করে জনদরদীর ভূমিকা পালন করছেন। জহিরুল ইসলাম মূলত রিয়েলটর হিসেবে, ঢাকা মহানগরীর প্রথম ও প্রধান পরিকল্পিত নগরায়ণের রূপকার।
Advertisement
ঢাকা সিটির জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ যা করেছে, তার চেয়ে অবদানের দিক থেকে জহিরুল ইসলামকে অগ্রগামী বলেই মনে হয়। রাজউক রাজধানীর সিটির প্ল্যান করেছে, কিন্তু তাকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। যে কারণে মহানগর ঢাকা আজ ঘিঞ্জি হিসেবে পৃথিবীর নগর বিশেষজ্ঞদের কাছে পরিচিত।
ঢাকার ওই দুর্ভাগ্যের ভেতরে থেকেও জহিরুল ইসলাম নগরায়ণে সুবাতাস বইয়ে দিয়েছেন। ব্যবসার সঙ্গে তিনি মিশিয়েছেন পরিকল্পিত নগরায়ণের শোভা ও সৌন্দর্য। তবে তিনি চিরবিদায় নেওয়ার পর পরবর্তী জেনারেশন সেবা ও সৌন্দর্যকে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার করে ফেলেছে। পরিকল্পিত নগরের ভেতরে যেসব মানবিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের জন্য জায়গা রাখা হয়েছিল মূল ডিজাইনে, তা বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে ব্যক্তির কাছে। প্রতিটি প্রকল্পেই এটা ঘটেছে। স্কুল, খেলার মাঠ, কমিউনিটি সেন্টার, মসজিদ, মন্দির নির্মাণের জায়গা রেখেও তা বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
এ সমস্যা-সংকট কেবল ইস্টার্ন হাউজিংয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, তা ছড়িয়ে পড়েছে পরবর্তীতে এই হাউজিং ব্যবসায়ে জড়িত কোম্পানিগুলোতে। তারা টাকা উপার্জনকেই প্রধান করেছে, সেবা ও ইস্টার্ন এবং বসতিদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশের পথকে রুদ্ধ করে দিয়ে। এটা কিন্তু হৃদয়বিদারক। এগুলোর দেখভালের দায়িত্ব রাজউকের। কিন্তু রাজউকের কর্তারা যে লোভের অধঃস্তন, তার বহু প্রমাণ প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় মিলবে। এজন্য বিশেষ উদাহরণের দরকার নেই।
ঢাকা ৪০০ বছরের পুরোনো নগর হলেও আজও ক্রমবর্ধমান। এখনো কোনো কোনো এলাকা পরিকল্পনাকে তোয়াক্কা না করে বাড়িঘর, দালানকোঠা উঠছে এবং তা অনুমোদন দিচ্ছে রাজউক। এর চেয়ে খারাপ আর কি হতে পারে একটি রাজধানী মহানগরের জন্য? ব্যবসায়িক বিষয়টিকে মাথায় রেখেও যে মানুষ সেবার লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন করেন তা আমরা ঢাকায় দেখছি।
Advertisement
ব্যবসা ও সেবাপণ্য হিসেবে তাদের হাসপাতালগুলোয় বিনিয়োগ করলেও এই সত্য সেই সব উদ্যোগে আছে, যা মানুষের চিকিৎসায় নিবেদিত। তাকে/তাদের স্যালুট জানানো উচিত। তবে গণমানুষের জন্য সে সব হাসপাতাল নয়, তা প্রমাণ করেছেন তারা। ঢাকার বাইরে যেসব হাসপাতাল বেসরকারিভাবে হয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে চিকিৎসাসেবার সঙ্গে ব্যবসা। তবে মানবিকতার বিষয়টি একেবারে ভূলুণ্ঠিত নয়, তাদের চেতনায় সেবার স্পর্শও আছে, যা আমরা চাই। মানুষের প্রতি ভালোবাসা দেখানোর বহু পথ আছে, তবে চিকিৎসাসেবার তুলনা তার মধ্যে প্রধান, তাতে কোনো ভুল নেই।
ঢাকা মহানগরের বাইরে, জেনারেল হাসপাতাল, ক্যানসার হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট, মেডিকেল কলেজ ও ইনস্টিটিউট ও ডরমিটরি, ইংলিশ স্কুল, খেলার মাঠসহ গোটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি হবে আন্তর্জাতিক মানের। তারই একটি পরিকল্পনার ভিত্তি স্থাপিত হলো ঢাকার অদূরে, নবাবগঞ্জ থানার চুরাইন ইউনিয়নের চুরাইন গ্রামে সেলিনা নূর–বাডাস স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স শিরোনামে। উদ্যোক্তা হিসেবে আছেন ইউনিক গ্রুপের এমডি মোহাম্মদ নূর আলী ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি।
মোহাম্মদ নূর আলী তার বক্তব্যে জানিয়েছেন, ইউনিক গ্রুপের চেয়ারপারসন মিসেস সেলিনা আলী কমপ্লেক্সের জন্য ২৫ বিঘা জমি দান করেছেন। সেখানেই গড়ে তালা হবে এই কমপ্লেক্সটি। কি কি থাকবে সেখানে। তার রূপরেখাও বলেছেন তিনি। তার এ উদ্যোগের সঙ্গে আছেন বারডেমের সহযোগ। জাতীয় অধ্যাপক আজাদ খানও ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে এই সেবা-উন্নয়ন পরিকল্পনায় যুক্ত হয়ে তার সেবাধর্মের পরিচয়কে নতুনমাত্রায় নিয়ে এলেন। ভিত্তিস্থাপন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সাবেক সচিব ও ইউনিক গ্রুপের উপদেষ্টা ড. খোন্দকার শওকত হোসেন।
আমি দেখতে পেলাম, নূর আলী সাহেব বলেছেন সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্যই বিশ্বমানের এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আয়োজন তারা করেছেন। কী কী থাকবে ওই বিশ্বমানের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে? মি. নূর আলী বলেছেন, এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থাকবে ১ হাজার শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, ২০০ শয্যাবিশিষ্ট ক্যানসার হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট ও ডরমিটরি। এছাড়া থাকবে একটি মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউট, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও খেলার মাঠ।
এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে ‘সেলিনা নূর-বাডাস ট্রাস্ট’। আগামী তিন বছরের মধ্যে সাধারণের জন্য আউটডোর চালু হবে। ৮ বছরের মধ্যে পুরো কমপ্লেক্স নির্মাণ সম্পন্ন হবে। কাজে বিলম্বের কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন মি. নূর আলী। আমার সহধর্মিণী ইউনিক গ্রুপের চেয়ারপারসন সেলিনা আলী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জন্য জমি চাইতেই ২৫ বিঘা দান করে দিয়েছেন। এই জমিতে সংকুলান না হলে আরও জমি দেবেন তিনি। বিশ্বমানের সুযোগ-সুবিধাসহ এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। তিনি বলেন, নবাবগঞ্জের মাটিতে আমার অনেক ঋণ রয়েছে, এই কমপ্লেক্সের মাধ্যমে তার কিছুটা শোধ করার চেষ্টা করছি।
সেলিনা নূর-বাডাস স্ট্রাস্টের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। প্রতিষ্ঠানটি প্রাক্কলিত সময়ের মধ্যে নির্মিত হোক এটা যেমন আমরা চাই, তেমনি গ্রামের হতদরিদ্র মানুষ যেন স্বাস্থ্যসেবা পায় কমমূল্যে ও বিনামূল্যে সেটা যদি ট্রাস্ট নিশ্চিত করতে পারে, তাহলেই উদ্যোক্তাদের সেবার মনোভাব দেশময় ছড়িয়ে পড়বে। এই প্রয়াসের মাধ্যমে দেশের আরও ব্যবসায়িক গ্রুপের চেতনায় এই রকম মানবসেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রেরণা জাগুক, এটাই আমাদের লক্ষ্য। কারণ ১৭ কোটি মানুষের দেশের ৭০ শতাংশের জন্যই স্বাস্থ্যসেবা জরুরি বিষয়।
এদের মধ্যে অধিকাংশই গরিব মানুষ, যাদের সামর্থ্য নেই চিকিৎসাসেবা কেনার। তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে বলেই মনে করি আমরা। সত্যিকার সেবা সেখানেই নিহিত। আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাসেবা দিতে পারলে ধনবানরা তার সুযোগ দেশেই নিতে পারবে। এমনকি বিদেশের যারা চিকিৎসা নিতে আসবে, তাদের চিকিৎসাসেবার জন্য ভালো কিছু রাখতে হবে। যাতে কমপ্লেক্সের ব্যয়ভার বহন সম্ভব হয়।
মান কল্যাণ ও সেবাই যেন সেলিনা নূর-বাডাস স্ট্রাস্টের মৌলিক কর্ম ও দৃষ্টিভঙ্গি হয়, সেটাই আমরা আশা করি। তাদের সেবা-কাজ যেন দেশময় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, অন্য উদ্যোক্তাদের প্রণোদিত করতে পারে, মানবসেবা ও কল্যাণের দিগন্ত রচিত হয়— এটাই দেশের সাধারণের প্রত্যাশা।
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম