সবুজ মোড়কে বাঁধানো ফেলে আসা হিরন্ময় দিনগুলো—চোখ বন্ধ করলে যেন দেখতে পাই। যেন সোনার কাঠি-রুপোর কাঠির ছোঁয়ায় জেগে ওঠা মনের আড়ালে থাকা সূর্যের ঝকমকে রুপালি রেখা! হারিয়ে ফেলা দিনকে মনে হয় সুঁতা ছিড়ে যাওয়া রঙ-বেরঙের ঘুড়ির মতো নীল আকাশে মিশে আছে। কখনো মনে হয়, দিগন্ত রেখা স্পর্শ করে কোনো একখানে জমা আছে আমার হিরন্ময় দিনগুলো।
Advertisement
মানুষ স্মৃতিকে আশ্রয় করে নিজেকে খোঁজে। আমিও। কখনো স্মৃতি রোমন্থনে নিমগ্নতায় ডুবে যেতে ইচ্ছে করে। নিজের মনে নিজেই কথা বলি। জীবনেরই অন্যতম নান্দনিক দিনের কথা—পরিচিত রূপকথা না হলেও তা ঝকঝকে সোনা-রুপার ছোঁয়ায় জীবনের কথা। কী রেখে কী বলি? কোনটা বলতে গিয়ে কোনটাকে হারিয়ে ফেলি। আমার সব কথাই মানুষ আর প্রকৃতি নিয়ে।
আমার জন্ম স্বাধীন দেশে। জন্মের কিছু সময় আগে, পৃথিবীর মানচিত্রে পূর্ব পাকিস্তানের নতুন পরিচয় হয় স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’। সে দেশেরই একটি ছোট্ট জনপদ কিশোরগঞ্জে আমার জন্ম।
বাংলার শিল্প-সাহিত্য বিশেষতঃ লোকসাহিত্যের তীর্থভূমি কিশোরগঞ্জ। ষোড়শ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী, মহাকবি ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’র অনুবাদক কবি-মনীষী মনিরুদ্দীন ইউসুফ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, নীরদচন্দ্র চৌধুরী, অস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের বাবা শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায়, পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের কিংবদন্তি নেতৃত্ব ‘মসনদ-ই-আলা’ দেওয়ান ঈশা খাঁর গর্বিত ইতিহাসের পাদপীঠ কিশোরগঞ্জ।
Advertisement
বাবার মুখে কিংবদন্তিদের গল্প শুনে অথবা বইয়ের পাতায় তাঁদের নাম দেখে মনে মনে গোপন অহংকার অনুভব করতাম। ‘চন্দ্রাবতী’ গীতিনাট্য উপস্থাপনার সময় কল্পনার চোখে ভেসে উঠতো কবি চন্দ্রাবতী আর শিবমন্দিরের অবয়ব। আমাদের যে ঘরটিতে আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে, তারও একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ১৯৭০-এর নির্বাচনী কার্যালয় ছিল ঘরটি। আমার ঘরটি তাই শুধু ইটের কাঠামো নয়, ইতিহাসেরও অংশ। আমার ঘরটি আমার শৈশব, আমার বেড়ে ওঠা, স্বপ্নের পাখা মেলার অবাক সুন্দর প্রিয়তম এক নীড়।
আমি জন্মেছিলাম বিস্তৃর্ণ নিকলী হাওরের একটি গ্রামের তরুপল্লবের ছায়ায় কাঠের দোতলার পেছনে থাকা উত্তরে ভিটের এক ঘরে। আমাদের ছিল যৌথ পরিবারের ঐতিহ্য। আমার দুই দাদা একই বাড়ির পাশাপাশি দুই অংশে বসবাস করতে শুরু করেন। বিক্রমপুরের মিস্ত্রীরা নির্মাণ করেছিলেন কাঠের আর টিনের দোতলা ঘর, বৈঠকখানা, গোলাঘরসহ উত্তরের ভিটের বসতঘর। ঘরের বিভিন্ন আসবাবপত্র কাঠের আলমারি, টেবিল, পালঙ্কটিতে ছিল বিক্রমপুরের প্রথাগত শৈল্পিক নকশা। ঘরে রাখা লোহার সিন্দুকটি দাদা কিনেছিলেন বার্মা থেকে।
দুই প্রস্থের বাড়ির বাইরের অঙ্গনের খালি জায়গায় বাঁশের লম্বা সাঁকোতে সারাবছরই গ্রামবাসীর ভিড় লেগে থাকত। সামনের হাওর থেকে বয়ে যাওয়া হু-হু বাতাসে চলতো অলস সময়ের গল্প-আড্ডা। কখনো বা পুঁথি পাঠ অথবা কবিগানের আসর।
রাতে অনেক সময় পর্যন্ত জেগে থাকলে কখনো দোতলা ঘরের জানালা দিয়ে রুপালি চাঁদের জোসনার ফুল হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতাম। দিনের প্রথম আলোয় আলসেমিতে ঘুম জড়ানো চোখে তাকালে সাদা-কালো রঙের দোয়েল পাখি চোখে পড়ত। খয়েরি-হলুদের মিশেলে শালিক, কালো-লালে বুলবুলি, ছোট্ট চড়ুই পাখি উড়ে গাছের ডালে এসে বসত।
Advertisement
কিছুটা বড় হওয়ার পর গ্রামের বাড়ি থেকে চলে আসি কিশোরগঞ্জ শহরে রেলস্টেশনের কাছে। সাদা প্রাচীরে ঘেরা হলুদ রঙের পুরোনো একটি দালান কেনেন আমার বাবা আর চাচা। শুরু হয় আমাদের পড়াশোনার পর্ব—আমার স্কুলজীবন। তবে স্থায়ীভাবে গ্রাম ছেড়ে নয়। মাঝেমধ্যে স্কুলের বিভিন্ন ছুটিতে চলে যেতাম বাবার সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে। হাওর এলাকা হওয়ার কারণে শুকনো মৌসুমে সদর জেলার বাড়ি থেকে গ্রামের বাড়ি আসা-যাওয়ার জন্য কয়েক কিলোমিটার হাঁটতে হতো।
আমাদের নিকলির হাওর ‘বড় হাওর’ নামেই পরিচিত। কিশোরগঞ্জের ভূপ্রকৃতি আর ঐতিহ্যের একটি আকর্ষণীয় দিক হাওর। মূলত সাগর শব্দের অপভ্রংশ মাত্র হাওর। উচ্চারণ বিকৃতিতে সাগর থেকে সায়র এবং সায়র থেকে হাওর হয়েছে বলে মনে করা হয়ে থাকে। বর্ষাকালে বড় হাওরে নৌকা ভাসালে মনে হয় অকূল দরিয়া পার হতে হচ্ছে। কূল নাই, কিনারা নাই, শুধু অশান্ত ঢেউ ওঠানামা করছে বিরামহীনভাবে। ভোরে যখন সূর্য উঠছে, তখন এই ঢেউয়ের দোলায় মনে হবে রক্তলাল সূর্য একবার পানির নিচে ডুবছে, আবার ভেসে উঠছে।
বর্ষাকালে হাওর এলাকায় অবস্থিত গ্রামগুলোকে দূর থেকে ছোট ছোট দ্বীপের মতো মনে হয়। মনে হয় যেন হাওরের পানিতে ভাসছে সেইসব গ্রাম। চাঁদনী রাতে জ্যোৎস্নার আলোর সঙ্গে ঢেউয়ের মাতামাতি দেখলে নয়ন জুড়িয়ে যায়। বর্ষাকালে হাওরে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত। এ সময় হাওরে চলাচল করে শত শত নৌকা। বর্ষাকালে হাওর এলাকার বাসিন্দাদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা এমনকি জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র বাহন। অন্য সময়ে পায়ে হেঁটে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হয়।
খুব ছোটবেলায় বাসার কাছে নিউ টাউন সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পাঠ নিতে শুরু করি। বাসায় হাতেখড়ি হয় শিক্ষক বুলিদির হাতে। এভাবেই সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেরিয়ে এসেছি স্কুলের আঙিনা ছেড়ে কলেজ। কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈশব্দের অঙ্গনে এসে আমার লেখালেখি আবারো শুরু হয়। সবুজ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাট অঙ্গনের বৈচিত্র্য, নিসর্গকে উপভোগ করার সুযোগ পেলাম নতুন করে। ক্যাম্পাসের ভোর, লেকের পাড়ে বসে পূর্ণিমায় রুপালি চাঁদ ওঠা দেখা, হলের ঝাউগাছ আর রেইন্ট্রির পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো-আঁধারীতে নকশাকাটা রূপ, ঘরের জানালা দিয়ে ছুটির দিনের অলস দুপুরে ঝরাপাতার শব্দে যেন ভেতরের শব্দকে খুঁজে পেতাম।
ক্যাম্পাসের বৃষ্টি, বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে হলে ফেরা। ঝড়ের দিনে বাতাসে ঝাউয়ের পাতার শোঁ-শোঁ শব্দ যেন সমুদ্রসৈকতে ঢেউয়ের গর্জন। ঝকঝকা শীতের সকালে মিষ্টি রোদে লেকের জলে সবুজ লতা-পাতার জালে লাল শাপলার মিছিল। শীত, হেমন্ত বা বসন্তে হিমালয়ের ওপাশ থেকে, দূরপ্রাচ্য থেকে উড়ে আসা অতিথি পাখির লাল শাপলা আর সবুজ পাতার মধ্যে লুকোচুরি খেলা—পানকৌড়ির মতো যেন চুপচাপ দেয় ডুব। আমিও যেন কুড়িয়ে পাই আমার বর্ণময় শৈশব। দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা শৈশবের হারিয়ে যাওয়া অবয়বকে যেন বিভিন্ন রূপে দেখতে পাই।
নদী, ঝরনা, পাহাড়, সন্ধ্যার আকাশ, আকাশ ভরা তারা, স্নিগ্ধ ঝকঝকে পূর্ণিমা, শরতের আকাশ আর স্নিগ্ধ ভোর নিয়ে। ঝরা সাদা শিউলি ফুল সবুজ ঘাসে বিছিয়ে থাকা, দিগন্ত জোড়া কাশবন, হেমন্তের বাতাসে পাকা ধানের ঘ্রাণ, শীতের কুয়াশা জড়ানো সবুজ দূর্বা ঘাসের ডগায় সাদা মুক্তোর মতো শিশির বিন্দুকে নিয়ে।
ক্যাম্পাসের প্রতিটি গাছ, গাছের পাতা, লেকের টলটলে কাকচক্ষুর মতো স্বচ্ছ পানি, লাল রঙের শাপলা ফুল, রং-বেরঙের প্রজাপতি, পরিযায়ী পাখি সব কিছুর সঙ্গেই যেন আমার গভীর বন্ধুত্ব। ক্যাম্পাসের সকালের আলোর প্রতিটি ছায়া, পূর্ণিমা রাতে জ্যোৎস্নার রুপালি স্নিগ্ধ আলো, মহুয়ার মাতাল সৌরভ আমি অনুভব করি, অনুভব করব সমস্ত সত্তাজুড়ে।
শুধু মাঝেমধ্যে মাথার ভেতরটা একেবারে ফাঁকা মাঠ হয়ে যায়। আনমনে ঘুরেফিরে আসে রবীন্দ্রনাথের গান—‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে।’ সেই গানের সুর ধরে একে একে ফিরে আসে প্রিয় বন্ধুদের মুখ; শাহিন, লিটু, সারোয়ার, দীপু, স্বপন—যেন স্বপ্নলোকের নক্ষত্র, একেকটি ঝরাপাতা, সবুজ পাতার দলকে বিদায় জানিয়ে দলচ্যুত হয়ে অকালে খসে পড়েছে পত্রপল্লবময় বৃক্ষ থেকে। তারপর ছিন্নভিন্ন হয়ে বিলীন হয়ে গেছে মহাকালের অতল শূন্যতায়। একদম ফাঁকা, নির্জন। কে আর স্মৃতির ভেতর সযত্নে পুষে রেখেছে তাদের, হাতেগোনা সুজন বন্ধু-স্বজন ছাড়া?
লেখক: গবেষক ও পরিবেশবিদ।
এসইউ/জিকেএস