মতামত

নাসিক নির্বাচন : বর্জন নাকি অর্জন?

সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘিরে আজ দেশবাসীর মনোযোগ নারায়ণগঞ্জে। জাতীয় নির্বাচনের দুই বছর আগে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তাছাড়া ঢাকার অদূরে বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জের গুরুত্ব রয়েছে নানা দিক থেকেই। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে। নতুন কমিশন গঠন করার জন্য সার্চ কমিটি হবে। রাষ্ট্রপতির সংলাপ চলছে এ উপলক্ষে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো এতে আমন্ত্রণ পেয়ে অংশ নিচ্ছে। এছাড়া পুরো নির্বাচন হচ্ছে ইভিএমে।

Advertisement

পরিপ্রেক্ষিত যখন এই তখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে নাসিক নির্বাচন। সুতরাং অনেক হিসাব-নিকেশের জবাব পাওয়া যাবে এই নির্বাচনে। নির্বাচনে ছয়জন মেয়র, সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডে ৩৪ জন এবং সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ১৪৫ জনসহ মোট ১৮৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছেন। তবে আলোচনা কেবল প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকা প্রতীকের ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং স্বতন্ত্রপ্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকে নিয়ে। তৈমূর লড়ছেন হাতি প্রতীকে।

নির্বাচনে এই বিএনপি নেতার অংশগ্রহণ অনেকটাই নাটকীয়। তিনি হঠাৎ করেই প্রার্থী হয়েছেন। বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে সব স্থানীয় নির্বাচন বর্জন করেছে। কাজেই দলীয় নেতা হিসেবে তার এই নির্বাচনে অংশ নেওয়া সম্ভব ছিল না। সে কাজটি অবশ্য দলই সহজ করে দিয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা থেকে শুরু করে সব ধরনের দলীয় পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তিনি নিজেই দাবি করেছেন এখন তিনি মুক্ত। তবে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের বিএনপি নেতারা তৈমূরের নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়েছেন।

দল থেকে অব্যাহতি কিংবা দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন না করাটা তৈমূরের নির্বাচনী কৌশল হিসেবে বলছেন অনেকেই। বিএনপিও এটা কৌশল হিসেবেই নিয়েছে। অন্যদিকে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী আওয়ামী লীগের সমর্থনে নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়ছেন। দলীয় নেতাকর্মীরা তার নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়েছেন। তিনি বর্তমান মেয়র। নির্বাচনে ভোটাররা তার ‘মেয়রকাল’কেও বিচেনায় নেবেন।

Advertisement

অন্যদিকে অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারও শক্ত প্রার্থী। যদিও এর আগে বিএনপির হয়ে নির্বাচন করে দলীয় আদেশে তিনি মধ্যরাতে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। এবার তিনি সরে যাবেন না- এমন একটি আস্থা তৈরির জন্যও স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন। যাতে দল তাকে প্রভাবিত করে বসিয়ে দিতে না পারে। তিনি নির্বাচিত হলে কতটা কী করতে পারবেন- এ বিষয়গুলোও ভোটাররা তাদের পর্যবেক্ষণে রাখছেন।

নারায়ণঞ্জ সিটি নির্বাচনে অবধারিতভাবে এসেছে স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের নাম। তিনি তৈমূর নাকি আইভির- এটা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দেয়। একপর্যায়ে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। নারায়ণগঞ্জে কেন তাকে নিয়ে সবসময় আলোচনা হয় সে প্রশ্নও তিনি তোলেন। তিনি বলেন, তার অবস্থা অনেকটা গরিবের ভাবির মতো। এ বলে ওর, ও বলে তার। তিনি এটাও স্পষ্ট জানিয়ে দেন মার্কা যাই হোক নৌকার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

দুঃখজনক হচ্ছে, রাজনৈতিক নানা ডামাডোলে হারিয়ে গেছে নির্বাচনের মূল এজেন্ডা। নারায়ণগঞ্জ সিটির সমস্যা, সম্ভাবনা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা থেকে গেছে আলোচনার বাইরে। অথচ মূল বিষয় হওয়া উচিত ছিল কোন প্রার্থী নির্বাচিত হলে জনসেবা নিশ্চিত করতে তারা কী ধরনের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করবেন। স্থানীয় নির্বাচন হলেও দলীয় প্রতীকে হওয়ায় তা জাতীয় একটি রূপ ধারণ করে। ফলে স্থানীয় নির্বাচনের যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তা শেষ পর্যন্ত গতি হারায়।

তাছাড়া ভোটের মাঠে সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডে ৩৪ জন এবং সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ১৪৫ জনসহ মোট ১৮৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছেন। এই কাউন্সিলররাও নেই আলোচনায়। অথচ স্থানীয় পরিষদে তাদের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাউন্সিলরদের কারণেও নির্বাচনী মাঠ অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে ওঠে।

Advertisement

নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে সাত খুন মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নূর হোসেনের নামও আলোচনায়। তার ভাই কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করছেন। কাশিমপুর কনডেম সেলে বসে তিনি মুঠোফোনে ভাইয়ের পক্ষে ভোট চেয়েছেন। হুমকি দিয়েছেন ভাই হারলে কাউকে কাউকে দেখে নেওয়ারও।

বলা যায় পরিস্থিতি বেশ উত্তাপ ছড়াচ্ছে মাঘের শীতে। আমাদের দেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে নির্বাচনের ফল মেনে নেওয়ার মানসিকতা নেই বললেই চলে। বিশেষ করে পরাজিত প্রার্থী ফল মানতে চান না। তাছাড়া নির্বাচন বর্জনও এখন একটি সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হওয়ায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার হিড়িক পড়েছে। নির্বাচনী ব্যবস্থায় আস্থা ফিরিয়ে এনে এ অবস্থার উত্তরণ জরুরি। আসলে বয়কট বর্জনের পথেও নয়, আবার যেনতেনভাবে জয়ী হওয়ার মধ্যেও কোনো অর্জন নেই। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বজায় রাখাই অত্যন্ত জরুরি।

প্রধান দুই প্রার্থীই নির্বাচন নিয়ে নানা শঙ্কার কথা বলছেন। অনেক কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর ও নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে হবে। নির্বাচন কমিশনকেও যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে।

নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার ব্যাপারে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, সমর্থক, ভোটার এবং প্রশাসনের সম্মিলিত ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নাসিক নির্বাচনে সব পক্ষই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে এবং নির্বাচনে জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটবে- এমনটিই দেখতে চাই।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। drharun.press@gmail.com

এইচআর/এএসএম