জাতীয়

সাকরাইনের একাল-সেকাল

এক সময় পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী উৎসব সাকরাইনের মূল আয়োজন ছিল বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ি ওড়ানোকে কেন্দ্র করে। এসময় ঢাকাইয়াদের বাড়িতে বাড়িতে চলতো পিঠাপুলির উৎসব। নানা ধরনের পিঠার সমাহারে সাজানো হতো থালা। আলুর পিঠা, মুগডালের পিঠা, মালপোয়া, পাটিসাপটা, তিলের পিঠা, চন্দ্রপুলি ছাড়াও থাকতো খই-বাতাসাসহ আরও অনেক কিছু।

Advertisement

এছাড়া উৎসব উদযাপনে রঙিন কাগজ কেটে ঝালর বানিয়ে কিংবা পাখি, ফুল আর নানা ধরনের আকৃতি বানিয়ে বাড়ির ছাদ, জানালা, বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখা হতো। পৌষ মাসের শেষ দিন এই উৎসব শুরু হয়ে শেষ হয় মাঘের প্রথম দিন।

পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন সারা দিন চলে ভেড়া-ভেড়ি (ভেড়ার ঘর) তৈরির কাজ। এতে লাগতো বাঁশ আর খড়। নির্ঘুম রাতকে আনন্দময় করে তুলতে আনুষঙ্গিক আরও অনেক আয়োজন করা হতো। মাংস রান্না করে খাওয়া, মাইক বাজিয়ে গান করা, ক্যাসেট প্লেয়ারে সারা রাত চলতো বিভিন্ন ধরনের গান। তখন এসপি-ফোর সাউন্ড সিস্টেম কিংবা এমপি-থ্রি মোবাইল ডিভাইস ছিল না। ক্যাসেট প্লেয়ারে গান চালিয়ে মাইক্রোফোন ধরে মাইকে গান করা হতো। এসব আনন্দের মধ্যে সামিল হতেন পুরান ঢাকার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই।

আতশবাজির সঙ্গে চলে আগুন খেলার এক দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড/ছবি: জাগো নিউজ

Advertisement

সংক্রান্তির দিন ভোরে উঠে (ভোর ৪টা) ঠান্ডা পানিতে স্নান (গোসল) সেরে নতুন কাপড় পড়ে সবাই গিয়ে আগুন জ্বালাতো ওই ভেড়ার ঘরে। বাড়ির আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই একসঙ্গে এসে আগুন পোহাতো। পৌষ মাসের শেষ দিন ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত চলতো প্রস্তুতি পর্ব। তারপর পিঠা খাওয়ার পালা। আগের দিন মা-কাকিরা বিকেল থেকে পিঠা তৈরি করতে বসতেন। বাবা-কাকারা বাজার থেকে রাতে বড় বড় মাছ নিয়ে আসতেন। পরদিন পাড়া-মহল্লায় সকালে সামাজিক কীর্তন পর্ব শেষে সারাদিন চলতো খাওয়ার পালা।

এভাবেই উদযাপিত হতো সাকরাইন উৎসব। ছিল না কোনো ডিজে নাচ-গান। আতশবাজির মতো রংচঙা আলোর দেখা মিলতো না। ছিল পুরান ঢাকার মানুষের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সম্প্রীতি আর তরুণ-তরুণীদের ঘুড়ি ওড়ানোর আনন্দ। বর্তমানে আতশবাজি আর ডিজে গানের বেড়াজালে বিলুপ্তপ্রায় সাকরাইনের যুগ যুগ ধরে চলে আসা সংস্কৃতি। ঐতিহ্যবাহী এমন সংস্কৃতির পরিবর্তনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দারা।

বর্তমানে সাকরাইন উৎসবে যোগ হয়েছে আধুনিক আরও অনেক অনুষঙ্গ। ডিজে গান-নাচ, প্রজেক্টর আর হাজার পাওয়ারের সাউন্ড সিস্টেম। সাকরাইন উৎসব ১৪ জানুয়ারি ভোর থেকে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ১৩ জানুয়ারি রাত থেকেই শুরু হয় ডিজে গান। উৎসবের এক সপ্তাহ আগে থেকে ঘুড়ি কেনার পাশাপাশি চলে আতশবাজি আর ফানুশ কেনার ধুম। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আকাশে ফানুশের দৌরাত্ম্য কমছে না।

উৎসবের এক সপ্তাহ আগে থেকে শুরু হয় ঘুড়ি কেনার ধুম/ছবি: মাহবুব আলম

Advertisement

সন্ধ্যা নামলেই পুরান ঢাকার আকাশ হাজার হাজার আতশবাজির আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। উঠতি বয়সী কিশোর থেকে যুবকেরা আগুন মুখে নিয়ে আগুন খেলা দেখায়। একজন মুখে কেরোসিন নিয়ে মুখের সামনে আগুনের মশাল ধরে, ফুঁ দিয়ে কেরোসিন আগুনের মশালে নিক্ষেপ করে, এতে আগুনের দলা তৈরি হয়। এটাই আগুন খেলা।

পুরান ঢাকার পাড়া-মহল্লায় একসঙ্গে নির্দিষ্ট বাসার ছাদে তৈরি করা হয় প্যান্ডেল। রাত যত গভীর হয় সাউন্ড সিস্টেমের পাওয়ার তত বাড়তে থাকে। আতশবাজির সঙ্গে চলে আগুন খেলার এক দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড। ছেলেমেয়েদের রং মাখামাখি থেকে শুরু করে হয় নানা অশ্লীল কর্মকাণ্ড।

ঢাকা ইতিহাস গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী ইতিহাসবিদ হাশেম সূফী জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকার ইতিহাস যত বছর তার আগেও ঘুড়ির ইতিহাস। এটি একদিনে তৈরি হয়নি। আগের দিনে সাকরাইন দেখেছি, ছেলেমেয়েদের ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা। কে কতদূর উঠাবে? কে কাকে কাটবে? ঢাকাইয়াদের ঘরে পিঠা উৎসব চলতো, ভালো ভালো খাবার-দাবারের আয়োজন চলতো। মেহমান আসতো, সবাই খোশগল্প করতো।’

বর্তমানে সাকরাইন উৎসবে যোগ হয়েছে আধুনিক আরও অনেক অনুষঙ্গ/ছবি: জাগো নিউজ

তিনি বলেন, ‘এখন আর এসব নেই। ঘরে ঘরে কেউ পিঠা বানায় না। সন্ধ্যা নামলেই ঘুড়ি নেমে যায়। শুরু হয় সাউন্ড সিস্টেমে গান-বাজনা আর আধুনিক অনুষঙ্গের ব্যবহার। ডিজে কখনো সাকরাইনের সংস্কৃতি হতে পারে না। আধুনিকায়নের কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। পশ্চিমাদের থেকে আমরা বেশি ভালো কিছু নিতে পারিনি, খারাপটাই বেশি নিয়েছি।’

ঢাকার এই ইতিহাসবিদ বলেন, ‘এসবের পেছনে কিছু মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক কারণ রয়েছে। আগে অনেক খেলার মাঠ ছিল, আমরা মাঠেই ঘুড়ি উড়িয়েছি। যেদিন থেকে মাঠ বিলুপ্ত করে প্রশাসন দালান-কোঠা নির্মাণ করছে, সেদিন থেকেই ছাদে ঘুড়ি উড়ানো শুরু করেছে ছেলেমেয়েরা। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছাদে নাচ-গান শুরু করছে। এসব বানানো সংস্কৃতিও একদিন বিলুপ্ত হবে নতুন কিছু আসবে। তবে যেটা মূল সংস্কৃতি, সেটা ধরে রাখা আমাদের সবার কর্তব্য।’

‘ঢাকার ইতিহাস যত বছরের, তার আগেও ঘুড়ির ইতিহাস’/ছবি: মাহবুব আলম

‘সরকারকে কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, সাকরাইনে যে ভিন্ন সংস্কৃতি প্রবেশ করছে সেগুলোর পরিবর্তন আনতে হবে। পর্যাপ্ত মাঠের ব্যবস্থা রাখতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইনডোর গেমস রাখতে হবে তাহলে শিক্ষার্থীরা আর ভিন্ন দিকে মোটিভেটেড হবে না’, যোগ করেন এই ইতিহাসবিদ।

এআরএ/এএসএম