সাহিত্য

বিশে বিষ

তাইজুল ইসলাম

Advertisement

সেবার হলো কি—পশ্চিমপাড়ার দীনু নাম করে ছেলেটার গা-কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো। চোখ দুটো কেমন লাল টকটকে হয়ে আছে। আগুনের ফুলকিও যেন ঝরবে। তাতে কী? অন্য কারোর হলে হয়তো বিছানামুখো হয়েই থাকতো। দুটো দিন অন্তত মায়ের বকুনি খেয়ে হলেও ঘর ধরতো।

এ তো দীনু। বড্ড দস্যি ছেলে। বড্ড দুরন্ত। ঘরে দু’দণ্ড শুয়ে থাকার পাত্র ও নয় মোটেই। এপাড়া-ওপাড়া চড়ে বেড়ানো ওর স্বভাব। ভোরের সূর্যটা চেতার আগে চেতে ওঠে ওর দুরন্তপনা।

কোনো কোনো দিন সকালবেলা হয়তো এক-দু’মুঠো ভাত পেটে পড়ে। বেশিরভাগই খালি পেটে বেরিয়ে পড়ে। পুরো পাড়া চষে বেড়ানো ছেলে ও। আড়াইটা নাগাদ বাড়ি ফিরে নাকেমুখে দুটো দিয়ে যায় স্নান সারতে। মায়ের বকুনি যেন গা-সওয়া হয়ে গেছে দীনুর।

Advertisement

সে যাকগে। রোজকার মতো এক গা জ্বর নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দীনু। রাতের বাসি পেটটা সকালবেলার দানাপানি অবধি ছোঁয় না। মাথায় ওর প্রচণ্ড যন্ত্রণা বোধ হচ্ছে। ক্রিকেটের রোদ্দুরে মাঠটায় তাই না গিয়ে ক্যারাম খেলায় মন দিয়েছে আজ। এইটুকুন ছেলে হলে হবে কী, ক্যারাম খেলায় ভালো হাত ওর।

দীপুটা এই নিয়ে তিনবার ডাকতে এলো দীনুকে। দীপু বয়সে দীনুর ছোট হলেও ভারী মিল দু’ভাইয়ের। ভাইকে ছাড়া স্নানে নামবে না সে। আর দীনু ঠিক করেছে আজ আর স্নান করবে না। এদিকে বালু কাটা বড় স্নান পুকুরটায় পনেরো-কুড়িজন নেমেছে। হৈ-হুল্লোড়ের আওয়াজ দীনুর কান এড়িয়ে যাবে, এতটাও কম শোনে না সে। এক ছুটে চলে এসে দিলো ঝাঁপ। পেছন পেছন দীপুও।

ঘণ্টা ফুরোলেও ওদের স্নান ফুরোয় না। দীনুটা ভীষণ আমুদে। কেউ উঠে গা-হাত-পা মুছছে তো কাদা ছুঁড়ছে। এই করে করে প্রায় দেড় ঘণ্টা অবধি স্নান করে দুটো নাগাদ উঠে দু’ভাই বাড়ি ফেরে।

ভুবন দাদুর মেহগনি বাগানের পেছনের পুকুরে সূর্যটা যখন স্নান করছিল, ঠিক তার সামনের মাঠটায় ঘাসগুলো ছায়া মাখামাখি করছে। দীনুটা ছায়াপড়া বিকেলের মাঠেও নেই। কম্বল মুড়ে শুয়ে আছে। জ্বরে ওর গা পুড়ে যাচ্ছে।

Advertisement

বাটিতে করে এক বাটি জল আর হাতে গামছাটা নিয়ে মা এলেন। জলপট্টি দিতে দিতে কত বকুনি, ‘এত বারণ করেও যদি একটা কথা শুনোতে পারতাম, তাহলে আর হয়েছে! দু’দণ্ড স্থির থাকে না ছেলেটা। জলে নামলে তিনি আমার মাথার হুঁশ খান।’

মায়ের বকুনি শুনে মনে মনে সে আনন্দই পাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে হাসছে আর বলছে, ‘মা তো আর জানে না, এই নিয়ে তিনদিন হলো জ্বর।’ জানলে আর রক্ষে ছিল না দীনুর।

টানা ন’টা দিন বাড়ির আঙিনা ডিঙিয়ে দেখা হয়নি ওর। মা-বাবা বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। পড়শিরা একজন রেখে একজন আসতো। সান্ত্বনা দিয়ে বিদায় নিতো। দস্যি হলেও বেশ মায়াবী মুখখানা। বড্ড ভালোবাসতো সবাই।

ডাক্তার-বদ্যি দেখিয়ে ষোলো দিনের মাথায় জ্বর সারলো সেবার।

সমানে শুরু হয় আবার দু’ভাইয়ের দস্যিপনা। রোদ-বৃষ্টি, কাদা-জল কোনো কিছুই আর ওদের রুখতে পারে না। পড়ে রইলো মায়ের বকুনি। সে তো রোজকার তুচ্ছ বিষয়।

দিন যায় রাত আসে। রাত যায় দিন আসে। মাসের পর মাস পেরোয়। এভাবেই পেরোয় বছরখানেক। একা পড়ে থেকে থেকে লাগোয়া মাঠটার ঘাসগুলো বেশ বড় হয়ে গেছে। পড়শিদের গাছের আমটা, পেয়ারাটা, কলাটা আর চুরি হয় না। দীনু কিংবা দীনুবাহিনীর কেউ আর এপাড়া-ওপাড়া করে বেড়ায় না। সবাই ঘর ধরেছে। শান্তটি বনে গেছে যেন একেবারে।

বিশেষ দরকার না পড়লে বাড়ির বড়রা অবধিও বেরোচ্ছে না। দীনুটা হাফিয়ে উঠলেও বেরোনোর জো নেই। দীপুকে নিয়েই দিন গড়াচ্ছে ওর।

হঠাৎ একদিন গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো দীনুর। সঙ্গে সর্দি-কাশিও। পাড়াসুদ্ধ ছড়িয়ে গেল হোসেন মিঞার ছেলে দীনুর করোনা হয়েছে। একটি মিথ্যা গুজবে গা ভাসিয়ে একঘরে করে দেয় দীনুদের।

একে তো মহামারির প্রকোপে বাড়ির বাইরে বেরোয় না দুরন্ত ছেলেটা। তার ওপর গুজব ছড়িয়ে ঘরবন্দি করে দেয় এক্কেবারে। সেবার জ্বর হলে যেসব পড়শিরা দেখতে এসেছিল, তারাই এবার দূর থেকে বিষবাক্য ছড়িয়ে যাচ্ছে। দস্যি ছেলেটাও চুপসে যায় একটা সময়।

বিবর্ণ মুখে মাকে বলে, ‘ও মা! সেবার আমার জ্বর হলে সবাই যে দেখতে এলো; কই, কেউ তো বললো না, আমার করোনা হয়েছে!’ ‘আমার কী সত্যিই করোনা হয়েছে বাবা?’ ছেলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কাঁদছে দুজন। হোসেন মিঞা আনমনে ভাবছে—সংসারের এই হাল, খরচই চলছে না; তার ওপর ছেলেটা পড়লো অসুখে। কী করে দিন যাবে তাদের?

দেখতে দেখতে ঠিক দিন চারেকের মাথায় দীনু সেরে উঠলো। দীপুকে নিয়ে এক ছুটে চলে যায় বিকেলের ছায়াপড়া মাঠটায়। চিৎকার করে বলে, ‘দীপু! সবাইকে বলে দে, আমার করোনা হয় নাই!’

ভুবন দাদুর মেহগনি বাগানে ধ্বনিত হয় দীনুর চিৎকার। একে একে ছুটে আসে জয়, স্বপন, সুজা, তনু; দীপুবাহিনীর সবাই। দুরন্তপনার বাতাস বয়ে যায় বেড়ে ওঠা ঘাসের বুকে। হেলেপড়া সূর্যটাও শেষ হাসি হেসে একবার দুলে ওঠে।

ভুবন দাদুর মেহগনি বাগানের পেছনের পুকুরে সূর্যটা তার স্নান সারতে সারতে যেন বলে গেলো—ওদের দুরন্তপনা মহামারির বিষ না নামাতে পারলেও শহর-গ্রামের ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে পড়া আতঙ্ক আর গুজবের বিষ চিরতরে নামিয়ে দিলো।

এসইউ/এএসএম