স্বামীর সঙ্গে তর্ক করার কারণে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নারী স্বামীর মারধরের শিকার হন বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। দেশব্যাপী নারীর প্রতি সহিংসতার ওপর করা এ গবেষণায় স্ত্রীকে মারধরের আরও কয়েকটি বিশেষ কারণ উঠে আসে। যেখানে নারীদের একটি অংশ মনে করেন রান্নার সময় খাবার পুড়িয়ে ফেললে স্বামীর মারধর করার অধিকার আছে।
Advertisement
ইউনিসেফের অর্থায়নে দেশব্যাপী মাল্টিপল ইনডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে-২০১৯ ডাটাবেজের তথ্যের ভিত্তিতে করা গবেষণা নিবন্ধটি গত ৪ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের ‘বায়োমেড সেন্ট্রাল সাইক্যাট্রি’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণায় উঠে আসে, শহুরে ১৭ শতাংশ ও গ্রাম্য ২২ শতাংশ নারী স্বামীর সঙ্গে তর্ক করার কারণে স্বামীর হাতে মারধরের শিকার হন। এছাড়া সন্তানের প্রতি অবহেলার কারণে শহুরে ১৩ শতাংশ এবং গ্রাম্য ১৬ শতাংশ, যৌনমিলনে অসম্মতির কারণে শহুরে ৮ শতাংশ ও গ্রাম্য ১০ শতাংশ, স্বামীকে না বলে বাইরে যাওয়ার কারণে শহুরে ১০ শতাংশ ও গ্রাম্য ১৪ শতাংশ নারী মারধরের শিকার হন। তবে গ্রাম্য ৬.৮ শতাংশ ও শহুরে ৫.১ শতাংশ নারী বিশ্বাস করেন, রান্নার সময় খাবার পুড়ে গেলে স্বামীর মারধর করার অধিকার আছে।
বিশ্বের প্রতি তিনজন নারীর একজন জীবনের কোনো না কোনো সময় ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর সহিংসতার (ইন্টিমেট পার্টনার ভায়োলেন্স-আইপিভি) শিকার হন বলে উঠে এসেছে গবেষণায়।
Advertisement
এতে উল্লেখ করা হয়, ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর কাছ থেকে পাওয়া সহিংসতার হার পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ২০ শতাংশ, ইউরোপসহ ধনী দেশগুলোতে ২২ শতাংশ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধীনে আমেরিকা অঞ্চলে ২৫ শতাংশ, আফ্রিকা অঞ্চলে ৩৩ শতাংশ, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ৩১ শতাংশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ৩৩ শতাংশ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ৪২ শতাংশ, যেখানে সারা পৃথিবীতে ৩০ শতাংশ।
দেশের আটটি বিভাগ থেকে ১৩ হাজার ৩৩ জন শহুরে এবং ৫১ হাজার গ্রাম্য নারীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীরাও এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। যাদের বয়স ছিল ১৫ থেকে ৩৯ বছর।
‘প্রিভ্যালেন্স অ্যান্ড ডিটারমিন্যান্টস অব ওয়াইফ-বিটিং ইন বাংলাদেশ: এভিডেন্স ফ্রম এ ন্যাশনওয়াইড সার্ভে’ শীর্ষক গবেষণায় প্রধান ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন।
অন্যরা হলেন-সিলেটের আরটিএম আল কবির টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিভাগের ফারুক আব্দুল্লাহ, অস্ট্রেলিয়ার চালর্স স্ট্রাট বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ও প্রকৌশল বিভাগের স্কুল অব কম্পিউটিংয়ের আজিজুর রহমান, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্ট লন্ডনের কলেজ ও নার্সিং, মিডওয়াইফারি অ্যান্ড হেল্থকেয়ারের হাফিজ টিএ খান।
Advertisement
গবেষণায় বলা হয়, স্ত্রীকে মারধর করা বিশ্বব্যাপী দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি সমস্যা। এটি ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর সহিংসতার একটি স্বাভাবিক রূপ। এই সহিংসতার কারণ হিসেবে বিয়ের সময়কার বয়স, স্বামী-স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য, বিবাহের ধরন, শিক্ষাগত যোগ্যতা, দারিদ্রতা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যোগাযোগের ঘাটতি, মাদক গ্রহণ, গৃহস্থালির কাজকর্মে ধরন ইত্যাদি দায়ী।
দেশে ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর কাছ থেকে পাওয়া সহিংসতার কারণে নারীরা অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ, অধিক গর্ভপাত ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
গবেষণায় দাবি করা হয়, গ্রাম্য নারীদের ২৫ শতাংশ ও ২০ শতাংশ শহুরে নারী কোনো না কোনোভাবে সহিংসতার শিকার। বয়স্কদের তুলনায় ৩০ বছরের কম বয়সী নারীদের মধ্যে কম সহিংসতা দেখা গেছে। গার্হস্থ্য সহিংসতার কারণে নারীরা অবাঞ্চিত গর্ভধারণ, গর্ভস্রাব, গর্ভপাত ও যৌনরোগ, প্ররোচিত গর্ভপাত, এইডস, মানসিক চাপ, আত্মহত্যা, ভীতি, স্ত্রীরোগ বিষয়ক সমস্যায় ভোগেন।
গবেষণা বলছে, খাবার পোড়ানো নিয়ে স্বামীর মারধরের অধিকার আছে—বিষয়টি মানতে নারাজ সন্তানহীন বা দুইটি সন্তান আছে এমন নারীরা। তবে বেশি সন্তান আছে এমন নারীরা সহজেই মেনে নেন। এক্ষেত্রে অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত নারীরা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা নারীদের তুলনায় স্বামীর মারধরকে আড়াইগুণ বেশি মেনে নেন।
সিলেট বিভাগের শহুরে নারীদের চেয়ে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগের শহুরের নারীরা স্বামীর মারধরকে অনেকটা বৈধ মনে করে। তবে রংপুর ও খুলনা বিভাগের গ্রাম্য নারীরা স্বামীর মারধরকে বৈধ মনে করলেও সিলেটের গ্রাম্য নারীরা ঠিক উল্টো। বরিশাল বিভাগের নারীরা তুলনামূলক কম মাত্রায় স্বামীর মারধরকে মেনে নেন।
এ বিষয়ে নিবন্ধটির প্রধান গবেষক সহযোগী অধ্যাপক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন জাগো নিউকে বলেন, ‘দ্বন্দ্ব-সংঘাত পারিবারিক জীবনেরই অংশ। ঘনিষ্ঠ সঙ্গীদের কাছে একে অপরের প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকায় সামান্য উঁচুনিচুতেই অনেক সময় সেটি সহিংসতার রূপ নেয়। দাম্পত্যজীবনে সঙ্গীদের মধ্যে ছাড় দেওয়ার মানসিক কমে যাওয়ায় এ ঘটনাগুলো ঘটছে। পারস্পরিক বোঝাপড়াই এ সমস্যার সমাধান দিতে পারে।’
মাহবুব সরদার/এসআর/এএসএম