সাহিত্য

বাংলা সাহিত্যের হারিয়ে যাওয়া উজ্জ্বল নক্ষত্র

করোনা ছাড়াও বেশ কিছু কারণে আলোচিত বছর ২০২১। এ বছর নিরাশার হাওয়া লাগে বাংলা সাহিত্যেও। কারণ ২০২১ সালে বেশ কয়েকজন গুণীব্যক্তিত্বকে হারিয়েছি আমরা। কবি, লেখক, গবেষক, সাংবাদিক, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীসহ আলোকিত মানুষগণ আমাদের বিষাদের অন্ধকারে ফেলে চলে গেছেন চিরদিনের জন্য। তবে রেখে গেছেন তাদের মূল্যবান সৃষ্টিকর্ম। সেই সব উজ্জ্বল নক্ষত্রের প্রস্থান নিয়েই আজকের আয়োজন—

Advertisement

২০২১ সালের ৩ জানুয়ারি একুশে পদক বিজয়ী লেখক রাবেয়া খাতুন মারা যান। বেশ কিছুদিন বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে বনানীতে নিজ বাসভবনে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। রাবেয়া খাতুন ঢাকার বিক্রমপুরে তাঁর মামা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তবে পৈতৃক বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর গ্রামে। তাঁর রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জনপ্রিয় উপন্যাস ‘মেঘের পর মেঘ’ অবলম্বনে একই নামে ২০০৪ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। তিনি ষাটটিরও বেশি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন।

দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও লেখক মিজানুর রহমান খান গত বছর ১১ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর। মিজানুর রহমান খান প্রায় এক মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার পোস্ট কোভিড কমপ্লিকেশন দেখা দিয়েছিল। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তার বিশ্লেষণধর্মী লেখা পাঠককে মুগ্ধ করতো।

খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক ও বিশিষ্ট প্রত্নগবেষক খন্দকার মাহমুদুল হাসান ২৮ জানুয়ারি রাত ১১টা ১০ মিনিটে রাজধানীর গ্রিনলাইফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থা মারা যান। তিনি শিশুসাহিত্যিক, গবেষকসহ একজন বহুমাত্রিক লেখক ছিলেন। শিশুসাহিত্য, ভ্রমণ, প্রবন্ধ, গবেষণাসহ শিল্প-সাহিত্যের নানা অঙ্গনে তার পদচারণা ছিল। তাঁর শিশুসাহিত্যের মধ্যে হাসির গল্প, রহস্য উপন্যাস, ইতিহাস, বিজ্ঞান প্রভৃতি রয়েছে।

Advertisement

২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মারা যান লেখক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি একাধারে একজন বাংলাদেশি সাংবাদিক, কলামিস্ট, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও লেখক। তিনি তার গবেষণাধর্মী প্রবন্ধের জন্য সুপরিচিত। তিনি নিয়মিত জাতীয় দৈনিকে কলাম লিখতেন। এছাড়াও বিখ্যাত সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদদের জীবনী ও কর্ম নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন।

দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক এবং গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ ২২ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ও বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান ১৪ এপ্রিল মারা যান। একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক, অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান একাধারে ছিলেন লোক সংস্কৃতি ও পল্লীসাহিত্য গবেষক। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ, বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা শিরোনামে ৬৪ খণ্ডে ৬৪ জেলার লোকজ সংস্কৃতির সংগ্রহশালা সম্পাদনা এবং ১১৪ খণ্ডে বাংলাদেশের ফোকলোর সংগ্রহমালা সম্পাদনা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও কলামিস্ট অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান ১৬ এপ্রিল মারা যান। অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান এক সময় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনেরও সদস্য ছিলেন। আন্তর্জাতিক ও সমসাময়িক রাজনীতির নিয়ে তার কয়েকটি বই আছে। তিনি গণমাধ্যমে রাজনীতির বিশ্লেষক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন।

Advertisement

একই বছর ২৫ মে মারা যান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। পাকস্থলীর সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। অবস্থার অবনতি হলে ভ্যান্টিলেশনে নেওয়া হয় কবিকে। সেখান থেকে আর ফেরা হয়নি তার। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তিনি ২০১৬ সালে একুশে পদকে ভূষিত হয়েছিলেন। সিরাজী ২০১৮ সালের ২০ ডিসেম্বর থেকে মৃত্যু অবধি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।

কবি ও গীতিকার ফজল-এ-খোদা ৪ জুলাই মারা যান। তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। বাংলাদেশ বেতারের সাবেক পরিচালক গুণী মানুষটির জন্ম ১৯৪১ সালের ৯ মার্চ পাবনার বেড়া উপজেলার বনগ্রামে। মুহাম্মদ খোদা বক্স এবং মোসাম্মাৎ জয়নবুন্নেছার প্রথম সন্তান তিনি। ১৯৬৩ সালে বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে তালিকাভুক্ত হন টেলিভিশনে। শিশু-কিশোর সংগঠন শাপলা শালুকের প্রতিষ্ঠাতা ফজল-এ-খোদা ‘মিতা ভাই’ নামেও পরিচিত ছিলেন।

কবি ও সাংবাদিক অরুণ দাশগুপ্ত বার্ধক্যজনিত কারণে চট্টগ্রামের পটিয়ার ধলঘাট গ্রামের নিজ বাড়িতে ১০ জুলাই মারা যান। দৈনিক আজাদীর এ সহযোগী সম্পাদক জীবনসায়াহ্নে এসে গ্রামেই দিন কাটাচ্ছিলেন। তিনি ছিলেন অকৃতদার। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে সারাজীবন অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করেছেন। এ ছাড়া চট্টগ্রামের বেসরকারি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যও ছিলেন।

লেখক ও অনুবাদক শেখ আবদুল হাকিম ২৮ আগস্ট দুপুর ১টায় রাজধানীর নিজ বাসায় মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। অবশ্য তার মৃত্যুর পরে তিনি মাসুদ রানা ও কুয়াশা সিরিজের লেখক সত্ত¡ লাভ করেন। মৃত্যুর আগেই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন এ লেখক। একই দিনে মারা যান কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী। ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে রাজধানীর পুরান ঢাকায় নিজ বাসায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। এ বছরই বুলবুল চৌধুরী একুশে পদক লাভ করেছিলেন।

কথাসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, গবেষক, বাংলা একাডেমির ফেলো ও সাবেক পরিচালক বশীর আল-হেলাল ৩১ আগস্ট মারা যান। তাঁর জন্ম ১৯৩৬ সালের ৬ জানুয়ারি মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামের মীর পাড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই জড়িয়ে পড়েন ছাত্ররাজনীতি ও কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে। এ সময় থেকেই লেখালেখি করতেন। সে সময়ই কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গল্পের বই ‘স্বপ্নের কুশীলব’।

লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ খান মারা যান ১ অক্টোবর। তিনি বাংলা একাডেমির পরিচালক ছিলেন। তাঁর জন্ম ১৯৪৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর। পৈতৃক নিবাস কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমলা গ্রাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালী কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন।

জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক, ছড়াকার, শিশু সংগঠক, নাট্যকার ও প্রবীণ সাংবাদিক রফিকুল হক দাদুভাই ১০ অক্টোবর সকাল ১১টায় নিজ বাসায় মারা যান। তিনি দৈনিক যুগান্তরের ফিচার এডিটর ছিলেন। তিনি বার্ধক্যজনিত বিবিধ জটিলতায় ভুগছিলেন। ২০২০ সালে পরপর দুইবার তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭টি। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ একাধিক পুরস্কার লাভ করেছেন।

স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদকজয়ী কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ৮২ বছর বয়সে ১৫ নভেম্বর মারা যান। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগে রাজশাহীর বাসভবনে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, বিশ্লেষক ও ছোট গল্পকার। আগুনপাখি (২০০৬) তাঁর রচিত প্রথম উপন্যাস। তিনি ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৯৯ সালে একুশে পদকে ও ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।

নক্ষত্র পতনের ধারাবাহিকতায় বছরের শেষদিকে আমরা জাতির আরেক অভিভাবককে হারিয়ে ফেলি। একুশে পদকপ্রাপ্ত নজরুল গবেষক বাংলা একাডেমির সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ৩০ নভেম্বর মারা যান। ফুসফুসের জটিলতায় ভুগে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম নজরুল অধ্যাপক ও ওই প্রতিষ্ঠানের নজরুল-গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘জাতীয় অধ্যাপক’ হিসেবে পুরস্কৃত করে।

গত এক বছরে যাঁরা চলে গেছেন; তাঁদের বিদেহী আত্মার প্রতি রইল অশেষ শ্রদ্ধা। আমরা তাঁদের সারাজীবন স্মরণে ও শ্রদ্ধায় রাখবো। তাঁদের স্মৃতি ও কর্ম আমাদের আজীবন অনুপ্রাণিত করবে।

এসইউ/জিকেএস