নবাবের খেয়ালের অন্ত নেই। একবার নবাবের খেয়াল হলো মাটির নীচে কী আছে তা জ্যোতিষী পণ্ডিত দ্বারা গণনা করিয়ে নিতে হবে। আর গণনা সত্য কি মিথ্যা তা তো সঙ্গে সঙ্গে কিছু মাটি খুঁড়লেই বোঝা যাবে। আর সঠিকভাবে বলে দিতে পারলে নবাব প্রত্যেক পণ্ডিতকে এক হাজার আশরফি করে পুরস্কার দেবেন। না বলতে পারলে আজীবন কারাবাস।
Advertisement
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র কিছু দরিদ্র জ্যোতিষী পণ্ডিতকে নবাব দরবারে পাঠিয়েছিলেন তারা কেউ মাটির নীচে কী আছে বলতে না পারায় কারাগারে রয়েছে। এমন খবর পেয়ে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বিষণ্ণ মুখে বসেছিলেন। তিনি ভাবছিলেন একমাত্র তারই দোষে এতগুলো ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে নবাবের কারাগারে পচে মরতে হবে।
সদাহাস্যময় গোপাল মহারাজের ঐ ভাব দেখে বলল, মহারাজ, অমন গোমরামুখ করে বসে আছেন কেন? মহারাজ গোপালের কাছে সব ঘটনা বলেলেন। গোপাল শুনে বলল, এর জন্য ভাবনা কি? আপনি নবাবের কাছে একটি চিঠি দিন যে, একজন বড় জ্যোতিষী পাঠালাম, যিনি অনায়াসে মাটির নীচে কি আছে গণনা করে বলে দিতে পারেন।
মহারাজ অবাক হয়ে বললেন, গোপাল, তুমি গণনা করবে? কী করব জানি না। তবে নিজেও বেঁচে আসব, আর দরিদ্র ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণকে নবাবের কারাগার থেকে মুক্ত করে আনবো, তাছাড়া আপনার সম্মানও অক্ষুণ্ণ রাখব। এদিকে মন্ত্রী স্বভাবতই বললেন, এ অসম্ভব।
Advertisement
গোপাল মন্ত্রীকে একটু খোঁজা দিয়েই বলল, আমার ওপর আস্থা রাখতে পারেন। আমি সহজেই কার্যসিদ্ধ হয়ে ফিরে আসব। মহারাজ বললেন, তুমি যদি দরিদ্র জ্যোতিষী পণ্ডিতদের নবাবের কারাগার থেকে মুক্ত করে আনতে পার আমি তোমাকে হাজার টাকা পুরস্কার দেব।
গোপাল বাড়ি ফিরে গিয়ে খাটের একটা ভাঙা পায়াকে চৌদ্দ পর্দা শালুর কাপড় দিয়ে বেশ ভালোভাবে জড়িয়ে নিল। গরদের কাপড়, গরদের চাদর, কাঁধে নামাবলী, মাথায় লম্বা টিকি ঝুলিয়ে এবং চৌদ্দ পর্দা কাপড়ে জড়ানো খাটের পায়াখানা হাতে নিয়ে নবাব দরবারে গিয়ে উপস্থিত হলো।
নবাবকে যথোচিত সেলাম জানিয়ে বলল, খোদাবন্দ, আমাকে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আপনার দরবারে পাঠিয়েছেন। মাটির নীচে কী আছে আমি তা অনায়াসেই গণনা করে বলে দিতে পারি। গোপালের কথা শুনে নবাব খুব সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, আপনার চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছি আপনি একজন মহান পণ্ডিত। আপনি আসন গ্রহন করুন এবং একটু বিশ্রাম করে বলুন- মাটির নীচে কী আছে।
গোপাল নির্দিষ্ট আসনে বসে চৌদ্দ পর্দা জড়ানো খাটের পায়ার তিন পর্দা সরিয়ে মন্ত্র পড়বার ভান করে নবাবকে বলল, হুজুরালি সর্বং সারং খট্টাঙ্গ পুরাণম্। হিন্দু পণ্ডিতং ন শক্যং ভূতলগণনম্।
Advertisement
নবাব গোপালকে বলল পণ্ডিতমশাই, আপনার এ শ্লোকের অর্থ কি? গোপাল মুচকি হেসে বলল, হুজুরালি, অষ্টাদশ পুরাণের সার এই খট্টাঙ্গ পুরাণ। এতে বলছে মাটির নীচে কি আছে- তা কোন হিন্দু পণ্ডিতই গণনা করে বলতে পারবে না।
গোপালের কথা শুনে নবাব বললেন, তবে কারা এরূপ গণনা করতে পারবে মহাশয়? গোপাল বলল, সেকথাও উল্লেখ আছে নবাব সাহেব। যবন বা ম্লেচ্ছং ভূতলগনং শক্যং। হিন্দু পণ্ডিতা পৃথিবী বা তদূর্ধ্বং। অর্থাৎ যবন বা ম্লেচ্ছগণকে মরবার পরে মাটির নীচে কবর দেওয়া হয়। অতএব যবন বা ম্লেচ্ছ পণ্ডিতগণ ভূতলের নীচে কী আছে অনায়াসে গণনা করে বলে দিতে পারবে।
আর যেহেতু হিন্দু পণ্ডিতগণ মরবার পর তাদের দাহ করা হয় অতএব হিন্দু পণ্ডিতগণ অনায়াসে মাটি ও উপরের আকাশে কি আছে সহজেই গণনা করে বলে দিতে পারবে। আপনি অনর্থক কতগুলো হিন্দু পণ্ডিতকে কারাগারে আটকে রেখে কষ্ট দিচ্ছেন।
গোপালের যুক্তিপূর্ণ কথা ও শাস্ত্রবচন নবাবের খুব মনঃপূত হলো, তিনি সমস্ত হিন্দু পণ্ডিতকে মুক্ত করে দিলেন এবং প্রত্যেককে একশো টাকা পুরস্কার দিয়ে বদায় দিলেন।
তারপর গোপালের হাতে পাঁচশো টাকা দিয়ে বললেন, আপনি যথার্থ কথা বলেছেন পণ্ডিতমশাই। আপনি না বললে আমি অনেক হিন্দু পণ্ডিতকে অনর্থক কষ্ট দিতুম। এই সামান্য কিছু নিন। আমি এক্ষুণি কাঠমোল্লা পণ্ডিতদের ডেকে এনে মাটির নীচে কী আছে তা গণনা করাচ্ছি।
নবাবের কাছ থেকে পাঁচশ টাকা পুরস্কার পেয়ে, খট্টাঙ্গ পুরাণখানা হাতে নিয়ে গোপাল একরকম নাচতে-নাচতে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় এসে উপস্থিত হলো। নবাবের কারাগার থেকে যেসব জ্যোতিষী পণ্ডিত মুক্ত হয়েছিল, তারাও এসে সকলেই মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় উপস্থিত হলো।
গোপালের মুখে সব ঘটনা শুনে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও সভার সকলেই জয়ধ্বনি করে উঠলো জয় গোপালের জয়। জয় খট্টাঙ্গ পুরাণের জয়। মহারাজ গোপালকে প্রতিশ্রুতিমত এক হাজার টাকা পুরস্কার দিয়ে বললেন, তোমার খট্টাঙ্গ পুরাণখানা একবার দেখাও তো।
গোপাল পুরস্কারের টাকা ট্যাঁকে গুঁজে খট্টাঙ্গ পুরাণের ওপরে জরানো চৌদ্দ পর্দা কাপড় সরিয়ে ফেলতেই খাটের একটি ভাঙা পায়া বেরিয়ে পড়ল। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় তুমুল হাসির রোল উঠলো। এদিকে মন্ত্রী তো গোপালকে জব্দ করার মতলব কোষতে লাগলো।
লেখা: সংগৃহীতছবি: সংগৃহীত
প্রিয় পাঠক, আপনিও অংশ নিতে পারেন আমাদের এ আয়োজনে। আপনার মজার (রম্য) গল্পটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়। লেখা মনোনীত হলেই যে কোনো শুক্রবার প্রকাশিত হবে।
কেএসকে/জিকেএস