সেলিম আল দীনকে (১৯৪৯-২০০৮) রবীন্দ্রোত্তরকালের বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার বলা হয়। কারণ নাট্য মাধ্যমে তাঁর সৃষ্টিশীলতার আলোকরেখা ভারতবর্ষ অতিক্রম করে আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তের নাট্যাঙ্গনকে উজ্জ্বল করেছে। তাঁর একাধিক নাটক ইংরেজি এবং সুইডিশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। মঞ্চস্থ হয়েছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান ও সিঙ্গাপুরে। সমালোচকের ভাষায় : ‘বিশ্বসাহিত্যের ধ্রুপদী ধারায় শ্রমজীবী মানুষ এবং বাংলার আবহমানকালের সংস্কৃতিকে সেলিম আল দীন তাঁর নাটকে মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিদানে সমর্থ হয়েছেন। [..] বাঙালির সহস্রবর্ষের নন্দনতত্ত্বের আলোকে পাশ্চাত্য শিল্পের সকল বিভাজনকে অস্বীকারপূর্বক বাংলা সাহিত্যে তিনি এক নবতর শিল্পরীতি প্রবর্তন করেছেন- দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পরীতি।’
Advertisement
১৮ আগস্ট ১৯৪৯ থেকে ১৪ জানুয়ারি ২০০৮ এই স্বল্পপরিসর কালপর্বে আমরা সেলিম আল দীনের বিচিত্র রীতির রূপ-রস, বর্ণ-গন্ধময় নাটকের সাক্ষাৎ পাই। যার অন্তর্নিহিত মৌল সুর এক সুনির্দিষ্ট শিল্পাদর্শ ও শিল্পতাত্ত্বিক পটভূমির ওপর স্থাপিত। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ক্রমসঞ্চারমান নাট্যবৃত্ত ও তাত্ত্বিকবোধে আমরা লক্ষ করি তাঁর স্বদেশ ও শিল্পভাবনার পরিণতিশীল এক অভিযাত্রা। মূলত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে নব নব প্রেরণা আর সৃষ্টিশীল ধ্যান-নিমগ্নতা নিয়ে সেলিম নাটকের মতো যৌথ এক শিল্পমাধ্যমে আত্মপ্রকাশে ব্রতী হয়েছিলেন।
এই মাধ্যমে তাঁর আত্মপ্রকাশের সাফল্য-ব্যর্থতার হিসেব গণনার সময় সমাগত হয়নি এখনো। তাঁর প্রয়াণের পর আমরা মাত্র একটি যুগের অবসান দেখতে পাই। বিগত এক যুগ বাঙালির নাট্যপ্রয়াস থেকে সেলিম আল দীন বিচ্যুত হননি। অনাগত যুগযুগান্তর নিজস্ব প্রয়োজনেই বাঙালির এই মহান শিল্পীর মূল্যায়ন করবে। তবু আজ (১৪ জানুয়ারি ২০২২) ১৪’শ প্রয়াণ দিবসে আমরা তাঁর শিল্পভাবনা ও শিল্পতত্ত্বের প্রেরণা সম্পর্কিত দু’একটি বিষয়ের পুনর্পাঠ জরুরি বিবেচনা করি।
‘নাটক সমাজ বদলের হাতিয়ার’; ‘নাটক সমাজের দর্পণ’ ‘নাটক আমাদের শ্রম ও ঘামের ফসল’ ইত্যাদি নানাবিধ স্লোগানে জর্জরিত নাট্যকর্মীর সম্মুখে : ‘গ্রামের দুঃস্থ মানুষ, অরণ্যের বিলীয়মান উপজাতি, লাঞ্ছিত নারী―এই নিচু তলার মানুষেরই ভীড় তাঁর নাটকে।’ কিংবা ‘সামাজিক নৃতাত্ত্বিক পটে তাদের বহুস্তরিক বাস্তবতাই উঠে আসে সেখানে।’
Advertisement
সেলিমের নাটকপাঠে মূলত এক ধারার নাট্যকর্মীর কাছে উদ্ধৃত দৃষ্টিভঙ্গি সমূহেরই উন্মোচন ঘটায়। সেক্ষেত্রে সেলিম আল দীন পাঠ ও বিবেচনা এক সঙ্কীর্ণ বিশ্বাসের বেড়াজালে থমকে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি― এতে নাট্যকারের পুনর্মৃত্যুও ঘটে! এই দায় থেকে উত্তরণ এবং সেলিমকে সমগ্রভাবে জানবার লক্ষ্যে তাঁর সৃষ্ট নানা আঙ্গিক রূপ ও রীতির বিচিত্র অন্বেষণে ব্রতী হলে দেখা যায় পাণ্ডুর ঐ বর্ণিত বাস্তবতার আড়াল ভেদ করে ওঠে আসে সহস্রবর্ষের বাঙালির বিরামহীন দ্রোহ আর বিদ্রোহে সৃষ্ট এই স্বদেশ আর ভূমিজ জীবন ও প্রকৃতির বিস্তৃত এক পটভূমি। যেখানে তাঁর বিচরণ কেবল সামাজিকভাবেই সন্বিষ্ট নয়; বরং অন্তর্গতভাবে স্বজাতীয় শিল্পভাবনা ও নন্দনপ্রকাশের দৃষ্টিচেতনায় সমুজ্জ্বল।
সমালোচকের ভাষায় : ‘কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাতহদাই-তে যে শিকড় সন্ধান ও মহাকাব্যিক বিস্তার, তা পেরিয়ে তিনি চলে যান চাকা, যৈবতীকন্যার মন বা হরগজ নাটকের বর্ণনাত্মক রীতির নতুন পরীক্ষায়, কিংবা সাম্প্রতিককালে বনপাংশুল বা প্রাচ্য-র পুরাণ ও প্রতীকে। কিন্তু সবসময় লক্ষ্য তাঁর স্বদেশের উন্মোচন। নাটকের প্রান্ত সীমা ছাড়িয়ে শিল্পের সমগ্রে পৌঁছানো। প্রত্নপ্রতিমার সঙ্গে আধুনিক এপিক দৃষ্টির সংযোগ ঘটিয়ে তোলা।’
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর বিশ্বপরিস্থিতিতে পাশ্চাত্যের শিল্পসাহিত্যে নানা মতবাদপুষ্ট ও ক্ষণস্থায়ী শিল্প আন্দোলনের বিপরীতে ঔপনিবেশমুক্ত বিশেষত তৃতীয়বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের সৃজনক্ষম শিল্পীদের চেতনায় নাগরিকবোধ ও বিশ্বাসে ‘স্বদেশ’, ‘স্বভূমি’ আর এই ‘স্বভূমিজ’ বাস্তবতার অন্বেষা ব্যাপক জায়গা অর্জন করে নেয়। সেই চেতনার স্বরূপ আমরা ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্তিলাভের মাত্র চার বছরের মধ্যে আবিষ্কারে সক্ষম হয়ে উঠি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনসহ পরবর্তীকালের সকল আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে শিল্পের নানা শাখায় উক্ত চেতনার বিস্তার ঘটে। ভাষা আন্দোলন আমাদের উল্লিখিত চেতনাবোধকে আরো শাণিত করে তোলে― স্বদেশ, স্বজাতি ও স্বজাতীয় সংস্কার-সংস্কৃতির প্রতি এই চেতনাবোধই উল্লিখিত প্রত্যয়সমূহের প্রতি অর্থাৎ ‘স্বদেশ’ ও ‘স্বভূমির’ প্রতি আরো গভীরভাবে দৃষ্টি ফেরানোর তাগিদে উদ্বুদ্ধ করে।
তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি অপশাসনের নয়া-ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত অল্পসংখ্যক বাঙালির মতো সেলিম আল দীনও মঞ্চের মাধ্যমে খুঁজলেন সহস্রবর্ষের চিরায়ত বাংলাকে― আর চিরায়ত বাংলার ভূমি এবং ভূমিজ বাস্তবতার স্বরূপ। আবার, এই ভূমিজ বাস্তবতার সঙ্গে বিশ্ববোধের এক অদ্বৈত সম্পর্কও সৃজন করলেন তাঁর স্বতন্ত্র ভাষা, বাক্য ও শব্দন্যাসের ঋজু কুশলতায়। কিন্তু সমকালে এদেশের চলমান নাট্যিক প্রবণতা ছিল তাঁর চেতনায় লালিত শিল্পবোধের একেবারেই বিপরীতমুখা।
Advertisement
তাই তিনি ক্ষোভের সঙ্গে একদা বলেছিলেন : ‘দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমকালীন থিয়েটারের একটা বড় অংশ শিল্পের নিত্যকে আপন ইতিহাসের সহজ পরিক্রমের ধারায় গ্রহণ করেনি। শিল্পরচনার নিগূঢ় তাগিদের চেয়ে চলমান আহ্বানের দিকে তার উৎকর্ণ যাত্রা, প্রথার ছাঁচে এক প্রশ্নহীন আত্মসমর্পণে আশ্চর্যজনক তৃপ্তি। ফলে শিকড়ের চেয়ে শাখার দিকে আমাদের মনোযোগ বেশি।’
বিশ্বের কোন অঞ্চলের পাঠকই সেলিম আল দীনপাঠে তাঁকে উৎকেন্দ্রিক নাট্যকার বলার স্পর্ধা দেখাতে পারবেন না। কারণ তাঁর রচনার থরে থরে বিন্যস্ত বাঙালির স্বদেশ-ভূগোল আর এর অধিবাসী ও আদিবাসী সকলের নৃতাত্ত্বিক আচরণের ক্রমবিবর্তন মূর্তমান চলচ্ছবির আদলেই জীবন্ত নিরন্তর সংগ্রামশীল। উপরন্তু, তাঁর রচনায় মূর্তমান হয়ে ওঠে ঋতু-কাল-আবহাওয়া নির্বিশেষে আকাশের রঙ আর বাতাসের ঘূর্ণায়মানতার সঙ্গে এই ভূমিজ প্রকৃতির লীলাবৈচিত্র্যের বিপরীতে জনপদের প্রাচীন এবং অনন্ত বিশ্বাসসমূহও। তাঁর অনুসন্ধিৎসায় উদ্ধার করে আনেন এ অঞ্চলের হাজার বছরের প্রত্নমানবের নৃতাত্ত্বিকবৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ সৃষ্টিশীলতা এবং মগ্নচৈতন্যের শৈল্পিক fusion -এর আশ্রয়ে তিনি সৃজন করেছেন এই ভূমিজাত মানবের শিল্পসাধনার কল্যাণে নিবেদিত মহান এক শিল্পতত্ত্ব― যাকে তিনি ‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্ব’ অভিধায় আমাদের বংশ পরম্পরায় প্রজন্মবাহিত নন্দন-মননে দান করেন অপার্থিব উজ্জ্বলতা।
স্বদেশ ও স্বভূমিই সেলিমের দাঁড়াবার স্থান, সৃজনশীলভাবনা ও সৃষ্টিশীলতায় আত্মপ্রতিষ্ঠার স্থান। স্বদেশ বা স্বভূমি অর্থাৎ বৃহত্তর ভাবনায় প্রাচ্যভূমিই যে তাঁর অন্বিষ্ট সে সম্পর্কে সন্দেহ নেই। প্রাচ্যের অস্থি-মজ্জা, অনুভব-উপলব্ধির গভীর থেকে নিজেকে এবং উল্লিখিত ভূমিজ জগতের আবিষ্কার প্রয়াস তাঁর নাট্যরচনার প্রেরণা ও তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার আধেয়। পদতলে স্থিত এই ভূমি তাঁকে উদ্বেলিত করে, মাতৃমমতায় মথিত করে। অথচ আমাদের এই ভূমি তথা বৃহত্তর অর্থে প্রাচ্যকে পাশ্চাত্যবাসীরা ক্রমাগত বিবেচনা করে আসছিল পেশা হিসেবে। আবার এই প্রাচ্যভূমি আত্মপ্রকাশেও ‘অপরাগ’ বলে পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা বিশ্বব্যাপী যে প্রচারণা চালিয়েছে তার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়েছিলেন সেলিম। কীভাবে?
তিনি তাঁর নিজস্ব শিল্পভুবন স্বভূমে স্থিতকরণের মাধ্যমে প্রাচ্যকে প্রকাশ করে তুলেছেন। প্রাচ্য যে আপনার মধ্য দিয়ে আপনিই স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশিত হয়ে উঠতে পারে সে ঘোষণাও তিনি বজ্রকণ্ঠে দিয়েছেন। সে প্রমাণ পাওয়া যায় প্রাচ্যের বিশিষ্ট অভিনয়রীতি সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যে। অভিনয় শিল্পভাবনায় সেলিম প্রাচ্যভূমিকেই শাশ্বত ভেবেছেন― শাশ্বত ভেবেছেন প্রাচ্যের স্বতন্ত্র ও শক্তিধর প্রকাশশৈলীকেও। তাঁর ভাষায় : ‘পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের অভিনয় একেবারে বিপরীতমুখা।
বাস্তবের ক্রিয়া-কাহিনীকে সেখানে পাওয়া যাবে চরিত্রের ক্রিয়ার ধারাবাহিকতা হিসাবে। পক্ষান্তরে প্রাচ্যের অভিনয় হচ্ছে বর্ণনাকে ক্রিয়াতে রূপান্তর। অর্থাৎ বর্ণনাত্মক অভিনয়ের যে সকল রীতিতে কথক বা গায়েন আছে― তার কাজ কথাকে এমন একটা চলমানতা দান করা যা অনুকরণ সঞ্জাত ক্রিয়া নয়―যা সুর ও ছন্দের অবলম্বনে ব্যাখ্যাধর্মী।’ সেলিমের নাট্যচিন্তা সম্পর্কে সৈয়দ শামসুল হক বলেন : ‘সেলিম অনবরত সন্ধান করে চলেন প্রকাশের নতুনতর মার্গ; নতুন, কিন্তু বাঙলা ভাষার সৃষ্টিবুদ্ধি এবং হাজার বছরের ধারাবাহিকতার অন্তর্গত অবশ্যই।
বাঙলায় তিনি লেখেন কারণে বাংলার মানুষের অস্তিত্ব এবং জগৎ-বোধ, যাপিত জীবনের স্বপ্ন ও যন্ত্রণা তাঁর বিষয়― অপিচ তা বিশ্বের সকল মানুষেরই মানচিত্র হয়ে ওঠে বটে।’ সেলিম আল দীনের ক্ষোভ ছিল আমরা আমাদের মতো করে স্ব-ভূমি বা স্ব-ভূমিজ বস্তুনিচয় মায় শিল্প সাহিত্যের রসাস্বাদন করতে পারি না বলে; ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে পাশ্চাত্যের শিল্পতত্ত্বকে অজর-অমর-অক্ষয় এবং অভ্রান্ত হিসেবে গলাধকরণ করেছি বলে। পাশ্চাত্য-প্রণীত শিল্পতত্ত্বের আলোকে আমাদের স্ব-ভূমিজ শিল্প-সাহিত্যের বিশ্লেষণ-বিচারেই বেশি আগ্রহী বলেও তাঁর আক্ষেপ ছিল।
বাঙলা শিল্পসাহিত্যের নন্দনশৈলীর বিচারে পাশ্চাত্য শিল্পতত্ত্বের অন্ধঅনুসরণকে দৃঢ়তার সাথেই তিনি ভ্রান্ত বলে ঘোষণার মাধ্যমে তা প্রত্যাখ্যান করেন। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথকে মূল্যায়নেও আমরা যে সেই অপকৃষ্ট ও ভ্রান্ত মানদণ্ডই ব্যবহার করে আসছি সে সম্পর্কেও সেলিম সচেতন করে দেন। তাঁর মতে : ‘রবীন্দ্রনাথকে পাশ্চাত্য ধারার সাঙ্কেতিক রূপকতায় বিচার করতে গিয়ে এমন এক অনাকাঙিক্ষত স্থলে উপনীত হয়েছি যে―তা থেকে না সাঙ্কেতিকতা না রূপকতা বা রবীন্দ্রশিল্পতত্ত্ব কোনোটাকে―কোনো মতেই আর নিজেদের মতো করে বোঝা গেল না।’
তিনি উপলব্ধি করেছিলেন বাংলা নন্দনতাত্ত্বিক সঙ্কটের সূচনা ঔপনিবেশের হাত ধরেই ঘটেছিল। ফলে বাংলা নাটকের আঙ্গিক সঙ্কটের শুরু তখন থেকেই। অর্থাৎ তখন থেকেই আমরা উপলব্ধি করতে অক্ষম হয়ে পড়েছিলাম যে, বাংলা নাটকের রূপ-রীতি-আঙ্গিক কখনোই ইউরোপীয় থিয়েটারের আদলে নির্মিত হতে পারে না। আবার এ ভাবনাও অমূলক নয় যে, আমরা ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে উন্নত বিবেচনায় নিজেদের অবলোকনের ভ্রান্ত এক পন্থা অবলম্বন করেছিলাম।
এতদ্বিষয়ে সমালোচক বলেন : ‘সেলিম আল দীন পাশ্চাত্য নাট্যের যে গড়ন তা থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন, তার লক্ষণ সব নাটকেই রয়েছে―যদিও তার ধরন হয়তো ভিন্ন ভিন্ন। যেমন, পাশ্চাত্য নাটকে দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে চরম মুহূর্ত বা ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছানোর প্রায় কোনো বিকল্প নেই। সেই পরিচিত গড়ন কিন্তু সেলিম সচেতনভাবে বর্জন করেছেন, কারণ তিনি জানেন বাঙালির নাট্যচেতনার উৎস যেসব শিল্পকর্মে সেখানে ওই গড়ন নেই।’
সাম্প্রতিককালের শিল্প-মডেলে অনেকের মধ্যেই সেলিম ঔপনিবেশ বিরোধী মানসিকতার প্রকাশ দেখলেও তাদের মধ্যে তাত্ত্বিকভূমির সঙ্কট উপলব্ধি করেছেন। হাজার বছরের বাঙালির আত্মপ্রকাশ ভঙ্গির ধারাবাহিকতা পর্যবেক্ষণ ও অনুন্ধানজাত উপলব্ধিবোধের আদলে সেলিম তাঁর তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ছিলেন। যে তত্ত্বের ভিত্তিই হলো ঔপনিবেশ বিরোধী ও মননশীলতায় দেশজ শিল্পাদর্শ অভিমুখী।
তাঁর ভাষায় : ‘ সাম্প্রতিককালে বাংলা সাহিত্যের একটা ধারায় উপনিবেশকালের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যে তাত্ত্বিক লড়াইটা চলছে সেটা খুবই শক্তিশালী হয়ে উঠতো যদি না আমাদের মধ্যে ঔপনিবেশিক হীনমন্যতা অভ্রান্ত আসন করে না নিতো।’ উপরিউক্ত তাত্ত্বিক ভিত্তিটি দৃঢ়তর ছিল বলেই কেবল শিল্পভাবনার অনুষঙ্গেই নয় বরং তত্ত্বের আলোয় তাঁর জ্ঞানসাধনার সকল মার্গ― তাঁর জীবনবোধ, দর্শন, রাজনৈতিক সচেতনতা। সর্বোপরি বাংলার সমৃদ্ধ মানবকে পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করে সেই তাত্ত্বিকবোধ মাথা তুলে দাঁড়ায়।
সেলিম আল দীনের শিল্পচেতনার ভিত্তি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচতির অন্তর্নিহিত এইপর্বে এমন এক সত্যের দিকে ধাবমান হওয়া সম্ভব যেখানে দাঁড়িয়ে অন্তত আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সক্ষম যে, তিনি তাঁর স্বদেশ ও স্বদেশের মানবকৃত্যের মহাকাব্যিক প্রকাশ ও বিবেচনাকে নিজেদের শিল্পরুচি শিল্পতাত্ত্বিক পটভূমিতে স্থাপনপূর্বক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে উৎসাহী। যার শেকড় সহস্রবর্ষের বাংলা নন্দনভুবনের মার্গীয় সমৃদ্ধির ধারায় বাহিত। এই মার্গীয় পথের শিল্পসাধনায় সেলিম আল দীন হয়ে উঠেন যথার্থ অর্থেই স্বভূমির বরপুত্র নাট্যকার ও শিল্পতাত্ত্বিক।
নাট্যকার ও শিল্পতাত্ত্বিক হিসেবে সেলিম আল দীন তাঁর মেধা ও প্রজ্ঞার আলোয় উপলব্ধি করেছেন পাশ্চাত্য শিল্পবুদ্ধির আবেশায়নে বিভ্রান্তির এক চরম উৎকেন্দ্রিক পথে ধাবমান যাত্রী হয়ে ওঠা আমাদের সৃজনকলার সর্বগ্রাসী বিনাশ। সেই পতনের তামস-অন্ধকার থেকে প্রাচ্যের মৌলিক শিল্পদর্শনের নৈয়ায়িক শৃঙ্খলায়―আরো কেন্দ্রিভূত করে বললে বাংলার শিল্পসাহিত্য ও কৃষ্টিকলাকে সহস্রবর্ষের ঐতিহ্যিক শিল্পবুদ্ধি ও বিশ্লেষণের ধারায় সংযুক্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি।
সেলিমের গভীর বিশ্বাস ছিল পাশ্চাত্য-পণ্যসভ্যতার সর্বগ্রাসী সংবর্ত থেকে বাঙালির শিল্প ও শিল্পতত্ত্ব প্রাচ্যের বিবেচিত পথেই বিশ্বসাহিত্যের স্রোতধারাকে উজ্জ্বল করে তুলবে। তাই দৃঢ়তার সাথে তিনি তাঁর শিল্পচেতনায় অবস্থান করেন স্বদেশের বিস্তৃত পটভূমিকায়। আবার স্বভূমির ওপর দাঁড়িয়েই তিনি শিল্পচৈতন্যের বাহু প্রসারিত করেন শিল্পভাবনার বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে। সেলিম আল দীন পাঠ এবং পুনর্পাঠের মাধ্যম আমরা আজ এই শাশ্বত বোধ ও উপলব্ধির মুখোমুখি নৈকট্যে স্থির।
এইচআর/জিকেএস