দেশজুড়ে

শিক্ষা-ক্রীড়াঙ্গনে আলো ছড়াচ্ছেন রজত কাকু

নওগাঁর বদলগাছীতে শিক্ষা আর ক্রীড়াঙ্গনে আলো ছড়াচ্ছেন সমাজসেবী রজত গোস্বামী। তবে শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি কাকু নামেই পরিচিত।

Advertisement

সমাজসেবা অফিসের মাঠকার্মীর চাকরি করেন রজত গোস্বামী। ডিউটি শেষে বিকেলে পড়ান শিক্ষার্থীদের আর ডিউটি শুরুর আগে নারী হ্যান্ডবল দলের সদস্যদের প্রাকটিস করান। যেন দিনের শুরু এবং শেষ হয় সমাজসেবা দিয়ে।

রজত গোস্বামী ১৯৮৫ সালে এসএসসি, ১৯৮৭ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপরে আর পড়ালেখা করতে পারেননি। তবে ছোট থেকেই ঝোঁক ছিল খেলাধুলায়। চাকরির কারণে খেলাধুলায় ভালো করতে পারেননি। নিজে ভালো করতে না পারলেও থেমে যাননি। ১৯৯৯ সালে গড়ে তোলেন ‘মহিলা হ্যান্ডবল টিম’। সেই টিমের ছয় খেলোয়াড় এখন জাতীয় পর্যায়ে খেলছেন। মহিলা হ্যান্ডবল টিম গঠন করলেও অন্যান্য খেলায়ও অবদান রাখার চেষ্টা করতেন। তবে খেলতে আসা অনেকেরই অভিভাবক এবং স্কুল শিক্ষকের অভিযোগ ছিল তারা পড়াশোনায় ভালো করছে না।

তাই মানসিক প্রশান্তি ও এলাকার ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনায় আগ্রহী করতে ২০০৪ সালে নিজ উদ্যোগে ‘বিদ্যাসাগর ইনস্টিটিটিউট’ গড়ে তোলেন। প্রতিষ্ঠানটি মূলত অবৈতনিক শিক্ষাকেন্দ্র। এখানে নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পদার্থ ও রসায়ন বিষয়ে পাঠদান করেন তিনি। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মেধাশক্তি বাড়াতে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি সাধারণ জ্ঞানসহ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়েও পড়ান।

Advertisement

শিক্ষার্থীদের পাঠদানের সুবিধার জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বদলগাছী সাধারণ গ্রন্থাগারের দ্বিতীয় তলায় দুটি ঘরের ব্যবস্থা করেন। সেখানে প্রতিদিন বিকেলে শিফট করে নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। প্রতি শিফটে ২০-২৫ জন শিক্ষার্থী থাকে। এ পর্যন্ত ১৬টি ব্যাচ ওই প্রতিষ্ঠান থেকে বিদায় নিয়েছে।

প্রতিষ্ঠান থেকে বিদায় নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুজন বিসিএস চিকিৎসক, পুলিশে দুজন, আনসারে তিনজনসহ বিভিন্ন অফিসে চাকরি করছেন। এছাড়া বুয়েট, ঢাবিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন অনেকে।

বদলগাছী মডেল সরকারি পাইলট হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র শাহরিয়ার জুবায়ের, ছাত্রী সামিহা ইয়াসমিন সেবা, দশম শ্রেণির ছাত্র মাহিব হাসান ও গোবরচাপা হাট উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র মুবাশির হোসেন জানায়, পদার্থ, রসায়ন, গণিত ও ইংরেজি পড়ান তিনি। কোথাও প্রাইভেট পড়লে শুধু একটি বিষয়ে পড়া যায়। কিন্তু এখানে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি জাতীয়, আন্তর্জাতিক, সাধারণ জ্ঞানসহ সব বিষয়ে পড়ানো হয়। পাঠ্যবইয়ের বাইরে নতুন কিছু জানা ও শেখার জন্য আমরা আসি। এখান থেকে যারা বিদায় নিয়েছেন তারা বিভিন্ন অফিসে চাকরি করেন। ছুটিতে আসলে তারা ক্লাস ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। এছাড়া সাপ্তাহিক কোনো বিষয়ের ওপর কুইজ প্রতিযোগিতা হয়। যারা এখানে পড়ি তাদের কাউকে টাকা দিতে হয় না। কাকুকে টাকা দিতে চাইলেও তিনি নেন না।

সমাজসেবী রজত গোস্বামী বলেন, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের যুক্ত ছিলাম। যারা খেলাধুলায় অংশ নিতো তাদের বাড়ি থেকে প্রায় অভিযোগ আসত লেখাপড়া করে না। বিষয়টি জানার পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলি যেন তাদের বিনামূল্যে পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এতে অনেকেই অনীহা দেখান। এরপর থেকে বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থী দিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে পড়ানো শুরু করি। পরে নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। প্রতি বছর দুই ব্যাচে ৫০-৬০ শিক্ষার্থী পড়ার সুযোগ পায়।

Advertisement

‘সমাজের এ উন্নয়নকাজে প্রথমত বাবার (মৃত প্রণীব কান্ত গোস্বামী উদয়) কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েছি। পরে নিজ উদ্যোগেই কাজ করছি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে প্রতিষ্ঠানে আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি ও ব্যবহারিক কাজের যন্ত্রাংশ দিয়ে সাহায্য করেছেন জেলা প্রশাসক, স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউপি চেয়ারম্যান এবং গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ সহায়তা করেছেন।’

রজত গোস্বামী বলেন, জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার হ্যান্ডবল এবং ক্রিকেট কোচ, উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি ও ক্রীড়া সংস্থার কোষাধ্যক্ষ, বদলগাছী সাধারণ গ্রন্থাগার, স্পোর্টিং ক্লাবে যুক্ত আছি। বিভিন্ন সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করি।

পড়াশোনার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়াতে কুইজ প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার দেওয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, যেসব শিক্ষার্থীর আর্থিক সমস্যা রয়েছে তাদের কাগজ-কলমসহ শিক্ষা উপকরণ দেওয়া হয়। এছাড়া প্রতি বছর কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা, শীতবস্ত্র বিতরণ, প্রতিবন্ধীদের হুইল চেয়ার, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা ও দরিদ্রদের চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হয়। এসব আর্থিক সহায়তা বেশির ভাগ কিছু উৎসাহি ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া আর বাকিটা ব্যক্তিগত।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলতে প্রতিষ্ঠানটি বহুমুখী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হোক। প্রতিষ্ঠানটি টিকে রাখতে সবার সহযোগিতায় এগিয়ে আসা উচিত।

জাতীয় টিমে সুযোগ পাওয়া হ্যান্ডবল খেলোয়াড় পূর্ণিমা রানী বলেন, প্রায় ১০ বছর থেকে হ্যান্ডবলে যুক্ত আছি। আগে স্কুলে খেলতাম। পরে কাকুর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়ে ভালো করি। বর্তমানে জাতীয় হ্যান্ডবল টিমে খেলছি। এতো কিছুর পেছনে অবদান রেখেছেন রজত কাকু। যিনি দলের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছেন।

বদলগাছী উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা তারিকুল ইসলাম বলেন, শুনেছি তিনি দীর্ঘদিন ধরে পারিশ্রমিক ছাড়াই শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাচ্ছেন। ওইসব শিক্ষার্থীর অনেকে এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরিও করছেন। সমাজসেবা একটি মহৎ কাজ। তার জন্য অনেক শুভ কামনা।

তিনি আরও বলেন, সেখানে প্রতিবন্ধী বা দলিত সম্প্রদায়ের কোনো শিক্ষার্থী যাদের পরিবার শিক্ষার ব্যয় বহন করতে পারে না এমন কেউ থাকলে সমাজসেবা থেকে শিক্ষা উপবৃত্তির আওতায় আনা হবে।

এএইচ/জিকেএস