মুসলমানদের দলগত শক্তিকে অজেয় করে তোলার দুইটি প্রধান মূলনীতি হলো- আল্লাহকে ভয় করা এবং পারস্পরিক ঐক্য। আগের আয়াতে ঈমানদারদের মহান আল্লাহ তাকে ভয় করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর এ আয়াতে দ্বিতীয় মূলনীতি- মুসলিমদের পরস্পরিক ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছেন। বিচ্ছিন্ন হতে নিষেধ করেছেন এবং ঐক্যের সুফল ও আগের ইতিহাস স্মরণ করার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। যে নির্দেশনা মুসলিম জাতির শক্তির ভিত্তি মজবুত হয়; এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ঘোষণা দেন-
Advertisement
وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰهِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوۡا ۪ وَ اذۡکُرُوۡا نِعۡمَتَ اللّٰهِ عَلَیۡکُمۡ اِذۡ کُنۡتُمۡ اَعۡدَآءً فَاَلَّفَ بَیۡنَ قُلُوۡبِکُمۡ فَاَصۡبَحۡتُمۡ بِنِعۡمَتِهٖۤ اِخۡوَانًا ۚ وَ کُنۡتُمۡ عَلٰی شَفَا حُفۡرَۃٍ مِّنَ النَّارِ فَاَنۡقَذَکُمۡ مِّنۡهَا ؕ کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰهُ لَکُمۡ اٰیٰتِهٖ لَعَلَّکُمۡ تَهۡتَدُوۡنَ
‘তোমরা সবাই আল্লাহর রশি (দ্বীন ইসলাম বা কুরআন)কে শক্ত করে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ কর; তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করলেন। ফলে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকুন্ডের (জাহান্নামের) প্রান্তে ছিলে, এরপর তিনি (আল্লাহ) তা থেকে তোমাদের উদ্ধার করেছেন। এরূপে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর নিদর্শন স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন, যাতে তোমরা সৎপথ পেতে পার।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১০৩)
সুরা আল-ইমরানের ১০৩ নং আয়াত এটি। এ আয়াতে মহান আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসলামের ওপর অটল ও অবিচল থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। পরস্পর দলে দলে বিভক্ত হওয়া থেকে নিষেধ করেছেন। আয়াতটি মুসলিম উম্মাহর জাতিগত শক্তির ভিত্তি এবং আয়াতের সার নির্যাস হলো- ঐক্য একমাত্র ইসলামের ভিত্তিতেই সম্ভব।
Advertisement
আল্লাহ তাআলা আগের আয়াতে তাকে ভয় করার কথা বলার পর এ আয়াতে নির্দেশ দিচ্ছেন- ‘তোমরা সকলে আল্লাহর রশিকে শক্ত করে ধর’। এ নির্দেশ দিয়ে একটি বিষয় পরিষ্কার করে দিলেন যে, মুক্তিও রয়েছে এই দুই মূল নীতির মধ্যে এবং এই মূল নীতিরই ভিত্তিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতে ও থাকতে পারে।
ঐক্যের নির্দেশ দিয়েই আল্লাহ সঙ্গে সঙ্গে বলেন, وَلاَ تَفَرَقُّوا ‘পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ এর মাধ্যমে দলে দলে বিভক্ত হওয়া থেকে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ এ আয়াতে উল্লিখিত দুটি মূলনীতি থেকে যদি তোমরা বিচ্যুত হয়ে পড়ো তাহলে তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং ভিন্ন ভিন্ন দলে তোমরা বিভক্ত হয়ে যাবে। ফলে তোমরা ঐক্যহারা হয়ে যাবে। দুর্বল এক জাতিতে পরিণত হবে।
মুসলমানদের জাতিগত শক্তির ভিত্তি
وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰهِ جَمِیۡعًا
Advertisement
‘তোমরা আল্লাহর রুজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো।’- আয়াতের প্রথমাংশে পরস্পরিক ঐক্যের বিষয়টি অত্যন্ত সাবলীল ও বিজ্ঞজনোচিত ভঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে। এতে সর্বপ্রথম মানুষকে পরস্পর ঐক্যবন্ধনে আবদ্ধ করার চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরপর পরস্পরের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতে নিষেধ করা হয়েছে।
এ আয়াতে বিশ্লেষন হচ্ছে- ঐক্য ও বন্ধুত্ব যে প্রশংসনীয় কাজ তা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষই একমত। এতে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই। পৃথিবীতে এমন কোনো ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যে, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও বিবাদ-বিসংবাদকে উপকারী ও উত্তম মনে করে। এ কারণেই বিশ্বের সব দল ও গোত্রই জনগনকে ঐক্যবদ্ধ করার আহ্বান জানায়। কোরআনুল কারিমের অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-
اِنَّ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ سَیَجۡعَلُ لَهُمُ الرَّحۡمٰنُ وُدًّا
‘যারা বিশ্বাস করেছে এবং সৎকর্ম করেছে পরম দয়াময় তাদের জন্য (পারস্পরিক) ঐক্য-সম্প্রীতি সৃষ্টি করবেন।’ (সুরা মারইয়াম : আয়াত ৯৬)
বলাই বাহুল্য যে, বর্তমানে দলে দলে বিভক্ত হওয়ার দৃশ্য আমাদের সামনেই রয়েছে। কোরআন ও হাদিস বোঝার এবং তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ নিয়ে পারস্পরিক কিছু মতপার্থক্য থাকলেও তা কিন্তু দলে দলে বিভক্ত হওয়ার কারণ নয়।
এ ধরনের বিরোধ তো ইসলামের প্রথম যুগেও ছিল কিন্তু তাঁরা অনৈক্য সৃষ্টি করেননি এবং দলে দলে বিভক্ত হয়েও যাননি। কারণ, তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও সকলের আনুগত্য ও আকীদার মূল কেন্দ্র ছিল একটাই। আর তা হলো- কোরআন এবং প্রিয় নবির সুন্নাহ।
কিন্তু যখন ব্যক্তিত্বের নামে চিন্তা ও গবেষণা কেন্দ্রের আবির্ভাব ঘটলো, তখন আনুগত্য ও আকীদার মূল কেন্দ্র পরিবর্তন হতে লাগলো। আপন-আপন ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের উক্তি ও মন্তব্যসমূহ প্রথম স্থান দখল করলো এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের উক্তিসমূহ দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী হলো। ফলে এখান থেকেই মুসলিম উম্মাহর মাঝে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা শুরু হলো; যা দিনে দিনে বাড়তেই লাগল এবং বড় শক্তভাবে বদ্ধমূল হয়ে গেল।
সুতরাং মুসলিম উম্মাহর শক্তির ভিত্তি হোক কোরআন এবং সুন্নাহর দিকনির্দেশনা। যেখানে আছে আল্লাহকে ভয় করার নির্দেশ। পরস্পর ঐক্যের নির্দেশ। আবার বিছিন্ন না হওয়ার নিষেধাজ্ঞা। কারণ এ আয়াতে মুসলিম জাতি শক্তির ভিত্তি যেন সাহাবায়ে কেরামের মতো হয়; যারা পরস্পর শুত্রু থাকার পর ইসলামে এসে এক হয়ে গিয়েছিলেন। সে কথা আল্লাহ এভাবে তুলে ধরেছেন-
۪ وَ اذۡکُرُوۡا نِعۡمَتَ اللّٰهِ عَلَیۡکُمۡ اِذۡ کُنۡتُمۡ اَعۡدَآءً فَاَلَّفَ بَیۡنَ قُلُوۡبِکُمۡ فَاَصۡبَحۡتُمۡ بِنِعۡمَتِهٖۤ اِخۡوَانًا ۚ وَ کُنۡتُمۡ عَلٰی شَفَا حُفۡرَۃٍ مِّنَ النَّارِ فَاَنۡقَذَکُمۡ مِّنۡهَا ؕ کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰهُ لَکُمۡ اٰیٰتِهٖ لَعَلَّکُمۡ تَهۡتَدُوۡنَ
তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ কর; তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করলেন। ফলে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে গেলে।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১০৩)
শতাব্দীর পর শতাব্দীর শত্রুতা ও প্রতিহিংসার অনল থেকে বের করে মহান আল্লাহ তাআলা ইসলাম ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বরকতে তোমাদের ভাই ভাই করে দিয়েছেন। আউস ও খাজরাজ গোত্রের মতো অনেক গোত্রের দীর্ঘ শত্রুতা নিরসন করে আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার বুকে ঐক্য ও সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আর প্রমাণ করেছেন, ইসলামই জাতিগত শক্তির মূলভিত্তি। আর তা সম্ভব হয়েছে শুধু তাকওয়া ও পরস্পরিক ঐক্যের নির্দেশের কারণে।
কোরআনের আয়াতে এ বিষয়টিও প্রমাণিত যে, মুসলমানদের পাস্পরিক ঐক্য আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের ওপর নির্ভরশীল। কারণ অন্তরের মালিক হলেন আল্লাহ। সম্প্রীতি ও ঘৃণা সৃষ্টি করা তাঁরই কাজ। কোনো দলের অন্তরে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্প্রীতি সৃষ্টি করা আল্লাহ তাআলারই অনুগ্রহের দান। আর একথা সবারই জানা যে, আল্লাহর অনুগ্রহ একমাত্র তাঁর আনুগত্যের দ্বারাই অর্জিত হতে পারে। অবাধ্যতা ও গুনাহ দ্বারা এ অনুগ্রহ অর্জিত হওয়া সুদূরপরাহত।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআনের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী পারস্পরিক ঐক্য গড়ার তাওফিক দান করুন। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া থেকে সতর্ক থাকার তাওফিক দান করুন। কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা মেনে মুসলিম জাতির ঐক্য ও শক্তির ভিত্তি মজবুত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জিকেএস