জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। ২০ বছর ধরে কাজ করছেন বন্যপ্রাণী বাস্তুসংস্থান, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ নিয়ে। এসব বিষয়ে ছয়টি বইও লিখেছেন। পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন, জীববৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ ও প্রজাতি ব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি দেশ-বিদেশের অনেক সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছেন। দেশে বহুল আলোচিত ‘পাখি মেলা’র অন্যতম কর্ণধার তিনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা পরিযায়ী পাখি নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন কাজ করছেন। এসব বিষয়ে গুণী এ শিক্ষক কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে।
Advertisement
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক মাহবুব সরদার।
জাগো নিউজ: দেশে পাখি নিয়ে কি পরিমাণ গবেষণা হচ্ছে এবং সেগুলোর মান কেমন?
ড. কামরুল হাসান: দেশে অনেকে পাখি নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণী যেমন- উভচর, সরীশৃপ, স্তন্যপায়ীর তুলনায় পাখি নিয়ে গবেষণা নিবন্ধন খুবই কম। তবে অনেক শিক্ষার্থী এখন এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে। সব মিলে ইতিবাচক ফল আশা করা যায়।
Advertisement
জাগো নিউজ: পরিযায়ী পাখির মাধ্যমে বৈশ্বিক জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড. কামরুল হাসান: ২০১৫ সাল থেকেই এনিয়ে দেশের হাওর অঞ্চলে কাজ করছি। পরিচায়ী পাখির সঙ্গে দেশীয় হাঁসের সংমিশ্রণের ঘটনা ঘটছে। মৌসুমি হাঁস খামারিরা না জেনেই পরিযায়ী পাখির মূল আবাসে হাঁস ছেড়ে দেন। ফলে বিভিন্ন সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে।
জাগো নিউজ: দেশে অনেক প্রজাতির পাখি এখন বিপদাপন্ন। এ অবস্থায় পাখি সংরক্ষণাগার ও পাখি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রয়োজন মনে করেন কি না?
ড. কামরুল হাসান: দেশে এরকম আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা নেই। বন বিভাগ পাখিসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর বিষয় দেখভাল করে। মূলত দেশে বন্যপ্রাণী নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রই কম। যারা গবেষণা করছেন তারা পুরো বন্যপ্রাণী নিয়েই কাজ করছেন। তবে পাখি নিয়ে আলাদা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন বোধ করছি না।
Advertisement
জাগো নিউজ: আইন থাকলেও বিভিন্ন স্থানে পাখি শিকার চলছে। এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
ড. কামরুল হাসান: বন্যপ্রাণী আইন, ২০১২ অনুযায়ী দেশীয় প্রজাতির সব পাখিই সংরক্ষিত। কেউ তা ধরতে, বিক্রি করতে পারবে না, শিকার তো দূরের কথা। কিন্তু আইনের প্রয়োগ করতে বন বিভাগের যথেষ্ট লোকবল নেই। বন বিভাগের অপরাধ দমন ইউনিট নিয়মিত শিকারিদের ধরছে, শাস্তি দিচ্ছে। এখন আর প্রকাশ্যে পাখি বিক্রি হচ্ছে না। এক্ষেত্রে জনসচেতনতাই বড় হাতিয়ার।
জাগো নিউজ: রাজধানীর কাঁটাবনসহ বিভিন্ন স্থানে খাঁচায় রেখে পাখি বিক্রির বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
ড. কামরুল হাসান: ২০১২ সালের আগে সেসব স্থানে দেশি পাখিও বিক্রি হতো। পরে সংশোধিত আইনে দেশীয় পাখি শিকার ও বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে খাঁচায় পোষা যায় এমন পাখি বিক্রির অনুমতি তাদের রয়েছে।
জাগো নিউজ: পাখি মেলার ধারণা এলো কীভাবে? এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী?
ড. কামরুল হাসান: বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এনাম আল হক ২০০১ সালে জাবি ক্যাম্পাসে প্রথম জনসচেতনতামূলক এ মেলার আয়োজন করেন। এরপর ২০০৪ সাল থেকে প্রাণিবিদ্যা বিভাগ প্রতি বছর এ মেলা আয়োজন করে আসছে। মূলত পাখি একটা সংরক্ষণের বিষয়। যদি সংরক্ষণ না করি তাহলে অনেক প্রজাতি আছে যেগুলো হারিয়ে যাবে। জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্যই এ আয়েজন। এজন্য পাখি বিষয়ক অ্যাওয়ার্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমনকি শিশু-কিশোরদের পাখি সংরক্ষণের গুরুত্ব বুঝাতে পাখির চিত্র আঁকা প্রতিযোগিতাও চালু করা হয়েছে।
জাগো নিউজ: গত ২০ বছর লোকজন কতটা সচেতন হয়েছে বলে মনে করেন?
ড. কামরুল হাসান: যদিও প্রথম দিকে এটা ছিল ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক। কিন্তু এখন এটা জাতীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। লোকজন যখন দেখে পাখি সংরক্ষণের জন্য মেলা হচ্ছে তখনই সচেতনতার মাত্রাটা বাড়ে। সচেতনতার মাত্রা যখন আরও বাড়বে তখন আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতা মিলে পাখি সংরক্ষণের লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে। এ মেলা দেশের বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও হওয়া দরকার।
জাগো নিউজ: এ বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আগত পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কেমন?
ড. কামরুল হাসান: গত বছরের তুলনায় এ বছর পাখির সংখ্যা কিছুটা কম। নভেম্বরের দিকে প্রায় ৪ হাজার পাখি ছিল। কিন্তু এখন আনুমানিক ১ হাজার ৬০০ পাখি আছে।
জাগো নিউজ: পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ কী হতে পারে?
ড. কামরুল হাসান: স্বভাবতই এখন লোক সমাগম বাড়ছে। গত দুই বছর তেমন লোকজন ছিল না। পাখি সচরাচর যে লেকটায় বসে সেটার সমস্যা হচ্ছে তার ওপর থাকা টং দোকান। লেক আর দোকানের মাঝখানে আগে জঙ্গল দিয়ে আড়াল থাকত। কিন্তু এ বছর পেছনের জায়গা পুরোপুরি সমতল করা হয়েছে। লোকজন সবসময় সেখানে আড্ডা দিচ্ছে। এছাড়া কয়েকদিন ধরে পরিবহন চত্বর এলাকায় রাতে উচ্চ শব্দে গান বাজানো হয়েছে। ওই এলাকার লেকেই অনেক পাখি থাকে। হয়তো তারা এ শব্দে ভড়কে গেছে। এরকম আচরণ চলতে থাকলে পাখি অবশ্যই তুলনামূলক নিরাপদ জায়গা বেছে নেবে।
জাগো নিউজ: সম্প্রতি এক গবেষণায় জাবির লেকে ভারী ধাতুর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। পরিযায়ী পাখির ওপর এর প্রভাব কী হতে পারে?
ড. কামরুল হাসান: ভারী ধাতুর প্রভাবটা আসলে খুব সূক্ষ্ম। এতে মাইক্রো পর্যায়ের বাস্তুসংস্থান নষ্ট হবে। এটার প্রভাব এত দ্রুত পড়বে না। হয়তো ধীরে ধীরে এর প্রভাব পড়বে। তবে এটা বড় ধরনের হুমকি।
জাগো নিউজ: পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যেগকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড. কামরুল হাসান: পাখির নিরাপত্তা নিশ্চিতে লেকের আশপাশে বেড়া দেওয়া হয়েছে, বিলবোর্ড টাঙানো আছে। অনেক ক্ষেত্রে কর্তব্যরত গার্ডরাও লেকের পাশে দর্শনার্থীদের গাড়ি পার্কিং করতে দিচ্ছে না। দর্শনার্থীরা যেন পাখির খুব কাছে না যায় সে বিষয়টা আরও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। উপযুক্ত সময়ে লেক পরিষ্কারের ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
জাগো নিউজ: গুরুত্বপূর্ণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. কামরুল হাসান: জাগো নিউজকেও ধন্যাবাদ।
এএইচ/জিকেএস