অর্থনীতি

ইভ্যালি: তদন্তে ধীরগতি, অন্ধকারে গ্রাহক

ইভ্যালির সিইও-এমডি কারাগারে। প্রতিষ্ঠান বন্ধ। দিন যত গড়াচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিতে আটকে থাকা টাকা ফেরত পাওয়ার আশা তত ছাড়ছেন গ্রাহক। ইভ্যালি নিয়ে সিআইডির তদন্ত, হাইকোর্ট গঠিত পরিচালনা পর্ষদও নীরব। অর্থ সংকটে ভুগছে খোদ পর্ষদ। তদন্ত থেকে সরে এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে ইভ্যালি কি যুবক, ডেসটিনির পরিণতি ভোগ করবে? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাহকের টাকা ফেরত না দিতে পারলে কখনোই আস্থা ফিরবে না ই-কমার্সখাতে।

Advertisement

গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর গ্রাহকের করা প্রতারণার মামলায় আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। প্রতিষ্ঠানটির সব অফিস বন্ধ হয়ে যায়। এর এক মাস পরে বন্ধ হয় ইভ্যালির ওয়েবসাইট ও অ্যাপ। গত অক্টোবরের পর ইভ্যালির ফেসবুক পেজে কোনো পোস্ট হয়নি। গ্রাহকরা কার কাছে কীভাবে টাকা চাইবেন সেটার মতোই ঠিক কত গ্রাহক ইভ্যালি থেকে পণ্য কেনা বাবদ টাকা পায় তাও অজানা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ডিজিটাল ই-কমার্স পরিচালন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি বলছে- গ্রাহক, মার্চেন্ট ও অন্যান্য সংস্থার কাছে ইভ্যালির দেনা ৫৪৩ কোট টাকা। প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক রয়েছে দুই লাখের বেশি। তবে প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ পরিমাণ একশ কোটি টাকার কম। যদিও র্যাবের দাবি, ইভ্যালি থেকে গ্রাহক মার্চেন্টের পাওনা এক হাজার কোটি টাকার বেশি।

তদন্তে ধীরগতি, পরিচালনা পর্ষদের কাছে টাকা নেই জানা যায়, গত বছর সেপ্টেম্বরের পর সারাদেশে রাসেল দম্পতির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে পণ্য কিংবা টাকা ফেরত না দিতে পারার অভিযোগে এসব মামলা হলেও পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা পড়েনি। এর মধ্যে চার মামলায় জামিনও হয়েছে এই দম্পতির। গত বছরের সেপ্টেম্বরেই মামলা চলে যায় সিআইডিতে। সেখানেও অগ্রগতি নেই।

Advertisement

সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির জাগো নিউজকে বলেন, ইভ্যালির বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের যে অভিযোগ এসেছে তা অনুসন্ধান করছি। হাইকোর্টের নির্দেশে ইভ্যালির নতুন চেয়ারম্যান-এমডি নিয়োগ হয়েছে। তাদের সহায়তা ছাড়া আমরা বেশিদূর এগোতে পারবো না। আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে একটি তদন্ত করছি। এর বেশি ইভ্যালি নিয়ে আমরা কিছু বলতে পারবো না।

ইভ্যালির আইনি দলের সমন্বয়ক ব্যারিস্টার অ্যান্ড সলিসিটর নিঝুম মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, আমরা যতদূর জানি মানি লন্ডারিংয়ের ইস্যু সিআইডি পায়নি। সিআইডির কর্মকর্তাদের কয়েকজন আমাকে জানিয়েছেন, ইভ্যালির মালিকদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের কোনো প্রমাণ পায়নি তারা। দুদকও তদন্ত থেকে সরে এসেছে

ইভ্যালি নিয়ে গ্রাহকের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দেয় গত বছরের অক্টোবরে। সাবেক বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে করা হয় পর্ষদের চেয়ারম্যান। আর সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলনকে নিয়োগ দেওয়া হয় ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে। পর্ষদ গঠনের চার মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত ইভ্যালির অডিট বা নিরীক্ষা হয়নি।

এ প্রসঙ্গে মাহবুব কবির মিলন জাগো নিউজকে বলেন, ইভ্যালি নিয়ে এখনো কোনো আপডেট নেই। কোনো কিছু বলতে পারছি না। সবকিছু খোলাসা করতে আরও সময় লাগবে। আমরা খুব অর্থ সংকটে আছি। অডিট ফার্ম যে টাকা চেয়েছে, সেটা আমাদের নেই। আমরা সবকিছু আদালতে উপস্থাপন করবো।

Advertisement

তফসিলভুক্ত নয় বলে ইভ্যালি তদন্ত থেকে সরে আসে দুদক গত ১৯ সেপ্টেম্বর ইভ্যালির অনিয়মের তদন্ত থেকে সরে আসে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈন উদ্দিন আব্দুল্লাহ বলেন, ই-কমার্স বা ইভ্যালির দুর্নীতি দুদকের সিডিউলভুক্ত অপরাধ নয়। মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টি দেখে আমরা আমলে নিয়েছিলাম। এখন মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়সহ সবকিছু অন্য সংস্থা তদন্ত করবে।

এর আগে ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে ইভ্যালির বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছিল দুদক। এমনকি তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. রাসেলের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরুর চার মাস পর একথা জানান দুদক চেয়ারম্যান।

গত বছরের ৪ জুলাই ইভ্যালির বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দুদকসহ চার প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তখনই দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী ও উপ-সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ শিহাব সালামের সমন্বয়ে টিম গঠন করে অনুসন্ধান শুরু করে সংস্থাটি। ৯ জুলাই দুদকের অনুসন্ধান টিমের সুপারিশের ভিত্তিতে ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও এমডি মো. রাসেলের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।

টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে আছে সংশয়ইভ্যালির এমডি, সিইও গ্রেফতার হলে তাদের মুক্তির দাবিতে বেশ কয়েকবার মানববন্ধন করে গ্রাহক, মার্চেন্টদের একাংশ। একই দাবিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও পরিচালনা পর্ষদে গণস্বাক্ষর জমা দিয়েছে তারা। তবে অধিকাংশ গ্রাহকের ধারণা ইভ্যালি থেকে টাকা ফেরত পেতে অনেক কাঠখড় পোহতে হবে।

ইভ্যালি নিয়ে আন্দোলনের সমন্বয়ক মো. নাসির উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, আমরা আন্দোলন কমিয়ে দিয়েছি। গণস্বাক্ষর সরকারেরর বিভিন্ন দপ্তরে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি। এই পরিচালনা পর্ষদ কোনোভাবে কাউকে টাকা ফেরত দিতে পারবে না। তাদের কাছে কোনো প্রকার তথ্য তো নেই, টাকা দেবে কীভাবে। রাসেল ভাই ছাড়া এ সমস্যার সমাধান হবে না।

সিরাজুম নামে এক বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, আমি ৯৬ হাজার টাকার প্রোডাক্ট অর্ডার করেছিলাম। সেগুলো পাইনি, পরে দোকান থেকে কিনেছি। শুনেছি অনেকের কোটি টাকা আটকে আছে। কবে টাকা পাবো তা নিয়ে কোনো নির্দেশনা না থাকায় মনে হচ্ছে টাকাটা মার যাবে।

ই-ক্যাবের জেনারেল ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম শোভন মনে করেন, গ্রাহকের টাকা ফেরত না দিতে পারলে ই-কমার্সখাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না আস্থার সংকটে। আর দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলমের মতে, টাকা পাওয়ার আইনি প্রক্রিয়া অনেক জটিল। এতে গ্রাহকের টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই ক্ষীণ।

এসএম/এএ/জেআইএম