২০০৬ সালের শেষের দিকে দিনাজপুর শহরের ঈদগাহ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন পার্বতীপুর উপজেলায় ইন্দ্রপুর হাইস্কুলের শিক্ষক ফজলুর রহমান। প্রথমদিনে বিদ্যালয়ে এসে দেখলেন মোট ৪৬ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত। বার্ষিক পরীক্ষায় পেলেন ৯১ জন। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে বৈঠক করলেন। সবার সহযোগিতা চাইলেন। এরপর ছুটলেন বিভিন্ন সরকারি ও ব্র্যাক পরিচালিত স্কুলগুলোতে এবং এতিমখানায়।
Advertisement
প্রথম বছরেই সফলতা পেলেন। স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৫৪৫ জনে। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হারও বাড়লো, ৯০ শতাংশের বেশি। তৈরি করলেন ফুটবল টিম।
সবকিছুই ঠিকঠাকভাবে চলছিল। তবে বাধা হয়ে দাঁড়াই বাল্যবিয়ে। শিক্ষক ফজলুর রহমান খেয়াল করলেন, ছাত্রীদের উপস্থিতির হার কমে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি ছুটতে লাগলেন। বাল্যবিয়ে নামিয়ে আনলেন শূন্যের কোঠায়।
তবে বৈশ্বিক মহামারি করোনার সময় বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় আবারও শুরু হয় বাল্যবিয়ে। প্রধান শিক্ষক ফজলুর রহমানের কাছে একের পর এক ফোন আসতে থাকে—‘স্যার, আমাকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে, আমাকে বাঁচান, আমি পড়তে চাই, খেলতে চাই’, ‘স্যার, আমার ক্লাসের সহপাঠী অমুককে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে তার বাবা-মা’।
Advertisement
ফোন পেয়ে ছুটে যান অভিভাবকের বাড়িতে। প্রতিরোধ করেন বাল্যবিয়ে। এভাবে শতাধিক ছাত্রীর বাল্যবিয়ে ঠেকিয়ে দিয়েছেন ফজলুর রহমান। তবে মাঝে নিজে করোনা আক্রান্ত হওয়ার কারণে ঠেকাতে পারেননি ১৯ ছাত্রীর বাল্যবিয়ে।
প্রধান শিক্ষক ফজলুর রহমানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছুটির পর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা স্কুল গেট ত্যাগ করার পরই নিজ কক্ষে ঢুকে পড়তেন ফজলুর রহমান। হাজিরা খাতা খুলে দেখতেন অনুপস্থিত কারা। এরপর ডায়েরিতে তাদের নাম-ঠিকানা লিখে শিক্ষার্থীদের বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তেন। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলতেন। লেখাপড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ করছেন। এর সুফলও পেয়েছেন তিনি।
ফজলুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই নিম্নআয়ের পরিবার থেকে আসা। এমনও অনেক শিক্ষার্থীর মা-বাবা আছেন তারা জানেনই না মেয়ে কোন ক্লাসে পড়ে।
তিনি বলেন, ২০০৬ সালে বিদ্যালয়ে যোগদানের দিনে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী উপস্থিতি পেয়েছিলেন ৯১ জনের মধ্যে ৪৬ জন। পরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৪৫ জনে। গড়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতি ৯০ শতাংশেরও বেশি।
Advertisement
ফজলুর রহমান জানান, যোগদানের পর থেকেই তিনি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ঝরেপড়া রোধে কাজ করছেন। ২০০৭ সালে শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওই বছর মার্চ মাসে একদিন শিক্ষার্থীদের হাজিরা খাতা নিয়ে বসেছিলেন। হঠাৎ চোখ আটকে যায় অষ্টম শ্রেণির হাজিরা খাতায়। ২২ দিন ধরে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত শাহিনা আক্তার। ফাইলপত্র ঘেঁটে ঠিকানা চিরকুটে লিখে বেরিয়ে পড়েন ওই শিক্ষার্থীর বাসার উদ্দেশ্যে। উপশহর এলাকায় গিয়ে শিক্ষার্থীর মায়ের কাছে জানতে পারেন কয়েকদিন আগে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন তারা। সেদিনই ফজলুর রহমান সিদ্ধান্ত নেন বিদ্যালয়ের আর কোনো শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ে হতে দেবেন না। সব শিক্ষার্থীকে স্কুলমুখী করবেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করেন ফজলুর রহমান। শিক্ষার গুরুত্ব ও বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে সচেতনতামূলক লিফলেট তৈরি শুরু করেন। রুটিন করে সেই লিফলেট নিয়ে ছুটতে লাগলেন অভিভাবকদের কাছে। ধীরে ধীরে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়তে থাকলো।
অবাক করার বিষয় হলো বিদ্যালয়ের পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীর বাসা চেনেন ফজলুর রহমান। প্রতিটি শিক্ষার্থীর নাম যেমন বলতে পারেন তেমনি বলতে পারেন ওই শিক্ষার্থীর বাবা-মা পেশায় কী করেন, কোথায় থাকেন।
শহরের কসবা এলাকার বাসিন্দা আশামনি। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেন। রাতে মায়ের মুখে বিয়ের কথা শুনে সারারাত ঘুমাইনি। সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হেডস্যারের বাসায় যাই। স্যারকে সবকিছু খুলে বলি। তারপর স্যার বাবার সঙ্গে কথা বললে তিনি বিয়ে বন্ধ করে দেন।’
বর্তমানে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে চার বছর মেয়াদি রেডিওগ্রাফি বিষয়ে পড়াশোনা করছেন আশামনি।
বুধবার (১২ জানুয়ারি) বিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায় স্কুল ভবনের দেওয়ালে ইভটিজিং ও বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে দেওয়াল লিখন। কথা হয় প্রধান শিক্ষক ফজলুর রহমানের কক্ষে বসে। দেখা গেলো বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আসছে শিক্ষার্থীরা। সমাধানও দিচ্ছেন তিনি। প্রতিটি শিক্ষার্থীর নাম যেন ঠোঁটের আগায় লাগানো তার। এক শিক্ষার্থীকে তোমার বাবা কী করেন জানতে চাইলে হাত চেপে ধরেন প্রধান শিক্ষক ফজলুর রহমান। বললেন, কোনো শিক্ষার্থীকেই তার বাবা-মা কী করেন, এই প্রশ্ন করতে দিতে চান না তিনি। কারণ হিসেবে জানালেন, বাবা-মায়ের পেশাগত অবস্থার বিষয়ে তাদের মনে যেন কোনো ধরনের হীনমন্যতা তৈরি না হয় সেজন্যই এই প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যেতে চান তিনি।
ফজলুর রহমান বিদ্যালয়ে চালু করেছেন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। প্রতি বৃহস্পতিবার ছুটির পরে একজন চিকিৎসক সেখানে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের স্বাস্থ্যসেবা দেন। সামান্য কিছু ওষুধপত্রও দেওয়া হয় সেখান থেকে। বিদ্যালয়ে চালু আছে মিড-ডে মিল। দেওয়া হয় মেয়েদের ঋতুকালীন সেবা। নিয়মিত ১০ জন শিক্ষকের পাশাপাশি খণ্ডকালীন শিক্ষকও রয়েছেন ছয়জন। আর এসব কাজে তাকে সহায়তা করছেন তার এক শিল্পপতি নিকটাত্মীয়।
এমন উদ্যোগী কর্মকাণ্ডের জন্য অভিভাবকসহ সমাজের অনেকের কাছে এখন প্রশংসনীয় ও পরিচিত মুখ ফজলুর রহমান। বিদ্যালয়ে নিয়মিত অভিভাবক সমাবেশ করান তিনি। অভিভাবকদের একজন জাহানারা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার তিন মেয়েকে ফজলু স্যারের স্কুলে দিয়েছিলাম। বড় মেয়ে এখন অনার্সে পড়ছে। ফজলু স্যার না থাকলে আমার মেয়ে হয়তো এতদিনে সংসার করতো, পড়াশোনার স্বপ্ন দেখতে পারতো না। আমাদের লাইনপাড়ার এমন কারো বাড়ি নেই ফজলু স্যার আসেননি।’
সহকারী শিক্ষক নরেশ চন্দ্র সেন বলেন, ‘বর্তমান হেডস্যার স্কুলে আসার পরে স্কুলে শুধু শিক্ষার্থী সংখ্যাই বাড়েনি, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের স্কুল এগিয়েছে। তার সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমরা গর্ববোধ করি।’
দীর্ঘ ১১ বছর ধরে বিদ্যালয়টির ব্যবস্থাপনা কমিটিতে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন সাইদুর রহমান (৬৫)। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি যখন সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করি তখন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ছিল ১৫৮ জন। শহরের মধ্যে এত বড় স্কুল কিন্তু শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম ছিল। আমরা বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের মাঝে পোশাক ও শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ শুরু করি। এরই মধ্যে প্রধান শিক্ষক নিজ উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে বিদ্যালয়টির পরিবর্তন আসতে থাকে।’
এতকিছুর পরও চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন ফজলুর রহমান। জানালেন, করোনা পরিস্থিতিতে শতাধিক বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে পারলেও ঠেকাতে পারেননি ১৯ শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ে। তিনি বলেন, প্রথম যখন এই কাজ শুরু করি তখন নানা জনে নানা কু-মন্তব্য করেছেন। কিন্তু থেমে থাকিনি। জীবনে কী পেলাম আর কী পেলাম না সেটা বড় কথা নয়; সুবিধাবঞ্চিত হতদরিদ্র শিক্ষার্থীদের হাসিমুখ দেখলেই ভালো লাগে। শুনতে ভালো লাগে যখন একজন অভিভাবক রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলে, ‘আপনার জন্য মেয়েটা আজ কলেজে পড়তে পারছে’।
ফজলুর রহমানের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে দিনাজপুর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সানিউল ফেরদৌস (শিক্ষা ও আইসিটি) বলেন, ফজলুর রহমান শিক্ষকদের জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। অন্যান্য শিক্ষকদের উচিত ফজলুর রহমানের কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদেরও এগিয়ে আসা।
সদ্যবিদায়ী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আশরাফুল হক প্রধান জাগো নিউজকে বলেন, ফজলুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া ও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কাজ করছেন। তার চেষ্টায় ঝরে পড়ার হাত পাঁচ শতাংশেরও নিচে নেমেছে।
নারী ফুটবল টিম গঠন
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে নারী ফুটবল টিম গঠন করেছেন প্রধান শিক্ষক ফজলুর রহমান। এই টিম এখন সারাদেশ মাতিয়ে বেড়াচ্ছে। তবে প্রথম দিকে তার এ উদ্যোগ দেখে নাক ছিটকিয়েছে অনেকে।
বুধবার বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা হয় ফুটবল টিমের সদস্য আইরিন, তারা ও তনিমার সঙ্গে। আইরিন জানায়, পরিবার থেকে তাকে বাল্যবিয়ে দিচ্ছিল। প্রধান শিক্ষক ফজলুর রহমানকে বিষয়টি জানালে তিনি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বিয়ে বন্ধ করার ব্যবস্থা করেন। সে এবার এসএসসি পাস করেছে।
এমদাদুল হক মিলন/এসআর/জিকেএস