১২ জানুয়ারি বুধবার। আজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। উচ্চতর গবেষণার জন্য ১৯৭১ সালের এদিনে প্রতিষ্ঠিত হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়। ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক মানের তিন হাজার ৮৯৮ গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র ৭২ গবেষণায় অর্থায়ন করা হয়েছে।
Advertisement
আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনডেক্স ‘স্কোপাস’-এর তথ্য অনুসারে, ১৯৭৪ সাল থেকে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত গবেষণাগুলোর মধ্যে জাপান সোসাইটি ফর দ্যা প্রমোশন অব সায়েন্স ৮৮টি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ৭৮টি ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ৬৬টি গবেষণায় অর্থায়ন করে। এছাড়াও দেশী-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জাহাঙ্গীরনগরের গবেষকদের অর্থায়ন করেছে।
গত ৫১ বছরে ২০২১ সালে সবচেয়ে (৬৯২টি) বেশি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। যার মধ্যে মাত্র ৩৩টি গবেষণায় অর্থায়ন করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে জাবিতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ২৬৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এরমধ্যে গবেষণায় বরাদ্দ ছিল মাত্র চার কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে গবেষণায় বরাদ্দ ছিল তিন কোটি টাকা।
Advertisement
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিস জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৩৮১টি, ২০২০-২১ অর্থ বছরে ৩৮২টি, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ৩৬৪টি ও ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৩৬৫টি গবেষণার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এভাবে প্রতিবছর প্রায় তিন শতাধিক গবেষণা প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষকদের কাছে বার্ষিক বরাদ্দের অধীনে প্রকল্পের চাহিদা আহ্বান করা হয়। শিক্ষকদের গবেষণার প্রস্তাবনার চাহিদার প্রেক্ষিতে বার্ষিক বরাদ্দের টাকা ভাগ করে দেওয়া হয়। গত সেশনে গবেষণায় বরাদ্দ এক কোটি টাকা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রত্যেক প্রকল্পের বিপরীতে শিক্ষকরা প্রায় এক লক্ষ টাকা করে বরাদ্দ পেয়েছেন।
কিন্তু স্কোপাসে দেখা যায়, ২০২১ সালে ৩৩টি, ২০২০ সালে ১৬টি, ২০১৯ সালে দুটি এবং ২০১৮ সালে মাত্র চারটি গবেষণা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ পায়। যে গুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় অর্থায়ন করেছিল।
গবেষণাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক (১১৫টি) গবেষণা প্রকাশিত হয় আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘ফিজিক্স অব প্ল্যাজামা’তে। এছাড়া জার্নাল অব অর্গানোমেটালিক কেমিস্ট্রিতে ৯৬টি এবং ‘অ্যাডভান্সেস ইন ইন্টিলিজেন্ট সিস্টেম অ্যান্ড কম্পিউটিংয়ে ৪৫টি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।
Advertisement
এসব গবেষণা নিবন্ধের মধ্যে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ এ মামুনের ৪০০টি, রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরের ২০৫টি, আইআইটি অধ্যাপক মো. শামীম কায়সারের ১২৫টি, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ সলিমুল্লাহের ১০৩টি, রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক শিশির ঘোষের ১০০টি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের আব্দুল্লাহ আল মামুনের ৮১টি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২৬৯টি, পরমানু শক্তি কমিশন ১২১টি, এটমিক এনার্জি রিসার্চ এস্টাব্লিশমেন্ট ১১৭টি, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় ১১৭টি, নটিংহ্যাম ট্রেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় ১১০টি গবেষণা করেছে। এছাড়াও ইনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনসহ দেশী-বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গবেষণা করেছে।
এছাড়াও দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্য, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবের গবেষকদের সঙ্গে গবেষণা করেছে জাবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
স্কোপাসের তথ্য মতে, গত পঞ্চাশ বছরে সবচেয়ে বেশি গবেষণা হয়েছে পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোর্তিবিদ্যা বিষয়ে। যা মোট গবেষণার ১২ শতাংশ। এছাড়া কম্পিউটার সায়েন্স ৯, মেডিসিন ৯, রসায়ন ৮.৫, প্রকৌশল ৭, পরিবেশ বিজ্ঞান ৭, সমাজবিজ্ঞান ৫ এবং অন্যান্যতে ২৫ শতাংশ গবেষণা হয়েছে। অনুষদ ভিত্তিতে সবচেয়ে কম গবেষণা হয়েছে কলা ও মানবিকী অনুষদে। গত ৫১ বছরে মাত্র ৪৮টি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে।
কলা ও মানবিকী অনুষদে সবচেয়ে কম গবেষণার বিষয়ে অনুষদটির ডিন অধ্যাপক ড. মো. মোজাম্মেল হক জাগো নিউজকে বলেন, কলা ও মানবিকী অনুষদের গবেষণার বিষয়বস্তুগুলো সাধারণ দেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয় হয়ে থাকে। যেমন পাহাড়পুর কিংবা ওয়ারী বটেশ্বর। বৈশ্বিক গবেষণায় একটি দেশের অভ্যন্তরীণ এসব বিষয় খুব একটা স্থান পায় না। তাই এ অনুষদ থেকে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংখ্যা কম। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক মানের গবেষণায় যে পরিমাণ বরাদ্দ থাকা দরকার বিশ্ববিদ্যালয় তা দেয় না।
এ বিষয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এ মামুন জাগো নিউজকে বলেন, এর মূল কারণ হলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে কোনো গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি নিতে হয়। অনুমতির বিষয়ে ঝামেলা এড়াতে অনেকেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করতে আগ্রহ দেখায় না। আরও সবচেয়ে বড় বিষয়টা হলো, গবেষণার জন্য যে পরিমাণ অর্থায়ন করা হয় তা দিয়ে আসলে গবেষণার তেমন কিছুই হয়। আরও একটি বড় সমস্যা হলো এ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সংস্কৃতি এখন পুরোপুরি চালু হয়নি।
এ বিষয়ে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, গবেষণার জন্য আগ্রহ, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং সেটার জন্য কার্যকারিতা থাকতে হবে। প্রথমত, রাষ্ট্র বা সরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে কিভাবে দেখতে চায় সেটার ওপর গবেষণা অনেকটা নির্ভর করে। আমাদের দেশে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখে তার সমর্থক গোষ্ঠী তৈরির কারখানা হিসেবে। তার প্রতি অনুগত শিক্ষক-শিক্ষার্থী থাকবে। তাদের রাজনৈতিক প্রভাব নিশ্চিত হবে এমন প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ভেতরে যতটুকু গবেষণার সুযোগ থাকা উচিত সেখানেও উদ্যোগের অভাব আছে। এছাড়া পঞ্চাশ বছরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই কোনো নিজস্ব প্রকাশনা সংস্থা। তৃতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শিক্ষা ও গবেষণায় আগ্রহীদের প্রাধান্য নিশ্চিত করার কথা। কিন্তু এখানে শিক্ষা ও গবেষণায় যাদের আগ্রহ নাই তাদের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তারা বেশ ক্ষমতাবান। সরকার ও প্রশাসন তাদের অনেক পছন্দ করেন। এধরনের লোকজন যদি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে এখানে শিক্ষা ও গবেষণার কোনো ভবিষ্যৎ নাই।
এ বিষয়ে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মো. নুরুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, শিক্ষকেরা যে রকম রিসার্চ প্রস্তাবনা দেন, তার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় অর্থায়ন করে থাকে। রিসার্চ প্রস্তাবনা দিয়ে আবেদন করলে আমরা কোনো শিক্ষককে অর্থায়ন থেকে বঞ্চিত করি না। শিক্ষকরা যদি আবেদন না করে তাহলে তো অর্থায়ন করা যায় না। গবেষণার বরাদ্দ নিয়ে শিক্ষকরা সেসব ফলাফল সেমিনারের মাধ্যমে উপস্থাপন করে থাকেন। অনেক গবেষণা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত না হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ জার্নাল গুলোতে প্রকাশিত হয়।
মাহবুব সরদার/আরএইচ/এএসএম