একুশে বইমেলা

বইমেলা নিয়ে শঙ্কিত কবি-লেখকরা

অমর একুশে বইমেলা আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলছে মেলার আয়োজন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তাই বইমেলা নিয়ে শঙ্কিত কবি-লেখকরা। সেসব শঙ্কা নিয়েই আজকের আয়োজন—

Advertisement

কবি ও প্রাবন্ধিক বীরেন মুখার্জী বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী অমর একুশে বইমেলা এবছর হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট লাফিয়ে বাড়ছে, এটিই শঙ্কার অন্যতম কারণ। তারপরও একটি পরিচ্ছন্ন বইমেলা প্রত্যাশা করি। লেখক হিসেবে চাই, মানহীন বই প্রকাশ না হোক। নতুন লেখকদের বই যথাযথ সম্পাদনার মাধ্যমে পাঠকের হাতে পৌঁছাক। মেলা অভ্যন্তরে খাবারের স্টলে ডাকাডাকি বন্ধ হোক। খাবারের মান এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা হোক। লিটল ম্যাগ কর্মী হিসেবে চাইবো লিটল ম্যাগ কর্নারে প্রকৃত লিটল ম্যাগের নামে স্টল বরাদ্দ করা হোক এবং স্টলের পরিসর বাড়ুক। ম্যাগ কর্নারে কর্মীদের আড্ডা ও বিশ্রামের জন্য বসার জায়গা বানানো হোক।’

কবি ও কথাসাহিত্যিক নুসরাত সুলতানা বলেন, ‘একুশে বইমেলা আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির শক্তিশালী প্রতিনিধিত্বকারী উৎসবমুখর আয়োজন। প্রতিবছর মেলাকে কেন্দ্র করে উদ্ভাবিত হয় নতুন লেখক এবং পাঠক। তাই মেলাকে আরও আনন্দপূর্ণ ও উপভোগ্য করে তুলতে কিছু বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে চাই। যেসব প্রকাশকের নিজস্ব প্রকাশিত বই নেই, তারাও অনেক বড় স্টল নিয়ে বসে থাকেন। এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ যথাযথ দৃষ্টিপাত করবেন। মেলায় প্রচুর বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা থাকা এবং পয়োনিষ্কাশন ও পানির যথাযথ ব্যবস্থা থাকা। করোনা পরিস্থিতি এবং ওমিক্রনের বিষয়টি মাথায় রেখে মেলায় মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করা। সাধারণ ক্রেতার সামর্থ অনুযায়ী স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের দোকান নিশ্চিত করা। লিটল ম্যাগ চত্বরে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এবছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ। তাই বইমেলাকে কেন্দ্র করে লেখক, প্রকাশক, পাঠক সবারই প্রত্যাশা অনেক। সেই প্রত্যাশা পূরণ হোক।’

কবি ও কথাসাহিত্যিক ইভান অনিরুদ্ধ বলেন, ‘এবারের বইমেলা নিয়ে কয়েকদিন আগেও খুব আশাবাদী আর ফুরফুরে মেজাজে ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে করোনার ঢেউ যেভাবে ধেয়ে আসছে, তাতে এখন বেশ হতাশা আর বিপন্ন বোধ করছি। আগে নিজেদের জীবন রক্ষা, তারপর শিল্প-সাহিত্য চর্চা। তবে মনেপ্রাণে চাইছি এবারের বইমেলা যেন করোনার কারণে পণ্ড না হয়। সব শ্রেণির লেখকের লালিত স্বপ্ন বইমেলায় তার নতুন বইটি আসবে। আমারও দুটি নতুন বই, ছোটগল্প সংকলন ‘গল্পশ্রী’ এবং কবিতার বই ‘তুমি নেই, তোমার বন্ধন পড়ে আছে’ আসছে। অপেক্ষায় আছি নিজের বইসহ সব নতুন বইয়ের মায়াবী ঘ্রাণ পেতে!

Advertisement

তবে ভয়-ভীতি মুক্তভাবে লেখক-পাঠক যদি বইমেলায় যেতে না পারে তাহলে দিন শেষে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বিশেষ করে বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হবেন প্রকাশকগণ। তাদের বেচাবিক্রি মনের মতো জমবে না। আর এবারের বইমেলায় খুব সামান্য হলেও প্রবেশমূল্য রাখা উচিত। সেই সাথে ছোট কিংবা বড় প্রকাশক এ দুইয়ের ভেতর স্টল বিন্যাসে বাংলা একাডেমির যেন কোনো বৈষম্য না থাকে। আসলে এত কিছুর পরও মনেপ্রাণে চাইছি, সময়মতো যেন আমাদের প্রাণের বইমেলা শুরু হয়। কেননা এটা আমাদের আবেগ, আমাদের সীমাহীন ভালোবাসার একটি জায়গা।’

কবি ও কথাশিল্পী রফিকুজ্জামান রণি বলেন, ‘করোনাময় বিশ্বের দিকে তাকালে অনুমান করা যায় এবছরও বইমেলার আয়োজন করা কঠিন হয়ে পড়বে। গত বইমেলায় যে ক্ষতির মুখোমুখি পড়েছে লেখক-প্রকাশকরা; সেটি কাটিয়ে ওঠা বড় শক্ত। তারপরও আমরা চাই বইমেলা হোক। তবে বিগত দিনের ভুল সিদ্ধান্তগুলো যেন পুনরায় না ঘটে; সেটা মাথায় রেখেই যেন হয়।

বইমেলা স্বাভাবিক ও সুন্দরভাবে হবে আমরা এটাই কামনা করি। তবে বাংলা একাডেমিকে আরও কঠোরভাবে মেলা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিগত বইমেলাগুলোয় দেখেছি, বাংলা একাডেমির কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী বইমেলার ওপর নোংরা কর্তৃত্ব ফলাতে। ‘লেখক বলছি’ নামের একটি গোষ্ঠীপ্রীতি পর্বের মাধ্যমে ঢাকার বাইরের লেখকদের সঙ্গে তামাশা করতে। এতে মহাপরিচালকের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। কমিটির বদনাম হয়। বিভিন্ন জেলা শহরের লেখকদের খোঁজ তারা রাখেন না। অধ্যাপক, আমলা এবং মিডিয়ার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছাড়া অন্যদের বিষয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। বইমেলা যেন ‘অফিসার্স মেলা’ না হয়ে যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। লেখকদের গুরুত্ব না দিলে এমন মেলার আয়োজন করাই বৃথা। সেই সঙ্গে লিটল ম্যাগের বিষয়ে উদাসীন মনোভাবও কাটিয়ে উঠতে হবে।

বইমেলার সময় সব ধরনের পরীক্ষা, নির্বাচন কিংবা রাষ্ট্রীয় বড় বড় আচার-অনুষ্ঠান আপাতত স্থগিত রাখলে মেলার গুরুত্ব আরও বেড়ে যাবে। এ বিষয়ে সরকারের বিশেষ নজরদারি থাকা প্রয়োজন।’

Advertisement

লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী রনি রেজা বলেন, ‘বইমেলা কেন্দ্রীক বাঙালির একটি আবেগ দৃশ্যমান। কবি-সাহিত্যিক-প্রকাশক-পাঠকের বাইরেও আপামর জনগণের ভেতর বইমেলা একটা আলাদা জায়গা তৈরি করতে পেরেছে বলে মনে করি। মেলায় আগন্তুক সবাই কিন্তু বই কিনতে আসেন না। অনেকে ঘুরতে আসেন। এ নিয়ে অনেক লেখক-প্রকাশককে হাপিত্যেশ করতে দেখি। সে ভিন্ন আলাপ। তবে এ থেকে বোঝা যায়, বইমেলার জন্য সর্বস্তরের বাঙালির একটি অপেক্ষা থাকে। এটাকে আমি খুবই ইতিবাচকভাবে দেখি। সম্ভবত কর্তৃপক্ষও সেভাবেই দেখেন।

বর্তমানে আমরা অসুস্থ সময় পার করছি। মহামারি করোনা এসেছে দুই বছর ছুঁইছুঁই। এরমধ্যে গেল বছর প্রভাবটা বেশি পড়েছে। কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেই বইমেলা চলল। নির্ধারিত সময় ফেব্রুয়ারি এড়িয়ে মার্চ-এপ্রিলে হলো। তবু নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যতটা জেনেছি, অধিকাংশ প্রকাশকের লোকসান গুনতে হয়েছে। দুই বছরের অভিজ্ঞতা বলে, আমাদের দেশে মার্চ-এপ্রিলের দিকে করোনার প্রভাব একটু বেশি থাকে। এরই মধ্যে সে চিত্র স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। আমরা এবছর করোনার মৃত্যুশূন্য দিনও দেখেছি। অথচ আবার বাড়তে শুরু করেছে। লকডাউন, বিধিনিষেধের বিষয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। এ প্রভাব নিশ্চয়ই বইমেলায়ও পড়বে। তাই এবছর কর্তৃপক্ষের অনেক ভেবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে মনে করি।’

কবি ও সাহিত্যিক টিপু সুলতান বলেন, ‘গতবছর বইমেলা কন্যাদানের মতো স্বজনবিষাদে পরিণত হয়েছিল। সেই সব অভিজ্ঞতার ভয়াবহ জের ধরে জীবনের সঙ্গে লড়াই আর প্রার্থনাই ছিল মহামারি যাতনার গল্প। আমি চাই, এবারের বইমেলা যেন পূর্ণাঙ্গভাবে স্বাভাবিক হয়। অথচ করোনাময় পৃথিবীতে এখন আর আগে থেকেই বলা যায় না কিছু। তবে লেখক-পাঠকদের মিলনমেলা সাহসিকতার উৎসব জিইয়ে ফিরুক ২০২২ সালের দোরগোড়ায়। তবে বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তাতে আবারো বিষাদাক্রান্ত বোধ করছি। এক সুন্দর বর্ণিল প্রস্তুতি সূত্রে আমরা প্রায় সবাই উভয় সংকটে ভুগছি। এমন পরিস্থিতিতে অধিকাংশ লেখক-প্রকাশক গতবছর আর্থিকভাবে বড় ধাক্কা খেয়েছেন। সুতরাং এবারের প্রকাশক, লেখক, পাঠকরাও ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে উৎসবের প্রহর গুনছেন।

তবে কথা হলো, মহামারির নতুন ভ্যারিয়েন্ট আবারো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রাণের উৎসব বইমেলা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটি ভবিষ্যতের ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু আমি চাই, মহামারি বাগড়া না দিক এ আশা জাগিয়ে সবার প্রার্থনা হোক ‘নিরাময় পৃথিবীর মিলনমেলা’।’

এসইউ/জিকেএস