সাজেক ভ্রমণের প্রথমদিন শরীর কিছুটা ক্লান্ত থাকে। দীর্ঘপথ ভ্রমণের কারণেই মূলত এটি হয়। তবে সেই ক্লান্তি পাত্তা পায় না সাজেকের সৌন্দর্যের কাছে। চান্দের গাড়ি থেকে নেমে আমরা সোজা চলে যাই আমাদের নির্ধারিত রিসোর্টে। রিসোর্টগুলো যেন পাহাড়ের গায়ে ঝুলে আছে বাবুই পাখির বাসার মতো। যেখান থেকে পুরো পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। দুচোখ যতদূর যায় শুধু সবুজে মোড়া পাহাড়। মনে হয় দূর থেকে কে যেন হাতছানি দিচ্ছে!
Advertisement
আমাদের কক্ষটি বেশ বড়। তিনটি বেড, ছয়জন অনায়াসে থাকা যাবে। আমরা দুটি রুম নিয়েছিলাম, তবে দুটি ভিন্ন রিসোর্টে। দুই ভাগে ভাগ হয়ে উঠলাম রিসোর্টে। ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে নিলাম সবাই। এরপর বের হলাম দুপুরের খাবার খেতে।
কংলাক পাহাড়ে সূর্যাস্তের ঠিক আগ মুহূর্তে রক্তিম আকাশ
দুর্গম এলাকা হলেও সাজেক ভ্যালিতে খাবারে বৈচিত্র্য আছে। হোটেলগুলোতে একটু আগে থেকে বলে রাখলে প্রায় সব ধরনের খাবারই পাওয়া যায়। গরুর মাংস, মুরগির মাংস, মাছ, সবজি, বিভিন্ন রকমের ভর্তা, ডাল পাওয়া যায়। এখানে বিশেষ নজর কাড়বে ‘ব্যাম্বু চিকেন’ বা বাঁশের ভেতরে মুরগির মাংস রান্না এবং ‘ব্যাম্বু বিরিয়ানি’। এই দুই পদের স্বাদেও একটু ভিন্নতা আছে। আবার হোটেল ভেদে এর দাম ভিন্ন হয়।
Advertisement
দুপুরের খাবার শেষে ফিরলাম রিসোর্টে। বিছানায় গা গড়াতেই মোটামুটি সবারই তন্দ্রাভাব চলে আসে। এর মধ্যেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। আমাদের চান্দের গাড়ির চালক এসে হাজির। ‘সাজেক কি ঘুমাতে এসেছেন?’ তার হাসিমাখা এমন শাসনে সবাই হেসে উঠলাম। বেরিয়ে পড়লাম আমাদের ‘ট্যুরগাইড’ চালকের সঙ্গে। উদ্দেশ্য সাজেকের অন্যতম আকর্ষণ কংলাক পাহাড় ও হেলিপ্যাড। সাজেকের শেষ গ্রাম কংলাকপাড়া। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এর উচ্চতা প্রায় ১ হাজার ৮শ ফুট। রুইলুইপাড়ার শেষ প্রান্তে আছে বিজিবি ক্যাম্প। এখান থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার সামনে কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় আরেক পাহাড়ি গ্রাম কংলাকপাড়া। সাজেকের হ্যালিপ্যাড থেকে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট ট্রেকিং করে কংলাকপাড়ায় যাওয়া যায়।
আমাদের গাড়ি কংলাক পাহাড় থেকে বেশকিছু দূরে পার্কিং করে। সেখান থেকে আমাদের কংলাক পাহাড় যাত্রা শুরু। উঁচু পথ বেয়ে পাহাড়ে উঠতে বেশ বেগ হতে হয়। এখানে ছোট ছোট বাঁশের লাঠি পাওয়া যায়। ভারসাম্য রাখার জন্য এসব বাঁশের লাঠি বেশ কাজে দেয়। স্থানীয়রা পর্যটকদের জন্য এসব লাঠির ব্যবস্থা করেন। তবে এর জন্য তারা কিছু অর্থ রাখেন পর্যটকদের কাছ থেকে। অনেকে লাঠি ছাড়াই উঠে পড়েন পাহাড়ের চূড়ায়। তবে এই পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা মোটেও সহজ নয়। খাঁড়া পথ বেয়ে উঠতে হয়, যা মোটেও মসৃণ নয়। দম বন্ধ করা পথ। মাঝে মধ্যে জিরিয়ে নিতে হয়। খুব সতর্কতার সঙ্গে উঠতে হয় এই পাহাড়ে। একটু অসতর্ক হলেই কয়েকশ ফুট নিচে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
কংলাকের চূড়ায় উঠে মনে হলো পৃথিবী জয় করে ফেলেছি আমরা। পুরো সাজেক যেন আমাদের হাতের মুঠোয়। সাজেকের পুরো ভিউ দেখা যায় এখান থেকে। একই সঙ্গে এখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনযাপন দেখা। সূর্যাস্তের ঠিক আগ মুহূর্তে কংলাকের চূড়া সেজেছিল রক্তিম সাজে। এখানে সূর্যাস্ত দেখা মানে পরম সুখলাভ। কিন্তু অন্ধকারে পাহাড় থেকে নামার ভয়ে সূর্যাস্তের আগেই নেমে পড়ি আমরা। তবে অনেকেই এখানে সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ মিস করেননি।
অনেকক্ষণ হেঁটে উঠতে হয় কংলাক পাহড়ে
Advertisement
কংলাক থেকে নেমে আমরা সোজা চলে যাই হেলিপ্যাডে। এখানে যেন আরেক স্বপ্নের দেশ। স্নিগ্ধ হিমেল হাওয়া, পশ্চিমে রক্তিম আকাশ আর পাহাড়ের নির্মল সবুজ মিলেমিশে একাকার। এই সৌন্দর্যের রাজ্যে না হারিয়ে উপায় নেই। এখানে কখন যে সময় গড়িয়ে যায় তার হিসাব নেই। হিসাব রাখার দরকারও পড়ে না। প্রথমবার গিয়ে মনে হবে অনন্তকাল থাকা যাবে এমন পরিবেশে। অগত্যা সেই উপায় না থাকায় নেমে পড়ি আমরা। এর পাশেই লুসাই গ্রামে। ফেরার পথে গাড়ি থেকেই কিছুটা ওই গ্রামের বাসিন্দাদের দেখা।
রিসোর্টে ফিরে কিছুটা বিশ্রাম-আড্ডা শেষে আবার রাতের খাবারের সন্ধানে বের হই। রাতের মেন্যুতে রেখেছিলাম ঐতিহ্যবাহী ব্যাম্বু চিকেন। বাঁশের মধ্যে বিশেষ কায়দায় মুরগির মাংস রান্না। খুব সুস্বাদু না হলেও ভালো লাগবে। সঙ্গে ছিল ডাল, সবজি, নানা রকমের ভর্তা। আমরা আটজনে দুটি ‘ব্যাম্ব চিকেন’ নেই। দাম পড়ে ১ হাজার ৬শ টাকা। একটি ব্যাম্বু চিকেনে চারজন খাওয়া যায় অর্থাৎ ১:৪ হিসেবে রান্না হয়।
সাজেকের বিশেষ খাবার ব্যাম্বু চিকেন
রাতের খাবার শেষে সাজেকে উঁচু-নিচু পথে হেঁটে বেড়ানো, স্থানীয়দের জীবনযাপন, পর্যটকদের আনন্দ-সবমিলিয়ে এক ভিন্নজগৎ এখানে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আট বন্ধু ফিরে গেলাম আমাদের রিসোর্টে। আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণে হারিয়ে যাই আমরা। রিসোর্টের বারান্দায় চেয়ার নিয়ে গোল হয়ে বসে চলে আমাদের এসব কাণ্ড। আমাদের সাজেক যাত্রায় এবার বিশেষ মাত্রা যোগ করে থার্টি ফার্স্ট নাইট। ৩১ ডিসেম্বর রাত কাটে আমাদের সাজেকে। রিসোর্টে বেশ কয়েকটি ঘর কিছুটা দূরে দূরে অবস্থান ঘরগুলোর। রিসোর্টের সামনে অনেক গভীর পথ। কর্তৃপক্ষ এখানে বসার বেঞ্চ, দোলনা বসিয়েছে, যেন পর্যটকরা তাদের সময় ভালো কাটাতে পারেন। রিসোর্ট প্রাঙ্গণে একদল পর্যটক আয়োজন কনরে বারবিকিউ নাইটের। রাত ১২টা বাজার পরপরই সাজেকের আকাশে জ্বলে ওঠে নানা রকমের আলোর ঝলকানি। পটকা, আতজবাজিতে রঙিন হয়ে ওঠে সাজেকের আকাশ। আমরাও অংশ হয়ে যাই এই দুর্লভ মুহূর্তের। এভাবে কখন যে রাত গভীর হয়ে গেছে কেউ বুঝতেই পারিনি। অবশেষে বিছানায় গা এলিয়ে সাজেকের স্নিগ্ধ সকালের অপেক্ষা।
কংলাক পাহাড়ে উঠতে বেশ সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়
পরিকল্পনা মতো খুব ভোরে উঠে পড়ি ঘুম থেকে। সকাল দেখবো বলে। কুয়াশা মোড়ানো সাজেকের ভোর আসলেই সুন্দর, স্নিগ্ধ। পাহাড়ে সূর্যোদয় শেষে আমরা প্রস্তুত হলাম সকালের খাবার খেতে। খাবার শেষে আবার ফিরলাম রিসোর্টে। কারণ, ফিরতে হবে খাগড়াছড়ি, সেই প্রস্তুতি নিতে। সকাল ১০টার মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে রিসোর্ট, সেভাবেই বুক করা। আবার সকালের এসকর্ট ধরতে হবে। এখান থেকেও ১০টায় ছেড়ে যাবে প্রথম এসকর্ট। সেজন্য প্রস্তত হয়ে বের হলাম আমরা। গাড়িতে করে আর্মি ক্যাম্পে এসে টিকিট সংগ্রহ করলাম। এখানে প্রতিটি টিকিটের দাম ৪০ টাকা। প্রতেক পর্যটকের জন্য একটি টিকিট। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিলো আমাদের গাড়ির বহর। আবার আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু পথ বেয়ে চলা। মুগ্ধ হয়ে ফিরছিলাম আর সাজেকে কাটানো সময়ের স্মৃতিচারণ করছিলাম।
অন্ধকার আলুটিলা গুহায় লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা হবে পর্যটকদের
এবার অভিযান আলুটিলা গুহাদুপুরের মধ্যেই ফিরে এলাম খাগড়াছড়ি শহরে। বাস কাউন্টারের কাছেই একটি রেস্টহাউজে রুম নিলাম কয়েকঘণ্টার জন্য। রেস্টহাউজের ভাড়া ৬শ টাকা। সেখানে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেলাম পাশের হোটেলে। এরপর বেরিয়ে পড়লাম আরও তিনটি স্পট দেখার জন্য। চান্দের গাড়িও সেভাবে ভাড়া করা। প্রথমে গেলাম জেলা পরিষদ হর্টিকালচার পার্ক দেখতে। এখানে রয়েছে সুদৃশ্য ঝুলন্ত পার্ক, ছোট লেক ও আঁকা-বাঁকা রাস্তা। বাহারি রকমের ফলমূল ও পিঠাপুলিও পাওয়া যায় এখানে। এছাড়া স্থানীয়দের ঐতিহ্যবাহী পোশাকসহ অন্যান্য কেনাকাটার সুযোগও আছে।
হেলিপ্যাডে পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে
হর্টিকালচার পার্কে ঘোরা শেষ করে আমরা রওনা হলাম আলুটিলা গুহার উদ্দেশ্যে। সাজেক ভ্রমণের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হবে এখানে। টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। অনেক নিচু পথ পেরিয়ে যেতে হয় আলুটিলা গুহায়। অন্ধকার গুহায় গা ছমছমে পরিবেশ। গুহার বুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। এর মধ্যেই পিচ্ছিল পথ পেরিয়ে গুহা অতিক্রম করতে হয়। মশাল হাতে এই গুহা পেরুতে অন্যরকম অভিজ্ঞতা হবে। তবে মশালের ব্যবস্থা না থাকায় মোবাইলের আলোতেই কাজ সারতে হলো। অন্ধকার, হিমশীতল, পিচ্ছিল পথ পেরিয়ে শেষ হলো আলুটিলা গুহা অভিযান।
খাগড়াছড়ি হর্টিকালচার পার্ক
এরপর আমাদের যাওয়ার কথা ছিল রিছং ঝরনা দেখতে। কিন্তু শীতকালে রিছং ঝরনায় পানি থাকে না। এ কারণে সেদিকে পা না বাড়িয়ে ফিরে যাই রেস্ট হাউজে। হোটেলে রাতের খাবার শেষে উঠে পড়ি গাড়িতে। একরাশ তৃপ্তি আর ভালোলাগা নিয়ে ফিরে আসি ইট-পাথরের ঢাকায়।
যেখানে আকাশ আর পাহাড় মিলেমিশে একাকার
সাজেকে যেতে হলে মোটামুটি ১০-১৫ দিন আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। ছুটির দিন বা বিশেষ দিবসগুলোতে যেতে হলে আরও আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। বিশেষ করে বাসের টিকিট এবং রিসোর্ট বুকিং আগে থেকেই করতে হবে। তা না হলে রিসোর্ট এবং বাসের টিকিট পাওয়া যাবে না। সাজেকে দলবেঁধে যেতে পারলে ভালো হয়। বিশেষ করে চান্দের গাড়িতে ১২ জনের যাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। ভ্রমণসঙ্গী বেশি হলে এখানে খরচ সাশ্রয়ের বিষয় থাকে। তবে সংখ্যায় কম হলেও সমস্যা নেই। কোনো ট্যুর গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হতে পারলেই সমস্যা মিটে যাবে, উপরন্তু অচেনা মানুষের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময়সহ আনন্দ বেড়ে যাবে কয়েকগুণ।
ইএ/এএ/জেআইএম