মতামত

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ উপহার

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৫০ বছর বছর পূর্ণ হল। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ক্ষেত্রে দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় লাভ করলেও ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পরিপূর্ণ বিজয়ের স্বাদ পেয়েছিল বাঙালি জাতি। সেদিন থেকেই নতুন ভাবে পথ চলতে শুরু করে বাংলাদেশ।

Advertisement

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলে পাকিস্তানী সেনারা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে সেনা ছাউনির একটি স্কুলের পরিত্যক্ত অন্ধকার ঘরে এক সপ্তাহ আটকে রাখা হয়। এরপর ১ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয় রাওয়ালপিন্ডিতে। তারপর সরিয়ে আনা হয় মিয়ানওয়ালির কারাগারে। থাকতে দেওয়া হয় ফাঁসির আসামিদের জন্য নির্ধারিত সেলে।

এছাড়াও তিনি মুক্তির আগ পর্যন্ত পাঞ্জাবের উত্তরে লায়ালপুর ও শাহিওয়ালের দুটি কারাগারেও ছিলেন। এই সময়কালে সামরিক সরকার পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে রাষ্ট্রদ্রোহিতার ১২ টি অভিযোগ তোলে বিচার শুরু করে। এবং ছয়টি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ইয়াহিয়া খান মিথ্যা অভিযোগে দ্রুত প্রহসনের বিচারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে চেয়েছিল।

৪ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খান রাওয়ালপিন্ডিতে সেনা কর্মকর্তাদের ডেকে বঙ্গবন্ধু গুলি করে দ্রুত হত্যার নির্দেশ দেন। তখন বাংলাদেশের মিত্রবাহিনী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু করলে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। ৭ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুকে মিয়ানওয়ালি কারাগারে পুনরায় ফিরিয়ে আনা হয়। ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী যখন চূড়ান্ত পরাজয়ের সন্ধিক্ষণে ইয়াহিয়া খান তখনও বঙ্গবন্ধুকে আরেক বার হত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার আগেই জেল সুপার বঙ্গবন্ধুকে অজ্ঞাত স্থানে সরিয়ে নিয়ে যায়।

Advertisement

১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ইয়াহিয়া খানেরও পতন হয়। ১৯ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতা গ্রহণ করলে পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে থাকে। ভুট্টো মনে করলেন, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হলে বাংলাদেশে আটকে পড়া প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা করা হবে। এ কাজের জন্য সবাই তাঁকে অর্থাৎ ভুট্টোকেই দায়ী করবে। তখন তার ক্ষমতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই তিনি বঙ্গবন্ধুর মুক্তির উপায় খুঁজতে থাকেন। গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসার পর রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে যাওয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে। ২৪ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন ভুট্টো। এরপর আরো দু-বার দেখা করে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে একটা সমঝোতার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রতিবারই বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখান করেন।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ৬৭টি দেশের সরকার প্রধানকে চিঠি দেন। পাকিস্তানকে কূটনৈতিক ভাবে এক ঘরে করতে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালান। যার কারণে পাকিস্তান সরকার দ্রুত বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান। একটি পাকিস্তানী সামরিক বিমানে খুব গোপনে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সকাল ৭টায় বিবিসি’র ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে প্রচারিত খবরে বলা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডনে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে।

লন্ডনে প্লেনটি বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর ভিআইপি লাউঞ্জে আসলে বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ বৈদেশিক দফতরের কর্মকর্তারা প্রথমে স্বাগত জানান। ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়ে লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ক্ল্যারিজেস হোটেলে নিয়ে আসেন।বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে পৌঁছেন তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথ ছিলেন লন্ডনের বাইরে স্কটল্যান্ডে।বঙ্গবন্ধুর পৌঁছানোর খবর শুনে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী হিথ ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে ছুটে আসেন।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রী হিথ বঙ্গবন্ধুকে নজিরবিহীন সম্মান দেখান। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ঐদিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথ নিজে বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবকে বরণ করার জন্য তাঁর কার্যালয়ের বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিলেন। সেটা ছিল ব্রিটেনের ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রম ঘটনা। যা আগে কখনো ঘটেনি,তারপরেও কখনো হয়নি। বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেছিলেন তখনকার বিরোধী দলীয় নেতাও।

৯ জানুয়ারি লন্ডনের স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফিরে আসার জন্য ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বহরের কমেট জেটে উঠেন। বাংলাদেশে ফেরার পথে বিমানটি দুই ঘণ্টার যাত্রা বিরতি করে ভারতের নয়াদিল্লীতে। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীসহ মন্ত্রী সভার সকল সদস্য বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান।

বিমান বন্দরে অভ্যর্থণা জানাতে এক সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি এর আগে ও পরে কখনো হয়নি। বিমান বন্দরে ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানানো হয়। শুভেচ্ছা পর্ব শেষে বঙ্গবন্ধু তিন বাহিনীর ১৫০ সদস্যের গার্ড অব অনার পরিদর্শন করেন এবং সংবর্ধনা সভায় বক্তব্য দেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সকাল থেকেই তেজগাঁও বিমানবন্দরের রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে মহান নেতাকে এক নজর দেখার অপেক্ষায় ছিল লক্ষ লক্ষ জনতা।বাংলাদেশ বেতার থেকে ধারা বিবরণীতে বার বার ঘোষণা করা হচ্ছিল প্রিয় নেতার আগমনের প্রতিটি মুহূর্তের ধারাবিবরণী। সে এক অন্যরকম উত্তেজনা, সবার চোখে আনন্দ্রাশ্রু। লাখো জনতার কণ্ঠে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’স্লোগান।

অবশেষে বেলা ১ টা ৪১ মিনিটে অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়। বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করে। ইতিহাসের বরপূত্রকে বরণ করতে অস্থায়ী সরকার মন্ত্রিসভার সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিকামী লক্ষ লক্ষ বাঙালি জনতা সেদিন বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়েছিল। জনস্রোতে বিমান বন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত দশ মিনিটের রাস্তা যেতে সময় লেগেছিল দু-ঘন্টারও বেশি।

রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষাধিক জনতার সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু সেদিন শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন এবং কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বিশ্বকবি তুমি বলেছিলে সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি।’বিশ্বকবি তুমি দেখে যাও,তোমার সেই কথা আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বাঙালি মানুষ হয়েছে। সাত কোটি বাঙালি যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছে।’

বঙ্গবন্ধু তাঁর সতের মিনিটের বক্তব্যে বাংলাদেশ বিনির্মাণের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি কি হবে হবে সেটি তিনি সেদিনই স্পষ্ট করে বলেন, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয় ভিত্তি হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।

দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার প্রশ্নে বাঙালি জাতি যখন চরম অনিশ্চয়তার মুখোমুখি- তখন পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সেদিন বঙ্গবন্ধুর আগমন ছিল বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ উপহার।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।haldertapas80@gmail.com

এইচআর/জিকেএস