মো. খাইরুল ইসলাম ৩৬তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে উত্তীর্ণ হন। তার জন্ম বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলায়। বাবা মো. হাফিজুর রহমান খন্দকার মসজিদের ইমাম ছিলেন, মা খাদিজা বেগম গৃহিণী। ২০০৭ সালে সারিয়াকান্দি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০০৯ সালে বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে গণিত বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
Advertisement
বর্তমানে তিনি রংপুরের পীরগঞ্জে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত। সম্প্রতি তার বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: আপনার শৈশবের গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই—খাইরুল ইসলাম: বগুড়া শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরের এক প্রত্যন্ত এলাকায় আমার বেড়ে ওঠা। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নদী। নদীভাঙনের ভয়ানক অভিজ্ঞতা এ অঞ্চলের মানুষকে বদলে দিয়েছে। শিখিয়েছে টিকে থাকার লড়াই। এই জনপদের মাটি ও মানুষের সঙ্গেই কেটেছে আমার শৈশব। দুরন্ত শৈশব আমার। শৈশবজুড়েই রয়েছে বাঙ্গালী নদী বিধৌত আমার গ্রাম। সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা একটি জনপদে বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, মাছ ধরা থেকে শুরু করে গল্পের আসরে আড্ডাবাজি, গ্রাম্য যাত্রা-নাটক আর শিল্প-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মধ্যে ছিল অবাধ বিচরণ। এরপর হঠাৎ বইপড়া, স্কুলে যাওয়া এসব বিরক্তিকর কাজের দায়িত্ব কাঁধে উঠে পড়ে। মায়ের মুখে গল্প শুনেছি, বেশ কয়েকবার নাকি বই ছিঁড়ে বাড়ির পেছনে ছাইয়ের গাদায় লুকিয়ে রেখেছিলাম।
জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?খাইরুল ইসলাম: শুধু পড়াশোনা নয়, আজীবনই প্রতিবন্ধকতা মানে যেটা উপলব্ধি করেছি সেটা হলো অর্থ। চার ভাই-বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট ছিলাম। তাই তাদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে বড় হলেও বড় ভাই ও বড় বোন যেভাবে কষ্ট করে পড়ালেখা করেছেন, তাদের সেই কষ্ট থেকে শিক্ষা নিয়েই দুঃখ-দারিদ্র্যকে মোকাবিলা করার শক্তি, সাহস ও উৎসাহ পেয়েছি।
Advertisement
জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?খাইরুল ইসলাম: ক্লাস ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত ক্লাসের ফার্স্টবয় ছিলাম। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে প্রথম স্থান অধিকার করে বৃত্তি পাই। ২০০৭ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে এ প্লাস এবং এইচএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাসসহ বোর্ডের বৃত্তি পাই। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো বেতন দিতে হয়নি। প্রাইমারি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করেছি। খন্দকার বংশের সন্তান হিসেবে আমার গর্ব, আমার গ্রামে আমি প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছি এবং বিসিএস ক্যাডার হয়েছি। স্বপ্নটা আসলে দেখতে হয়নি, পথচারীর পাথেয় হয়ে গেছে স্বাভাবিকভাবেই।
জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন? খাইরুল ইসলাম: প্রথমেই একটি কোম্পানির এক সেট বই কিনে কিছুদিন হাতের কাছে রেখে নাড়াচাড়া শুরু করি। তারপর ধীরে ধীরে সিনিয়র ভাইদের পড়ালেখার স্টাইল ফলো করি। ফলো করতে গিয়ে দেখলাম, একেক জনের পড়ার স্টাইল একেক রকমের। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার স্টাইলে আমি পড়বো। তখন আমি রুটিন করে প্রতিদিন কয়েকটি বিষয় পড়া শুরু করলাম। এভাবেই প্রস্তুতিটা শুরু করি। অনার্স ও মাস্টার্সের রেজাল্ট খুব একটা ভালো ছিল না। তাই আর দেরি না করে বিসিএসের প্রিপারেশন নেওয়া শুরু করে দিই। অনার্স ফাইনাল ইয়ার থেকে শুরু করলেও মূলত মাস্টার্স থেকেই পুরোদমে প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। ৩৬তম বিসিএসের রেজিস্ট্রেশন করার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো যুদ্ধের মাঠে নেমে পড়ি। বিসিএস ভাইবার আগে প্রবেশপত্র ডাউনলোড করা নিয়ে একটি ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে, ভাইবাটি আদৌ দিতে পারবো কি না। শেষপর্যন্ত পিএসসিতে আবেদন পর্যন্ত করতে হয়েছিল পাসওয়ার্ড উদ্ধারের জন্য। অবশেষে আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে পিএসসির সুরক্ষিত অন্দরে প্রবেশ করে কয়েক টেবিল ঘোরাঘুরি করার পর সেই পাসওয়ার্ড উদ্ধার করে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম।
জাগো নিউজ: পর্দার আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে?খাইরুল ইসলাম: পর্দার আড়ালে ছিলেন আমার বাবা-মা, বড় ভাই, বড় বোন আর না পাওয়ার বঞ্চনা। সারাজীবন ভালো পড়াশোনা করার কারণে আমার এলাকার শিক্ষক এবং সাধারণ মানুষের দোয়া ও আশীর্বাদ ছিল, আমি একটি ভালো চাকরি পাবো, মানুষের উপকারে আসবো। সেই মানুষগুলোর মুখই এ মুহূর্তে আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে।
জাগো নিউজ: নতুনরা বিসিএস প্রিলির জন্য কীভাবে প্রস্তুতি শুরু করবেন?খাইরুল ইসলাম: সাম্প্রতিক সমস্যা নিয়ে গাদা গাদা বই পড়ে মাথা গরম করে খুব একটা লাভ আছে বলে মনে করি না। তবে নতুনদের জন্য বলতে চাই, পড়ার কোনো বিকল্প নেই। নিজেকে ভালো অবস্থানে দেখতে চাইলে ভালো প্রস্তুতি নিতেই হবে। এ জন্য নিজের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করতে হবে। সাধারণ বিজ্ঞান, সাধারণ গণিত, বাংলা দ্বিতীয় পত্র, ভূগোল, সামাজিক বিজ্ঞান ইত্যাদি বই একজন নতুন বিসিএস পরীক্ষার্থীকে অনেক সহায়তা করবে। বইগুলো দাগিয়ে দাগিয়ে পড়তে হবে এবং বিগত বছরগুলোয় আসা প্রশ্নের সেট ও সমাধান পাশাপাশি নিয়ে বসে সমাধান করতে হবে। তাহলে আমি মনে করি, এতে প্রায় অর্ধেক নাম্বার উঠে আসবে। আর প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় পঞ্চাশ ভাগ নাম্বার ক্যারি করতে পারলে যে কোনো পরীক্ষার্থীর প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় পাস করা সম্ভব।
Advertisement
জাগো নিউজ: প্রিলি শেষ করার পর লিখিত প্রস্তুতি নিয়ে আপনার পরামর্শ কী?খাইরুল ইসলাম: মনে রাখতে হবে, প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় পাস করা মানে যুদ্ধের মাঠে লড়াইয়ের গ্রিন কার্ড হাতে পাওয়া। লিখিত পরীক্ষায় পাস করা মানে ক্যাডার হওয়ার সম্ভাবনা জাগানো। তাই লিখিত পরীক্ষার আগে অবশ্যই সমসাময়িক ইস্যু, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা, দেশি-বিদেশি আলোচিত-সমালোচিত ঘটনার কারণ ও তার সমাধান ইত্যাদি বিষয়সহ কিছু কমন বিষয়ে প্রস্তুতি শুরু করতে হবে। এজন্য বাজারের যে কোনো একটি ডাইজেস্ট গাইড কেনা যেতে পারে। তবে ডিটেইলস পড়তে হলে যে কোনো একটি কোম্পানির এক সেট বই কিনতে হবে এবং নিয়মিত পড়তে হবে। সেই সাথে ক্লাস এইট ও টেনের সাধারণ গণিত ও উচ্চতর গণিতের বইটা ভালোভাবে সিলেবাস ধরে আয়ত্ত করতে হবে।
জাগো নিউজ: বিসিএস ভাইবার প্রস্তুতি কেমন হতে হয়?খাইরুল ইসলাম: ভাইবার আসলে তেমন কোনো ফ্রেম নেই। তবে কিছুটা প্রিলিমিনারি পরীক্ষা এবং কিছুটা রিটেন পরীক্ষার সিলেবাস থেকেই আসে। বাজারে ভাইবার সহায়ক হিসেবে কিছু বই পাওয়া যায়। বইগুলো চাইলে সংগ্রহে রাখতে পারেন।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?খাইরুল ইসলাম: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলতে চাকরি এবং পরিবারকে নিয়েই সময় কাটানো। তাছাড়া মাঝেমধ্যে দর্শনীয় স্থান ঘুরতে ভালো লাগে। আল্লাহ যদি সুযোগ দেন, অদূর ভবিষ্যতে পবিত্র হজের কাজটাও সম্পাদন করতে চাই ইনশাআল্লাহ। সবাই দোয়া রাখবেন।
এসইউ/জেআইএম