ফখরুল হাসান
Advertisement
পৃথিবীর কোনো পুরস্কারই বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। এমনকি নোবেল পুরস্কারও নয়। আমাদের দেশের ছোট-বড় অনেক ধরনের পুরস্কার প্রচলিত আছে। এসবের অধিকাংশই গুরুত্বহীন। তবে কোনো কোনো পুরস্কার যথেষ্ট সম্মানজনক। ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’, ‘একুশে পদক’ ও ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ যথেষ্ট সম্মান ও গুরুত্ব বহন করে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব পদক-পুরস্কার নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়। সাহিত্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারটি হচ্ছে বাংলা একাডেমি পুরস্কার। যোগ্য কবি-লেখকরা এ পুরস্কার পাবেন এটাই সবার প্রত্যাশা। পুরস্কার-সম্মাননা যদি ভুল মানুষ পায়, তার দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের। যারা নীরবে-নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন; তাদের স্বীকৃতি নেই। তাদের স্বীকৃতি দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আনুগত্য কোনো পুরস্কারপ্রাপ্তির যোগ্যতা হওয়া কাম্য নয়।
তাই তো পুরস্কার যদি অযোগ্য ব্যক্তি পান, তাহলে দুঃখের শেষ নেই। সব ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিবেচনা, ব্যক্তিবন্দনা ও ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতা সামাজিক অবক্ষয় সৃষ্টি করছে। স্বার্থান্বেষী মহল আমাদের গৌরবের জায়গাটিকে কলঙ্কিত করছে। বস্তুত স্বজনপ্রীতি ও অর্থলিপ্সা থেকেই জন্ম নেয় অযোগ্যদের লালন-পালনের প্রবণতা। দিনের পর দিন তা বেড়েই চলেছে!
Advertisement
গত কয়েক বছর যাবত পুরস্কার নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্ন ওঠার সঙ্গত কারণও আছে। সে বিষয়ে সাহিত্যকর্মীরা অবগত। তা সিবস্তারে বলার অপেক্ষা রাখে না। আর কিছুদিনের মধ্যেই ঘোষণা করা হবে বাংলা একাডেমি পুরস্কার। কিন্তু কবিতার জন্য যাদের পুরস্কৃত করা হয়, তাদের নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে বিতর্কের জন্ম দেয় বাংলা একাডেমি। এ পুরস্কার অনেক ক্ষেত্রে সম্পর্কচর্চা, শিল্পহীন পথ অবলম্বনের অভিযোগে দুষ্ট। এ কারণে প্রকৃত কবি ও লেখক রয়ে যান অন্তরালে। এভাবে অন্তরালে আছেন ৭০ ও ৮০ দশকের অনেক কবি।
বাংলা একাডেমির কাছে অনুরোধ জানাই, প্রয়োজন হলে প্রতিবছর দুই জন করে কবিতায় পুরস্কার দেওয়া হোক, যেভাবে অতীতে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের যুক্তির পেছনে যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে তা উল্লেখ করলাম। অতীতে একসঙ্গে দুই কবিকে পুরস্কার দেওয়ার তালিকা হচ্ছে:১৯৭২ সাল- আবদুল গনি হাজারী (কবিতা) ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান (কবিতা) ১৯৭৭ সাল- আবদুর রশীদ খান (কবিতা) ও মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ্ (কবিতা) ১৯৭৮ সাল- কে এম শমশের আলী (কবিতা) ও ইমাউল হক (কবিতা)১৯৭৯ সাল- জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী (কবিতা) ও আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ (কবিতা)১৯৮১ সাল- ওমর আলী (কবিতা) ও রফিক আজাদ (কবিতা)২০০৯ সাল- অরুণাভ সরকার (কবিতা) ও রবিউল হুসাইন (কবিতা)২০১০ সাল- রুবি রহমান (কবিতা) ও নাসির আহমেদ (কবিতা) ২০১১ সাল- কামাল চৌধুরী (কবিতা) ও অসীম সাহা (কবিতা) ২০১২ সাল- আবিদ আনোয়ার (কবিতা) ও সানাউল হক খান (কবিতা) ২০১৭ সাল- মোহাম্মদ সাদিক (কবিতা) ও মারুফুল ইসলাম (কবিতা)।
কবিতায় ৬০ দশকের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ কবি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। এর পরের দশক, অর্থাৎ ৭০ দশকের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবি কবিতায় এখনো বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাননি। সহজেই যাদের নাম উল্লেখ করা যায়─ফারুক মাহমুদ, বিমল গুহ, মুজিবুল হক কবীর, আতাহার খান, সোহরাব হাসান, ইকবাল হাসান, আসাদ মান্নান, সোহরাব পাশা, মিনার মনসুর, শামীম আজাদ, জরিনা আখতার, মাহমুদ কামাল, জাহিদ হায়দার, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, ফরিদ আহমদ দুলাল, হাসান হাফিজ, ময়ূখ চৌধুরী, মতিন বৈরাগী, মুনীর সিরাজ, নাসরীন নঈম, দুখু বাঙাল, আলমগীর রেজা চৌধুরী, তুষার দাশ, শিশির দত্ত, ওমর কায়সার, হালিম আজাদ, মাহমুদ শফিক, রবীন্দ্র গোপ, ইকবাল আজিজ, শাহাজাদী আনঞ্জুমান আরা, মাহবুব বারী, নিতাই সেন, মাহবুব হাসান, জাহাঙ্গীর ফিরোজ প্রমুখ।
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ষাট ও সত্তর দশকের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবি বাংলা একাডেমি পুরস্কার না পেয়েই পরপারে চলে গেছেন! এটি যেমন একাডেমির জন্য লজ্জার; তেমনই আমাদের জন্যও বেদনার। ভাষা শহীদের রক্তস্নাত বাংলায় যোগ্যদের স্বীকৃতি এবং প্রতিভাধরদের মূল্যায়নের ব্যবস্থা করাই হবে সঠিক কাজ। শান্তি পাবে ভাষা শহীদের আত্মা।
Advertisement
লেখক: কবি ও শিশুসাহিত্যিক।
এসইউ/এমএস