থাইল্যান্ডকে বলা হয় হাতির দেশ। যুগ যুগ ধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে থাইল্যান্ডে হাতি একটি প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হয়ে আছে। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয় হাতি। ট্যুরিজম, চিড়িয়াখান সার্কাস ইত্যাদি।
Advertisement
থাইল্যান্ডের লামপাং এলাকায় আছে পৃথিবীর প্রথম হাতির হাসপাতাল। সোয়াইদা সালওয়ালা নামের এক স্মার্ট তরুণী প্রতিষ্ঠা করেছেন বিশ্বের প্রথম এই হাতির হাসপাতাল। এ পর্যন্ত প্রায় ৩০০০ হাতির চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে এই হাসপাতাল থেকে।
থাইল্যান্ডের জঙ্গলে পাকা দেওয়াল, পাকা মেঝে আর ঢেউ খেলানো টিনের ছাদ দিয়ে তৈরি করা এই হাতি হাসপাতালের আ্যাম্বুলেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয় ক্রেন। হাসপাতালে আছে ডিজিটাল এক্স-রে, থার্মাল ইমেজিং, আল্ট্রাসোনোগ্রাফি, ঘুমপাড়ানি বন্দুক ও কোয়ারান্টাইন ব্যবস্থা।
আছে লেজার ট্রিটমেন্ট, দাঁতের এক্স-রে, হাইড্রোথেরাপি থেকে অপারেশনের ব্যবস্থাও। হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে হাতিকে সঙ্গাহীন করতে ব্যবহৃত হয় ৭০ জন মানুষকে অচেতন করার মতো এনেসথেসিয়া ডোজ।
Advertisement
থাইল্যান্ডের শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন অর্থোপেডিক সার্জন ডাক্তার হিসেবে সেবা দিচ্ছেন এবং নার্স হিসেবে রয়েছেন অসংখ্য স্বেচ্ছাকর্মী। হাতি হাসপাতালের ডাক্তার জিভাকেট বলেন, ‘দুই থেকে সাত টন ওজনের একেকটি অসুস্থ্য হাতিকে পথ্য হিসেবে এখানে প্রতিদিন ২০ লিটার গ্লুকোজ ও পাঁচ ছড়ি কলা খাওয়ানো হয়।
স্মিত হেসে তিনি জানান, ‘হাতির চিকিৎসার জন্য এই প্রথম আমাদের তৈরি করতে হলো বড় বড় গজ ব্যান্ডেজ, বিশেষ ধরণের পিকন টেপ, কাঁচি, ছুরি ইত্যাদি চিকিৎসা সরঞ্জাম।’
এই হাসপাতালে পর্যটকরাও যেতে পারেন, খুদে থেকে বুড়ো প্রতিটি হাতিরই চিকিৎসা হচ্ছে এখানে। যেমন ল্যান্ড মাইন বিস্ফোরণে বোন মি নামে ১১ বছরের হাতির সামনের পা প্রচণ্ড জখম হয়েছে।
পায়ের চিকিৎসা হচ্ছে এই হাসপাতালে। কোনটার চোখে ইনফেকশন, কোনটা বন্দুকের গুলিতে আহত, কোনোটার হাড় ভেঙে গেছে। কোনোটা ল্যান্ড মাইন র্দূঘটনায় পর হাড় ভেঙ্গেছে কিন্তু বেঁচে আছে।
Advertisement
এই হাসপাতালের শারীরিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার পাশাপাশি হাতিদের মনস্তাত্বিক চিকিৎসা দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন, হাতির হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা সোয়াদিয়া সালওয়ালা। হাসপাতাল নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি জানান, তিনি ও তার পিতা মিলে প্রথমে গাড়ি ধাক্কায় আহত এক হাতির চিকিৎসা করেন।
তবে কোনো হাসাতাল না থাকায় হাতিটি অবশেষে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়। তিনি ছোটবেলা থেকে আজন্ম স্বপ্ন দেখতেন হাতির একটি হাসাতাল তৈরি করবেন। তাই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন, ‘দ্য ফ্রেন্ডস অব দ্য এশিয়ান ইলফ্যান্ট হসপিটাল’ নামে হাতির এই হাসপাতাল।
এক হিসেবে থাইল্যান্ড দেশটিতে বন্য হাতি আছে প্রায় ২০০০ আর পোষা হাতি প্রায় সাড়ে ৩০০০। প্রতিবছর হাতি আয় করে ৮০০০ পাউন্ড। থাইল্যান্ডের মাথাপিছু গড় আয়ের তুলনায় এই আয় ৪ গুণ বেশি।
প্রতিবছর এখানে হাতি মারা যায় গড়ে ২০০টি আর জন্ম নেয় মাত্র ১৫টি। হাতি রক্ষায় যত্নবান হওয়ার বিষয়টি থাই সরকারের মাথায় এসেছে অতি সম্প্রতি। এজন্য সরকারি উদ্যোগে সম্প্রতি একটি হাতি হাসপাতাল স্থাপন করেছে সরকার।
ক’দিন আগে ৪ টন ওজনের একটি হাতি ব্যাংককের রাস্তায় চলতে গিয়ে পথের পাশের ড্রেনের মধ্যে পড়ে যায়। পড়ে গয়ে আহত হয়। উদ্ধার করতে ছুটে আসে ক্রেন। কিন্তু ক্রেন দিয়ে হাতিটিকে টেনে তোলার সময় হাতিটি আবারও আঘাত পায়।
হাতিটি পরে মারা যায়। এই ঘটনার পরই থাই সরকার হাতিদের জন্য একটি সরকারি হাসপাতাল স্থাপন করার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাই সরকার। হাতিদের হাসপাতাল নির্মাণে সরকারি প্রচেষ্টা এই প্রথম।
থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় মায়ানমার সীমান্তে ভুমি সীমানা অবৈধ দখলকরী যুদ্ধবাজ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় জঙ্গলে পুঁতে রেখেছে অসংখ্য গোপন বোমা মাইন। এছাড়া লাউস অঞ্চলের অবৈধ মাদক কারবারীদের প্রতিহত করতে থাই সেনাবাহিনীতে নিয়মিত জংলী অপারেশনে নামতে হয়।
থাইল্যান্ডের গহীন জঙ্গলে এই জংলী যুদ্ধে থাই সেনাবাহিনীর একমাত্র ভরসা বাহন হচ্ছে এই হাতি। জানা যায়, ৩০০০ গৃহপালিত হাতি থাই সেনাদলে অন্তর্ভূক্ত। এদের কাজ হচ্ছে মাটির নীচে পুঁতে রাখা মাইন অপসারণ, জঙ্গলে সৈন্যদের রসদ সরবরাহ ও গাছের গুঁড়ি স্থানান্তরণ। ডিজিটাল যুগে এসেও এছাড়া এসব কাজে হাতির বিকল্প নেই।
থাইল্যান্ডে এখনো শহরের রাস্তায় হাতি চলাচল করতে দেখা যায়। অবশ্য সঙ্গে থাকে হাতির ড্রাইভার বা মাহুত। এই মাহুত বেকার হয়ে গেলে হাতির স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায়। হয়তো দেখা যায় কাজের সময় হঠাৎ কোনো করাণে আহত হয় হাতি।
এ ছাড়াও চোরাশিকার, ট্রেনে চাপা পড়ে হাতির মৃত্যুও বেড়েই চলেছে। অনেক জায়গায় মাহুতরা বিদ্যুতের তার দিয়ে হাতিকে আঘাত করেন, এ জাতীয় নিষ্ঠুর প্রথায় অসুস্থ হয়ে পড়ে হাতিগুলো।
এসব নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে প্রায়ই মারাত্মকভাবে আহত হয় হাতি। এ ছাড়াও বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে হাতিতে উঠিয়ে নগদ টাকা পয়সা উপার্জন করতে অনেক মাহুত হাতি নিয়ে শহরের রাজপথে ঘুরতে বের হয়। রাস্তার যানবাহনের সঙ্গে সংঘর্ষে মাঝে মাঝে আহত হয় হাতি। প্রাণীদের অধিকার রক্ষা সংগঠনও তাই সরকারের হাতি হাসপাতাল তৈরির নতুন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে।
ব্যাঙ্ককে অবস্থিত হাতি ফাউন্ডেশনের পরিচালক সোয়াদিয়া সালওয়ালা জানান, ‘অনেক মাহুত অধিক উপার্জনের আশায় হাতিকে কঠিন ও পরিশ্রমী কাজে নিয়োজিত করে। হাতির বলবৃদ্ধির জন্য ‘অ্যামফিটামিন’ জাতীয় ড্রাগ সেবন করায়।
আমরা কেন এমন করছি?’ তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন। এদিকে দক্ষিণ থাইল্যান্ডে গতবছর আনারস চাষীরা বন্য হাতির উপদ্রব ঠেকাতে আনারসে বিষ প্রয়োগ করে শত শত হাতি হত্যা করেছে।
সরকারিভাবে পরবর্তীতে এই হত্যার বিরুদ্ধে নিষেধাঙ্গা জারি করা হলেও হাতি নিধন বন্ধ হয়নি। তবে হাতি রক্ষায় সরকারি জোরদার প্রচেষ্টার প্রকৃত প্রমাণ হচ্ছে এই হাতি হাসপাতাল।
জেএমএস/এমএস