মতামত

উল্টো চরিত্র: ভার্চুয়াল বনাম অ্যাকচুয়াল

সারল্য ও সততার সবচেয়ে বড় ভক্ত ঠকবাজরা। এটি একটি এক লাইনের কৌতুক বটে। তবে এর মধ্যে থাকা নিগূঢ় সত্যটি ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার জো নেই। বর্তমান সমাজে দ্বৈত চরিত্রের মানুষের আনাগোনা বড্ড বেশি। তাদের বেশিরভাগের বাস আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। প্রোফাইলের তথ্য থেকে প্রতিদিনের ফেসবুক স্ট্যাটাস সব জায়গায় নীতি, নৈতিকতা, ধর্মীয় জ্ঞান আর সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে সরব মানুষগুলোর দ্বিচারিতা দেখে কিছুটা অবাক হতে হলেও বিস্মিত হওয়ার কারণ নেই। কারণ এটাই যে বর্তমানের ট্রেন্ড।

Advertisement

গত এক যুগে মানুষের মধ্যে ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের প্রবণতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। সেটি ফেসবুক পর্যালোচনা করলে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। ওটাই একমাত্র জায়গা যেখানে সবাই সৎ, সবাই সাম্যবাদী আর সবাই ন্যায় বিচারক। এখন তাহলে প্রশ্ন ওঠে দৈনন্দিন সমাজে নিত্য ঘটে চলা জুলুম, নির্যাতন, দুর্নীতি আর বর্বরতার পেছনে কলকাঠিগুলো নাড়ছে কারা? তারা কি ওরা; যাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই। একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যাবে, এ সমাজে যাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পদচারণা নেই, তাদের আসলে কার্যত তেমন কোনো ক্ষমতাও নেই। তাদের অনাচার সৃষ্টির সুযোগ সীমিত।

পানি যেমন সূত্রের নিয়ম মেনে ওপর থেকে নিচের দিকে গড়ায়; তেমনই সমাজে খারাপ কাজগুলো সংঘটিত হয় উঁচু স্তরের মানুষগুলোর দ্বারাই কিংবা তাদের ছত্রছায়ায় অন্য কারও মাধ্যমে। সম্প্রতি দেশে নানা ঘটনায় বহু দুর্নীতিবাজ, বহু ধর্ষক আর বহু অন্যায়কারী পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর বা আইনের আওতায় আসার পর তাদের ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে দেশবাসী যারপরনাই বিস্মিত হয়েছে। কারণ তাদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ আর তাদের ফেসবুক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি বিপরীতমুখী ছিল। অপরাধী মানুষগুলোর সাধুতার মুখোশ তাদের জঘন্য কর্মকাণ্ডের উত্তাপে যেন খসে পড়ে তাদের দ্বৈত চরিত্রের স্বরূপটাই প্রকাশ করছিল।

এক অনুষ্ঠানে অকস্মাৎ কয়েকজন বন্ধুর মধ্যে দেখা হয়ে গেল। একজন আরেক জনকে প্রশ্ন করলো, ‘তুই সকালে কী খেয়ে বের হয়েছিস?’ ‘বাটার টোস্ট, লেমন জুস, অমলেট আর এক পিস চিকেন ফ্রাই।’ শুনে প্রশ্নকর্তা বন্ধুটি বললো, ‘দোস্ত সত্য বল, এটা তোর ফেসবুক স্ট্যাটাস না।’ শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। এটি একটি কৌতুক হলেও এটাই এখন বর্তমান সমাজের চিত্র। মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক রকম আবার বাস্তবে আরেক রকম। যেন সমান্তরাল দুটি জীবন। একটিতে নির্মোহ, নির্লোভ, সৎ আর ন্যায়পরায়ণ মানুষের মুখোশ। আরেকটিতে দুর্নীতি, ঘুষ, পাপাচার, অসুস্থ প্রতিযোগিতা আর জুলুমবাজ মনের বহিঃপ্রকাশ।

Advertisement

এর ঠিক উল্টো চরিত্রের দেখাও কিন্তু মিলবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই। বাস্তব জীবনে সুবোধ, অন্তর্মুখী মানুষটি তার ফেসবুক জীবনে খুবই আগ্রাসী। এটা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে অনেক গবেষণাও করে ফেলেছেন। সেই গবেষণার ফল বলছে, এসব মানসিকতার মানুষগুলো সামাজিক অস্থিরতা তৈরির জন্য ব্যাপক ভূমিকা রাখে। যারা বাস্তব দুনিয়ায় নরম, কোমল আর মিষ্টভাষী; সেই তারাই পরাবাস্তব বা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় কর্কষ আর কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের। তারা মানুষের প্রোফাইল থেকে প্রোফাইলে ঘুরে বেড়ায়। অশালীন, অযৌক্তিক আর মানহানিকর মন্তব্য করে। যথাতথা মানুষের মধ্যে ভার্চুয়াল কলহ তৈরিতে ভূমিকা রাখে।

বিষয়গুলোর দিকে এখনই নজর দিতে হবে, সেই সাথে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আইন দিয়ে এসব ঠিক করা যাবে না। কারণ এগুলো পুরোপুরি নীতি আর নৈতিকতার বিষয়। আইনের থেকেও জরুরি সামাজিক মূল্যবোধের প্রসার ঘটানো। ভালো খারাপের পার্থক্য বোঝানো। একই সাথে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলবে হবে ভার্চুয়াল দুনিয়ার নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে।

কিছু বছর আগে হলেও এটি একটি মামুলি আর এড়িয়ে যাওয়ার মতো বিষয় ছিল। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। কিছুদিন পর হয়তো ভার্চুয়াল জীবন নিয়ন্ত্রণ করবে বাস্তব জীবনকে। তার আগেই উন্মোচন করা প্রয়োজন মুখোশধারীদের আসল চেহারা।

লেখক: সাংবাদিক-সংগঠক; কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪ডটকম।

Advertisement

এইচআর/ফারুক/এমএস