স্বামীর আয়-উপার্জন খরচের তুলনায় কম। তাই সংসারে কম-বেশি আর্থিক অভাব-অনটন লেগে থাকে। স্বামীর আর্থিক সংকটের কারণে অনেকের সুখের সংসারও ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। অনেক স্ত্রী আবার আলাদা হয়ে যান। এসব ক্ষেত্রে সমাধান কি? আবার স্বামীর আর্থিক সংকটে স্ত্রীর করণীয়ই বা কী?
Advertisement
প্রতিটি পরিবারেই স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে তার স্ত্রী-সন্তান-পরিবার সুন্দরভাবে পরিচালনা করবে। কারও সম্পদের মুখাপেক্ষী না হয়ে হালাল উপায়ে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য বা কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে আয়-উপার্জন করবে। এটা তার জন্য ফরজ ইবাদতও বটে। কারণ ইসলাম স্বামীর ওপর তার স্ত্রী ও পরিবারের ভরণ-পোষণের সুব্যবস্থা করাকে আবশ্যক করেছে। পাশাপাশি কষ্ট ও পরিশ্রমের মাধ্যমে হালাল পন্থায় অর্থ উপার্জনের প্রতিও উৎসাহিত করেছে। কোরআন-সুন্নায় তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।
১. শ্রমনির্ভর করেই আল্লাহ তাআলা মানুষের সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ فِي كَبَدٍ
Advertisement
‘নিশ্চয়ই আমি মানুষকে শ্রমনির্ভর করে সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা বালাদ : আয়াত ৪)
২. আল্লাহ তাআলা মানুষকে শুধু ইবাদত-বন্দেগি করার কথাই বলেননি বরং ইবাদতের পর রিজিকের সন্ধানে জমিনে ছড়িয়ে পড়ার দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوْا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللهِ
‘এরপর নামাজ শেষ হলে তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ (অর্থ-সম্পদ, জীবিকা ইত্যাদি) সন্ধানে জমিনে ছড়িয়ে পড়।’ (সুরা জুমআ : আয়াত ১০)
Advertisement
৩. নিজ হাতে উপার্জিত খাবারই সর্বোত্তম। আর তা নবিদের কাজও বটে। হাদিসে পাকে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
مَا أكَلَ أَحَدٌ طَعَاماً قَطُّ خَيْراً مِنْ أنْ يَأكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدِه، وَإنَّ نَبيَّ الله دَاوُدَ عليه السلام كَانَ يَأكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ
‘নিজের হাতের উপার্জন থেকে উত্তম খাবার কেউ কখনো খায়নি। আল্লাহর নবি দাউদ আলাইহিস সালাম নিজ হাতের উপার্জন থেকে খেতেন।’ (বুখারি)
সুতরাং স্ত্রী-সন্তান ও পরিবার প্রতিপালনে উত্তম আয়-উপার্জন করা স্বামীর অন্যতম কাজ। সাময়িক প্রয়োজনের তাগিদে সুন্দর সংসার ব্যবস্থাপনা ও দায়িত্ব পালনের জন্য আত্মীয়স্বজন থেকে সুদমুক্ত ঋণও নেওয়া যেতে পারে, যা উপার্জন করে অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে।
আর্থিক সংকটের মুহূর্তে স্ত্রীর করণীয়
স্বামীর আর্থিক সংকটের সময় স্ত্রীর অনেক করণীয় আছে। স্বামীর আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে তার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা উত্তম। খরচের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত চাপ না দেওয়া এবং অল্পে তুষ্ট থেকে ধৈর্যের সঙ্গে সংকট মোকাবিলায় স্বামীর পাশে থাকা। স্বামীর পাশে থেকে তার আয়-উপার্জনে সঙ্গী ও সহযোগী হওয়ার চেষ্টা করা উত্তম। ইসলামে অল্প তুষ্ট ও সহমর্মিতার সঙ্গে স্বামীর পাশা থাকার অনুপ্রেরণা এসেছে হাদিসে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
قَدْ أَفْلَحَ مَنْ أَسْلَمَ وَرُزِقَ كَفَافًا وَقَنَّعَهُ اللَّهُ بِمَا آتَاهُ
‘সে ব্যক্তি নিশ্চিতভাবে সফল, যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে; যাকে পরিমিত জীবিকা দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহ তাআলা তাকে যা দিয়েছেন তাতে তুষ্ট থাকার শক্তি দিয়েছেন।’ (মুসলিম)
স্বামীর আর্থিক সংকট ও আয়-উপার্জন কম হওয়ায় অভাব-অনটনের কারণে স্ত্রীর জন্য কোনোভাবেই আলাদা থাকা বৈধ নয়। বরং এসব ক্ষেত্রেও স্বামী-স্ত্রী মায়া ও ভালোবাসার বন্ধনে একসঙ্গে বসবাস করবে। স্বামীকে হালাল উপার্জনে সহায়তা করবে এবং উৎসাহ জোগাবে। এমনটি করলে আল্লাহ তাদের মাঝে ভালোবাসার সম্পর্ক সুদৃঢ় করবেন এবং অল্প অর্থ-সম্পদেও বরকত দান করবেন। এর মাধ্যমে তাদের দাম্পত্য জীবন সুখ-আনন্দে ভরপুর থাকবে ইনশাআল্লাহ।
মনে রাখতে হবে
পরিবার অভাব ঘুচাতে স্বামী যদি সর্বোচ্চ চেষ্টা করার পরও পর্যাপ্ত অর্থ উপার্জন করতে ব্যর্থ হয়; তাহলে বুঝতে হবে সে এ ক্ষেত্রে মাজুর বা অপারগ। তবে অর্থ উপার্জনের এ চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে এবং আল্লাহর কাছে হালাল উপার্জনের জন্য দোয়া করবে। আয়-উপার্জন বাড়াতে বিশেষ কোনো পেশায় সফল না হলে প্রয়োজনে অন্য পেশা অনুসন্ধান করবে।
স্বামীকে সহযোগিতা করা
অভাব-অনটন রোধে স্ত্রী তার যোগ্যতা অনুযায়ী হালাল পন্থায় উপার্জন করে স্বামীকে তার আর্থিক সমস্যা লাঘবে সহায়তা করতে পারে। তা হতে পার- হস্তশিল্প, বোরকা তৈরি, কাপড় সেলাই, বুটিকের কাজ, মহিলা মাদরাসা বা বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, শিশু বা মেয়েদেরকে প্রাইভেট পড়ানো কিংবা বাসা-বাড়িতে পশু-পাখি, কবুতর ও হাস-মুরগি পালন ইত্যাদি।
ভুলে গেলে চলবে না যে, আল্লাহর দুনিয়ায় রিজিকের পথ একটি নয়। বরং হাজারও পথ খোলা আছে। একটিতে সফল না হল অন্য দিকে চেষ্টা করবে। কারণ যে চেষ্টা করে সে সফল হয়। আর্থিক অভাব-অনটনে সফল হতে অন্তরে আল্লাহর ভয় থাকতে হবে। তবে আল্লাহ তাআলা ওই বান্দাকে অপ্রত্যাশিতভাবে রিজিকের ব্যবস্থা করেন এবং অভাব-অনটন দূর করে দেবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَل لَّهُ مَخْرَجًا-وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ ۚ وَمَن يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ ۚ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ ۚ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا
‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য নিষ্কৃতির পথ বের করে দেবেন। এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিকের ব্যবস্থা দেবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন। আল্লাহ সবকিছুর জন্য একটি পরিমাণ স্থির করে রেখেছেন।’ (সুরা তালাক : আয়াত ২-৩)
স্বামী অলসতা কিংবা হারাম কাজে অর্থ নষ্ট করলে
স্বামী যদি অলসতা করে অর্থ উপার্জন না করে কিংবা হারাম পন্থায় অর্থ নষ্ট করে কিন্তু স্ত্রীর ভরণ-পোষণ না দেয় তবে তাতেও রয়েছে স্ত্রীর বিশেষ করণীয়।
অবহেলা ও অলসতা বশত স্বামী অর্থ উপার্জনে মনোযোগী না হলে বা কোনও হারাম পথে টাকা-পয়সা অপচয় করার ফলে স্ত্রী যদি সর্বনিম্ন ভরণ-পোষণ থেকেও বঞ্চিত হয় তবে করণীয় হলো-
> প্রথমে স্বামীকে আন্তরিকতার সঙ্গে বুঝানো।
> হালাল কাজের প্রতি উৎসাহিত করা।
> হারাম কাজে অর্থ অপচয় করার বিষয়টি আন্তরিকতার সঙ্গে বুঝানো।
> আল্লাহর কাছে স্বামীর সঠিক বুঝ-উপলব্ধির জন্য দোয়া করা।
সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে
সার্বিক প্রচেষ্টার পরও যদি স্বামীর মধ্যে পরিবর্তন না আসে কিংবা স্ত্রীকে ন্যূনতম খোরপোষ দিতে ব্যর্থ হয়, স্বামী যদি অকর্মণ্য হয়, অলসতা করে আয়-উপার্জন না করে, বিনা কারণে অর্থ অপচয় করে কিংবা স্ত্রীকে খরচ না দিয়ে হারাম কাজে অর্থ ব্যয় করে এবং স্বামীকে বুঝানোর পরও যদি সে পরামর্শ গ্রহণ না করে তবে স্বামীর কাছ থেকে খোলা তালাক চাওয়া জায়েজ। কারণ এমন অকর্মণ্য, অলস ও অর্থ অপচয়কারী স্বামীর সঙ্গে সংসার করার ফলে স্ত্রী সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সুতরাং সর্বশেষ স্ত্রীর করণীয় হলো- ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার স্বার্থে সমঝোতার মাধ্যমে স্বামীর কাছ থেকে খোলা তালাক চাইবে। কিন্তু স্বামী তালাক দিতে সম্মত না হলে স্ত্রী চাইলে কোর্টের মাধ্যমেও আইনানুগভাবে তালাক গ্রহণের ব্যবস্থা করতেও সুযোগ দিয়েছে ইসলাম।
আল্লাহ তাআলা সবাইকে পারিবাকি জীবনে সুন্দর জীবন-যাপনে হালাল পন্থায় অর্থ উপার্জন করার এবং স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের খরচ বহন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম