সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে নানা সেক্টরে যে শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি সেই উন্নয়নের রেশ ছুঁয়ে গেছে স্বাস্থ্য সেক্টরেও। একের পর এক এসডিজি অর্জনে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, এক যুগের ব্যবধানে শতাধিক মেডিকেল কলেজসহ একাধিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা, নতুন নতুন হাসপাতাল স্থাপন ও পুরোনো হাসপাতালের আধুনিকায়ন এবং সম্প্রসারণের বিশাল ফর্দতো আছেই, তার সাথে আছে দেশে একের পর এক আধুনিকতম চিকিৎসা পদ্ধতি চালুর অসম্ভব সব সাফল্যগাথাও। লিখতে বসলে বাদ যাবে না কোভিড মোকাবিলায় আমাদের সাফল্য আর মাস-ভ্যাকসিনেশনে অর্জনগুলোও। এমনি প্রেক্ষাপটে সঙ্গত কারণেই আধুনিকতার ছোঁয়ায় পুষ্ট হয়েছে এদেশের লিভার চিকিৎসাও।
Advertisement
স্টেম সেল থেরাপি ও রিজেনারেটিভ মেডিসিন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম অনুষঙ্গ। চিকিৎসার যেভাবে আধুনিকায়ন হচ্ছে তাতে ধরে নেয়া যেতে পারে যে সামনে আমরা পার্সোনালাইজড মেডিসিনের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। এক প্যারাসিটামলে একশ জনের দশ রোগের চিকিৎসা করার দিন সম্ভবত ফুরিয়ে আসতে যাচ্ছে। এক রোগীর এক রোগের জন্য এক মেডিসিন ব্যবহারের দিন বোধহয় আর খুব বেশি দূরে নয়। এক্ষেত্রে স্টেম সেল থেরাপি ও রিজেনারেটিভ মেডিসিনের ভূমিকাই যে মুখ্য হতে যাচ্ছে তা তো বলাই বাহুল্য।
লিভার রোগের ক্ষেত্রে বোধ করি এ কথাগুলো আরও বেশি করে প্রযোজ্য। এর কারণ লিভারের একটি অন্যতম বড় গুণ হচ্ছে এর রিজেনারেশনের সক্ষমতা। প্রাচীন গ্রিক পুরাণে আছে গ্রিক দেবতা প্রমিথিউসকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল একটি গাছের সাথে বেঁধে রেখে। প্রতিদিন নিয়ম করে একটি ঈগল পাখি এসে তার লিভারের কিছু অংশ খেয়ে যেত। সেই লিভারটি আপনা আপনি বড় হলে, পরদিন ওই ঈগলটি উড়ে এসে আবারো লিভারটিতে ভাগ বসাতো। অর্থাৎ লিভারের এই রিজেনারেশনের সক্ষমতার কথা সেই কোন জমানায়ও মানুষের অজানা ছিল না।
আর এই বিষয়টিকে কাজে লাগিয়েই লিভার রোগের চিকিৎসায় স্টেম সেলের প্রচলন। পৃথিবীর নানা দেশে নানাভাবে স্টেম সেল ব্যবহার করে লিভারের চিকিৎসা করার প্রয়াস অব্যহত আছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমার নেতৃত্বে এদেশের একদল চৌকস লিভার বিশেষজ্ঞ প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে লিভার সিরোসিসের চিকিৎসায় অটোলোগাস হেমোপয়েটিক স্টেম সেল ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন বা সংক্ষেপে স্টেম সেল থেরাপি ব্যবহার করে। সেই থেকে আজ অবধি আমরা সাফল্যের সাথে এদেশের শতাধিক লিভার সিরোসিস আক্রান্ত রোগীকে স্টেম সেলের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা প্রদান করেছি এবং তা নিয়মিতভাবেই। এমনকি এই করোনাকালেও আমারা আমাদের এই সেবাটি অবহ্যত রেখেছি।
Advertisement
আমি খুব গর্ব করেই বলতে পারি যে লিভার সিরোসিসের চিকিৎসায় স্টেম সেল ব্যবহারে আমি এবং আমার সহকর্মীরা যে শুধু এদেশেই পথিকৃৎ তা-ই নয়, এ বিষয়ে আমাদের আশেপাশে দেশগুলোর যে কোনো উন্নত সেন্টারের চেয়েও আমাদের অভিজ্ঞতা এবং সক্ষমতাও কোনো অংশেই কম নয়। এ কথা এতটা জোর দিয়ে বলার পেছনে আমার মূল শক্তি আমাদের এই বিষয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে একাধিক বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা।
আমরা মূলত যা করি তা হলো রোগীর সম্মতি নিয়ে রোগীকে গ্র্যানুলোসাইট কলোনি স্টিমুলেটিং ফেক্টর ইনজেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা রোগীর অস্থিমজ্জা থেকে রক্তে স্টেম সেলগুলো মোবিলাইজ করি। তারপর এফেরেসিস মেশিন ব্যবহার করে ওই স্টেম সেলগুলোকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় রক্ত থেকে আলাদা করে নিয়ে এসে আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনের গাইডেন্সে সরাসরি লিভারে ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করি।
আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি যে স্টেম সেল থেরাপি করলে রোগীর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লিভার ফাংশনগুলোর উন্নতি হয় এবং তারা দীর্ঘদিন ভালো থাকেন। যাদের মাসে দু-তিনবার করে হাসপাতালে ভর্তি হতে হতো, তাদের হয়তো তিন মাসে একবার ভর্তি হলেই চলছে। একইভাবে অনেকের লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশনেরও সহজে আর দরকার পড়ে না।
অর্থাৎ স্টেম সেল থেরাপি করলে লিভার পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে এমনটি বলা না গেলেও, বেশির ভাগ লিভার সিরোসিস রোগীর যে এতে কম-বেশি উন্নতি হয় তার সপক্ষে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতেই আছে। স্টেম সেল থেরাপি এখনও লিভার সিরোসিসেস বিকল্প নয় এ কথা যেমন ঠিক, তেমনি নানা কারণে যারা ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে পারছেন না, সেই সব লিভার সিরোসিস রোগীর জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি আশা জাগানিয়া চিকিৎসা পদ্ধতি।
Advertisement
আমরা যখন কোনো রোগীর স্টেম সেল থেরাপি করি তখন মাঝে সাঝে আমি এ ব্যাপারে আমার ফেসবুক ওয়াল এবং পেজে স্ট্যাটাস দেই। উদ্দেশ্য একটাই - আরও কিছু মানুষকে বাংলাদেশে উপলব্ধ এই চিকিৎসা পদ্ধতি সমন্ধে সচেতন করে আরও কিছু মানুষের কিছুটা উপকারের চেষ্টা করা।
আমি লক্ষ্য করেছি প্রায়ই রোগীরা আমার ফেসবুকে এ সংক্রান্ত স্ট্যাটাসগুলোয় কমেন্ট করে এই পদ্ধতিটি এবং এর আউটকাম সমন্ধে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এটি আমাকে এ বিষয়ে এই লেখাটি লিখতে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছে। কারণ আমার মনে হয়েছে এ বিষয়টি নিয়ে আরেকটু বেশি জানতে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা এদেশে একেবারেই কম নয়।
লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/এএসএম