মতামত

দুর্নীতির শিল্পকলা

অবৈধ সম্পদ ও অর্থপাচারের অভিযোগে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকিকে ১৬ জানুয়ারি তলব করা হয়েছে, তলবে না আসলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন দুদকের সচিব মাহবুবুর রহমান। জনাব লাকির বিরুদ্ধে শত কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

Advertisement

একই দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার আরও জানা গেল অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতির অভিযোগে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য আজিজ আল কায়সার টিটো ও আজিম উদ্দিন দুদকের তলবে হাজির না হয়ে এক মাস সময় চেয়েছেন।

দুর্নীতির অভিযোগ প্রতিদিনই শুনছি। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি এসব দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে। কিন্তু শিল্প-সংস্কৃতি আর শিক্ষার সাথে মানুষজনের বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ উঠে, তখন দুর্নীতির মুক্তবাজারেও কিছুটা ভাবনায় পড়তে হয়।

লিয়াকত আলী লাকি এই পদে অনেকদিন ধরে আছেন রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে। রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে দলপ্রধান তাকে এখানে বসিয়েছেন একটা অঙ্গীকারের জায়গা থেকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে দুঃখ পাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না যদিও অভিযোগ এখনও প্রমাণিত হয়নি।

Advertisement

দুর্নীতির ধারণা সূচকে বরাবরই বাংলাদেশের অবস্থান পাকাপোক্ত। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গ্লোবাল কোন র্যাংকিং না পেলেও এই একটি জায়গায় আমাদের র্যাংক বেশ ভাল। বাংলদেশে দুর্নীতি করতে পারা সামাজিকভাবে অনেক ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য ব্যাপারও। ধারণা করা যায়, বাংলাদেশ দুর্নীতি উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের থেকে শুরু করে জনগণের কাছে পৌঁছে গেছে।

মাথাপিছু আয় আমাদের বেড়েই চলেছে, আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধিও অনেক দেশের জন্য ঈর্ষণীয়। এবং অবকাঠামোসহ বেশ কিছু খাতে আমরা উন্নয়নও করছি। দুর্নীতির কথা এলেই, উন্নয়ন প্রসঙ্গ আসে। বলার একটা চেষ্টা আছে যে, উন্নয়ন হলে কিছু দুর্নীতি হবেই। প্রশ্ন তাহলে উন্নয়ন আর দুর্নীতি কী পাশাপাশি এগোয়? সমস্যাটা হলো এরকম করে বললে দুর্নীতি সম্পর্কে সমাজের নৈতিক অবস্থান বা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। কিন্তু এর দীর্ঘস্থায়ী খারাপ ফল আছে কিনা সেটা নিয়ে ভাবনা নেই।

বিষয়টা বেশ জটিল। একাকালে সব রকমের দুর্নীতি থেকে মুক্ত মেরুদণ্ড সোজা রেখে চলা মানুষদের সন্মান করতো। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে শিল্প-সংস্কৃতির জগতের মানুষ কেউ বাদ যাচ্ছেন না প্রতিযোগিতা থেকে।

তাই বলতে হয় দুর্নীতি বাড়ছে, ক্রমে নয়, ক্রমাগত ভাবে। পরিস্থিতি খারাপ থেকে অধিকতর খারাপের দিকে অগ্রসর। দুর্নীতি কেন বাড়ছে তা সবিস্তার ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। বৃহত্তর পরিসর হতে তুলনায় ক্ষুদ্রতর পরিসর, সর্বত্রই যে রূপে দুর্নীতির ছায়া ক্রমপ্রসারণশীল, তাতে সৎ মানুষের আজ বেঁচে থাকাই দায়।

Advertisement

বিস্তৃত পরিসরে দুর্নীতি চলছে এবং তা ছড়িয়ে পড়ছে জনজীবনের প্রত্যন্ত স্তরেও। গৃহস্থালির নিত্যকার সেবা পরিষেবা যেমন গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, জমির খাজনা, গাড়ির কর কিছুই বাদ যাচ্ছেনা, সব কিছু চলে যাচ্ছে দুর্নীতির হাতে। টাকা না দিলে সেবা পাওয়া দূরের কথা, শারীরিক লাঞ্ছনাও জুটতে পারে কপালে।

ফলে বাধ্য হয়ে নাগরিকগণ যে যার মতো করে, দুর্নীতির সঙ্গে একটি বোঝাপড়া করে নিয়েছেন। কোথায় ফাঁকি দেওয়া যাবে, কোথায় ঘুষ দিয়ে সেবা আদায় করতে হবে, কিভাবে বিনা টিকিটে ভ্রমণ করা যাবে সব বিদ্যা রপ্ত করবার প্রচেষ্টা এখন নাগরিক মনে। জীবনযাপনের প্রাত্যহিক স্তরে এটি আর নিন্দার বিষয় নয়। বরং, উল্টো এ সব বিষয়ে কারও প্রয়োজনীয় সক্ষমতা না থাকলেই তার ‘অকর্মণ্য’ আখ্যা পাবার সমূহ আশঙ্কা আছে।

ক্ষমতা কাঠামোর ভেতর থাকা রাজনৈতিক লোকজন ও আমলারা বড় দুর্নীতি করে করে জনগণকে ছোট দুর্নীতিতে অভ্যস্ত করে ফেলেছে। আর এ কারণেই বহুমাত্রিক দুর্নীতির গ্রহণযোগ্যতায বেড়ে চলেছে। মানুষকে বেশ ভালো করে পাঠদান করা হয়েছে এভাবে - যদি নির্বিঘ্নে বেঁচে থাকতে হয়, তা হলে অন্যকে ফাঁকি দিয়ে নিজের লাভটি হাসিল করতে হবে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ বলে একটা কথা প্রায়ই উচ্চারিত হয়। কিন্তু বিপরীতটাই সত্য অর্থাৎ দুর্নীতির প্রতি বড় প্রশ্রয়। রাজনৈতিক সদিচ্ছা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না থাকলে কার্যকরভাবে দুর্নীতি কমানো যাবে না। সবচেয়ে বড় কথা আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা সক্ষমতা থেকে অনেক দূরে পাঠিয়ে দিয়েছি।

এটাই আসল সংকট। নাগরিক সমাজের ভেতরে দুর্নীতির প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই দুর্নীতি চলছে এবং চলবেও। তাই শিল্পকলা বা শিক্ষা জগতের মানুষও এ থেকে দূরে থাকতে পারে না।

এ কথা সত্য যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আছে। কিন্তু যারা বিভিন্ন দালালির মাধ্যমে, ঘুষের বিনিময়ে পদ পদবী গ্রহণ করেন তাদের অনেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটু আধটু কথাও বলেন। দুর্নীতির অভিযোগে বিভিন্ন সময় রাজনীতিকদের জেলে যেতে হয়েছে। সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গায় আছে আমলাতন্ত্র। তাদের বাঁচাতে রাজনীতিকরাই আইন করে রেখেছে। বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের সারণিতে ক্রমাগত নিচে নামছে। এই যাত্রার গতি ফেরাতে সমাজ এবং রাজনীতির চালকদের একই সঙ্গে তৎপর হতে হবে। সেটা কবে হবে তা কেউ জানে না।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এএসএম