ফিচার

বিপ্লবী নারী জোয়ান অব আর্কের বীরত্বগাথা

মাত্র ১৯ বছর বয়স তার। ১৪৩১ সালের ৩০ মে একটি পিলারের সঙ্গে বেঁধে ফেলা হয় তাকে। জনসম্মুখে তাকে পোড়ানো হয় খড়ের মতো। এতে ক্ষান্ত হয়নি শত্রুরা। পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া শরীরটিকে আরও দু'বার পোড়ানো হয়। ফলে তার ছাইগুলো এতো মিহি হয়ে যায় যে কেউ তা সংগ্রহ করতে পারে না। তার দোষ ছিল নারী হয়ে পুরুষের পোশাক পরতেন তিনি।

Advertisement

বলছিলাম ইতিহাসের অন্যতম নারী বিপ্লবী জোয়ান অব আর্কের কথা। জোয়ান অব আর্ক ইতিহাসের এক অবিসংবাদিত যোদ্ধা, সেনাপতি ও বিপ্লবী। ১৪১২ সালের ৬ জানুয়ারি মিউজ নদীর তীরে দঁরেমি গ্রামের এক সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্ম জোয়ানের। ফ্রান্স তখন ইংরেজদের দখলে। মেয়ে হলেও ছেলেদের মতো করেই সব কাজ শিখেছেন ছোটবেলায়। বাবা জেকের খামারে কৃষি কাজ শিখেছেন। আবার মা ইসাবেলর কাছ থেকে শেখেন সেলাইর কাজ।

তবে শৈশবে জোয়ান ছিলেন খুব ধার্মিক একজন কিশোরী। তিনি এমন এক অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন, যেখানে ফ্রান্স-ইংল্যান্ড যুদ্ধের কারণে চরম দরিদ্রতা বিরাজ করছিল। বারো বছর বয়সের পর থেকেই শুরু হয় তার জীবনে রহস্যময়তা। সেসময় তিনি বলতে থাকেন যে, তিনি ঈশ্বরের কাছ থেকে ফ্রান্সকে পুনর্গঠন করার নির্দেশ পেয়েছেন।

জোয়ান লেখাপড়া জানতেন না। কথিত আছে, মাত্র তের বছর বয়সে মাঠে ভেড়ার পাল চড়ানোর সময় তিনি দৈববাণী শুনতে পান যে, তাকে মাতৃভূমির স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার ও ফ্রান্সের প্রকৃত রাজাকে ক্ষমতায় পূনর্বহাল করার জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। এই দৈববাণী তার জীবনকে আমূল পালটে দেয়।

Advertisement

এরপর জোয়ান পালিয়ে ফ্রান্সের পলাতক রাজা সপ্তম চার্লসের সঙ্গে দেখা করেন। দেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য তার কাছে সৈন্য প্রার্থনা করেন। রাজা প্রথমে অবজ্ঞা প্রদর্শন করলেও যাজক সম্প্রদায়ের পরামর্শে জোয়ানকে সৈন্যসাহায্য দিতে সম্মত হন। এই সময় বিখ্যাত ফরাসি ধর্মগুরু সেইন্ট মাইকেল ও সেইন্ট ক্যাথরিনের কাছ থেকে তিনি ফ্রান্সকে নেতৃত্ব দেয়ার উৎসাহ পান। জোয়ান সাদা পোশাক পরিধান করে একটি সাদা ঘোড়ায় চড়ে পঞ্চক্রুশধারী তরবারি হাতে ৪০০০ সৈন্য নিয়ে ১৪২৯ সালের ২৮শে এপ্রিল অবরুদ্ধ নগরী অরলেয়াঁয় প্রবেশ করেন।

প্রথম আক্রমণেই তারা জয়লাভ করেন এবং এরপর তাদের একের পর এক সাফল্য আসতে থাকে। কিছুদিনের মধ্যেই তারা ইংরেজ সৈন্যদের কবল থেকে তুরেলবুরুজ শহর উদ্ধার করেন। এরপর পাতে'র যুদ্ধেও ইংরেজরা পরাজিত হয়। জুন মাসে জোয়ান তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে শত্রুদের ব্যূহ ভেদ করে রেইমস নগরী অধিকার করেন। এরপর ১৬ই জুলাই সপ্তম চার্লস ফ্রান্সের রাজা হিসেবে আবার সিংহাসনে অভিষিক্ত হন এবং এভাবে জোন ফ্রান্সকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে দেন। জোনের মাধ্যমে ফ্রান্স ইংল্যান্ডের মধ্যকার শতবর্ষ ব্যাপী যুদ্ধ অবসান ঘটে।

সেইন্ট ও অ্যাঞ্জেলদের স্বপ্নে দেখার কথা বলেছিলেন জোয়ান, যারা তাকে ষষ্ঠ চার্লসকে যুদ্ধে সহায়তা করে ইংল্যান্ডের অধীনস্ততা থেকে ফ্রান্সকে মুক্ত করতে বলেছিলেন। পুরুষের বেশ ধরে যুদ্ধে যান জোয়ান। চার্লস তাকে পাঠান অরলিন্স এ। টানা দেড় বছর ধরে ইংরেজরা যেখানে জিতে চলছিল, সেখানে জোয়ানের আগমনের মাত্র নয় দিনের মাথায় পরাজিত হয় তারা।

এরপরে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে সাহসের সঙ্গে লড়াই করে জয় নিয়ে আসেন জোয়ান। জোয়ানের খণ্ডযুদ্ধগুলো জয়ের ঘটনা প্রবল উদ্যম ছড়িয়ে দেয় ফ্রেঞ্চ বাহিনীর মধ্যে। ১৮০৩ সালে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট জোয়ান অব আর্ককে ফ্রান্সের জাতীয় প্রতীক হিসেবে ঘোষণা করেন।

Advertisement

ফ্রান্সের স্বাধীনতার পর ইংরেজরা জোয়ানকে জব্দ করার ফন্দি আঁটতে থাকে। ১৪৩০ সালের মে মাসে ইংরেজদের সহায়তাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান জোয়ান। ইংরেজদের কাছে তাকে হস্তান্তরের পর তারা তার বিচার শুরু করে। পিয়েরে কশন নামের এক বিশপ ছিল আদালতের বিচারক। কশন জোয়ানের বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিযোগ আনে যার মধ্যে বড় একটি অভিযোগ ছিল জোয়ানের নারী-পুরুষ উভয়ের পোশাক পরা! বিচারে মৃত্যুদণ্ড হয় জোয়ানের। তবে এটা জোয়ানের কতখানি অপরাধের তালিকায় পরে, তা নিয়েও কথা হয়নি যেসময়।

বিচারে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে তিনি ঈশ্বরের দয়ায় বিশ্বাস করেন কিনা। জবাবে জোয়ান বলেছিলেন, ‘যদি আমি তা না করি তবে ঈশ্বর যেন আমাকে সেখানেই রেখে দেন, আর যদি বিশ্বাস করি তবে ঈশ্বর যেন আমাকে রক্ষা করেন।’ আসলে এই প্রশ্নটি ছিল জোয়ানকে ফাঁদে ফেলার একটি সুযোগ।

কারণ কেউ ঈশ্বরের দয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেনা। যদি জোয়ান বলতেন হ্যাঁ করি, তবে তাকে ধর্মের বিরুদ্ধে যাবার অভিযোগ আনতেন আর যদি জোয়ান বলতেন "না" তবে বলা হতো তিনি নিজের অভিযোগ নিজেই স্বীকার করেছেন।

ছলচাতুরি বিচারে আদালত তাকে ১২ নম্বর আর্টিকেল অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত করে। আইন সম্পর্কে অজ্ঞ জোয়ান তখন বুঝতে পারেননি যে আসলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হচ্ছে। সে সময় ধর্মের বিরুদ্ধে যাওয়ার ছিল শাস্তি ছিল সর্বোচ্চ শাস্তি। তাকে সে শাস্তি মৃত্যদণ্ডই দেয়া হয়েছিল।

কারাগারে জোয়ান মেয়েদের পোশাক পরিধান করা শুরু করেন। এর কয়েকদিন পর তাকে কারাগারেই ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনার পর জোয়ান আবার পুরুষদের পোশাক পরিধান শুরু করেন। এর পেছনে মূল কারণ ছিল ছেলেদের পোশাকে নিরাপত্তা বেশি পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়াও আরেকটি বড় কারণ ছিল জোয়ানের কাছে তখন পরার জন্য অন্য কোনো বস্ত্র অবশিষ্ট ছিলনা।

এরপর সেই দিন আসে। যেদিন জনসম্মুখে পুড়িয়ে মারা হয় এই বিপ্লবী নারীকে। মৃত্যুর আগে গীর্জার যাজকদের কাছে একটি ক্রুস চেয়েছিলেন জোয়ান। একজন চাষী একটি ছোট ক্রুস তৈরি করে জোয়ানের পোশাকের সামনে ঝুলিয়ে দেন। জোয়ানের মৃত্যুর পর ফরাসিরা চিরতরে ফ্রান্সে ইংরেজদের সকল অধিকার ও চিহ্ন মুছে দেয়ার প্রয়াস পায়।

তবে মৃত্যুর ১৫ বছর পর নির্দোষ প্রমাণিত হয় জোয়ান। ১৪৫৬ সালে পোপ তৃতীয় ক্যালিক্সটাসের নেতৃত্বে গঠিত একটি আদালতে জোয়ানকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়। একদিকে নারীদের দমাতে, অন্যদিকে জোয়ানের উপর প্রতিশোধ নিতেই মূলত ইংরেজরা এমন পাষণ্ড হয়েছিল।

জোয়ান অব আর্ককে নিয়ে তৈরি হয়েছে উপন্যাস, ডকুমেন্টরি, সিনেমা। যে গল্প দেখার সময় চোয়াল শক্ত হয়েছে অনেকের। বিপ্লবী মন জেগে উঠেছে অনেক নারীর। তার সঙ্গে ঘটা নির্মমতা কাঁদিয়েছে সবাইকে। এখনো পৃথিবীর ইতিহাসে জোয়ান অব আর্ক এক প্রেরণার নাম। ফ্রান্সের প্যারিসে জোয়ানের একটি স্ট্যাচু রাখা হয়েছে।

সূত্র: হিস্টোরি ডটকম/ লাইভ সাইন্স

কেএসকে/এএসএম