ভ্রমণ

শীতের চাদরে মোড়া স্বপ্নিল সাজেক

কেউ তাকে বলে মেঘের দেশ। কেউ বলে মেঘবালিকা। মেঘের রাজ্যও বলে কেউ কেউ। মেঘের ভেলায় ভাসা আলাদা এক স্বর্গীয় রাজ্যই সাজেক ভ্যালি। যে নামেই ডাকি না কেন তাতে সাজেকের রূপ-যৌবনে ভাটা পড়ে না। সেই মায়াবী সাজেক এখন সেজেছে নতুন রূপে। শীতের চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে নিজেকে। মেঘের ভেলা, কুয়াশা, হিমশীতল বাতাস, পাহাড় আর প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য এখন মিলেমিশে একাকার।

Advertisement

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বরফঢাকা উপত্যকাগুলো জনপ্রিয় পর্যটন স্পট। বিশেষ করে ভারতের কাশ্মীর, সিমলা, মানালি কিংবা সিকিমের ইয়ামথাং ভ্যালির মতো উপত্যকা জনপ্রিয়তার শীর্ষে। আমাদের দেশে বরফ পড়ে না। সে অর্থে উপত্যকাও কম। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার অন্তর্গত সাজেক ইউনিয়নের একটি উপত্যকা সাজেক ভ্যালি। মাটির পাহাড় বেশি বৈচিত্র্যময়। তাই সাজেক ভ্যালি যেমন সবুজ তেমন যেন মেঘ মোড়ানো কোনো ঊর্বশী। জনপ্রিয় এই ভ্রমণ গন্তব্যটি তাই অন্য সবার চেয়ে আলাদা। সাজেকের উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিণে রাঙামাটির লংগদু, পূর্বে ভারতের মিজোরাম, পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা অবস্থিত।

ভ্রমণপ্রিয় মানুষের কাছে সাজেক এখন অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্য। পাহাড় কখনো মানুষকে একেঘেঁয়ে করে না। তাই সাজেক বারবার পর্যটকদের হাতছানি দেয়। ক্যাম্পাস জীবনের আট বন্ধুতে এবারের সাজেক যাত্রা। চাকরি জীবনের ছন্দ পতন ঘটিয়ে ক্ষণিকের জন্য আবার সেই আড্ডার জীবনে ফেরা।

পূব আকাশে সূর্যের রক্তিম আলোর উঁকি

Advertisement

ভ্রমণের আনন্দ শুরু হয়ে যায় মূলত রাজধানী থেকে বাসে ওঠার পরই। কলাবাগান থেকে বাসে উঠে পড়লাম সাতজন। একজনের জন্য তখনও অপেক্ষা। সুদূর গাইবান্ধা থেকে আসা বন্ধু আরাফাত গাড়ি ছাড়ার নির্ধারিত সময়েও পৌঁছায়নি। বাসের অন্য যাত্রীরা চলে আসায় ওকে রেখেই বাস ছাড়লো। বন্ধুকে বললাম উবার বা পাঠাওয়ে করে আরামবাগ আসতে। ওখান থেকেও যাত্রী উঠবে। অবশেষে বন্ধু আরাফাত আরামবাগ থেকে আমাদের সঙ্গী হলো। শুরু হলো আমাদের স্বস্তির যাত্রা।

বাসের বেশিরভাগ যাত্রীই বলতে গেলে পর্যটক। বৃহস্পতিবার রাত হওয়ায় ঢাকা থেকে বের হওয়ার গাড়ির চাপ বেশি ছিল, এ কারণে রাস্তায় জ্যামও একটু বেশি ছিল। ঢাকা থেকে বের হওয়ার কুয়াশা ভেদ করে চলতে থাকে আমাদের বাস। চলতে থাকে আমাদের গল্প-আড্ডা। কতদিন পর দেখা, একে একে সবাই বলতে থাকে জমানো কথা, চলে স্মৃতিচারণ।

রাত দেড়টার দিকে আমাদের বাস পৌঁছায় কুমিল্লা। সেখানে ২০ মিনিটের যাত্রাবিরতি। সবাই নেমে পড়ি। চা-পর্ব শেষ করে আবার উঠে পড়ি গাড়িতে। এ যাত্রায় সবাই ঘুম।

পাহাড়ের কোলে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর বাসিন্দাদের বাড়ি

Advertisement

ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙে মূলত বাসের অস্বাভাবিক মুভমেন্টের কারণে। আঁকা-বাঁকা পথ বেয়ে চলার কারণে বাসের এমন মুভমেন্ট। বুঝতে পারলাম আমরা ঢুকে পড়েছি পাহাড়ি জেলা খাগড়াছড়িতে। বাসের পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতেই চোখে পড়ে খাগড়াছড়ির মূল আকর্ষণ পাহাড়। ছোট ছোট পাহাড় ভেদ করে সরু রাস্তায় ছুটে চলছে আমাদের গাড়ি। কিছুক্ষণ পর সকাল সাড়ে ৬টার দিকে আমরা পৌঁছে যাই বাস কাউন্টারে। নেমে পড়ি সবাই। শীতের স্নিগ্ধ সকাল আর পাহাড়বেষ্টিত খাগড়াছড়ির নির্মল প্রকৃতি একটা অন্যরকম অনুভূতি জাগায়। সাজেক রাঙ্গামাটি জেলায় হলেও যাওয়ার জন্য খাগড়াছড়ি হয়ে যাওয়াই প্রথম পছন্দ।

কিছুক্ষণ হেঁটে আমরা পৌঁছে যাই পৌর গেট সংলগ্ন শাপলা চত্বরে। এখান থেকেই ভাড়া করতে হয় সাজেক যাওয়ার অন্যতম বাহন চান্দের গাড়ি। বিভিন্ন প্যাকেজে পাওয়া যায় এই গাড়ি। আমরা আটজন হওয়ায় বাড়তি লোকের প্রয়োজন হয়নি। নিজেদের মতো করে সময় কাটানোর জন্য একটা জিপ ভাড়া করলাম। এক রাত দুই দিনের জন্য সাড়ে ১০ হাজার টাকা। শহরের একটা হোটেলে সাময়িকের জন্য রুম নেওয়া ছিল আমাদের। মূলত ফ্রেশ হওয়ার জন্য এই রুম নেওয়া। সব পর্যটকের জন্যই এই সুবিধা আছে। চাইলে যে কেউ এই হোটেলে ফ্রেশ হতে পারবেন। আমাদের ভাড়া ছিল ছয়শ টাকা। ফ্রেশ হওয়ার মাঝপথেই চান্দের গাড়ি এসে হাজির হোটেলের নিচে। চালকের ফোন পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে নেমে আসি সবাই। চালকসহ সবাই নিকটস্থ একটি হোটেলে সেরে নেই সকালের খাবার।

এবার চান্দের গাড়িতে সাজেক যাত্রানাস্তা সেরে উঠে পড়ি চান্দের গাড়িতে। খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। বলতে গেলে প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ। কিন্তু দেড়ঘণ্টায় সেখানে যাওয়া যায় না। একেতো পাহাড়ি উঁচু-নিচু, আঁকা-বাঁকা পথ, তারওপর কিছু আনুষ্ঠানিকতা আছে সাজেকযাত্রায়। খাগড়াছড়ি থেকে প্রথমে পৌঁছাতে হবে দিঘীনালায়। সেখানে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প আছে। মূলত সেনাবাহিনী পর্যটকদের নিরাপত্তায় দিনে দুবার পর্যটকদের গাড়ি সাজেকে পৌঁছে দেয়। সেনাবাহিনীর এসকর্ট দিনে দুবার ছাড়ে। প্রথমটি ছাড়ে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে (একটু কম-বেশি হতে পারে। দ্বিতীয়টি ২টা থেকে আড়াইটার মধ্যে।

চান্দের গাড়িতে যাত্রা শুরু

৯টার মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাই দিঘীনালা ক্যাম্পে। সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্যদের কাছে তথ্য দিতে হয়। তথ্য দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি সেখানে। একে একে অন্য গাড়িগুলো চলে আসে। মোটরসাইকেলসহ অনেক মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকারও এসকর্টে যোগ দেয়। এরপর সকাল ১০টার কিছু সময় পর ছেড়ে দেয় এসকর্ট।

আর্মি ক্যাম্পে অপেক্ষায় গাড়ির বহর

পাহাড়ি পথ বেয়ে চলে গাড়ির বহর। সবুজে ঘেরা পাহাড়ি রাস্তায় সে এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে। দুদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। এই অনেক উপরে তো আবার অনেক নিচে। প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে থাকবেন আপনি। উঁচু-নিচু পথে পরক্ষণেই চমকে উঠবেন। কিছু কিছু রাস্তা এত উঁচু যে ভয়ে চোখ বন্ধ রাখতে হয়।

এই পথ বেয়ে চলে চান্দের গাড়ি

পথে পথে পাহাড়ি শিশুদের আতিথেয়তাপাহাড়ি এই অঞ্চলে মানুষের ঘনবসতি নেই। কিছুদূর পর পর রাস্তার পাশে চোখে পড়ে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর বাসিন্দাদের বাড়ি। এই রাজ্য শুধু তাদেরই। এখানে নেই কোলাহল, আধুনিকতা। লড়াই করে টিকে থাকাই এখানকার সহজ-সরল বাসিন্দাদের মুখ্য চিন্তা। তাদের জীবনযাপনে নেই কোনো আধুনিকতার ছোঁয়া। পথে পথে পর্যটকদের দেখে চোখে-মুখে তৃপ্তির ভাষা ফুটে ওঠে। আর এখানকার ছোট ছোট শিশুরা হাত নেড়ে অভিবাদন জানায় পর্যটকদের। অবশ্য তাদের এই অভিবাদন জানানোর পেছনে ক্ষুদ্র কিছু প্রত্যাশা কাজ করে। আর তা হলো পর্যটকদের কাছ থেকে চকোলেট, চিপসের মতো সামান্য উপহার পাওয়া। পর্যটকরাও তাদের হতাশ করেন না। পর্যটকদের উপহার পেয়ে তাদের খুশির যেন সীমা ধরে না। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিক থেকে শিশুদের এসব উপহার দেওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। কারণ এসব উপহার কুড়াতে গিয়ে দ্রুতগতির গাড়িতে শিশুদের দুর্ঘটনায় পড়ার আশঙ্কা থাকে। এর আগে দুর্ঘটনা ঘটায় এমন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। এভাবে পথের অ্যাডভেঞ্চার শেষ করে দুপুরে পৌঁছালাম সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাজেকে।

হাত নেড়ে পর্যটকদের স্বাগত জানাচ্ছে দুই শিশু

রোমঞ্চকর রিসোর্টচান্দের গাড়ি থেকে নেমে সোজা চলে গেলাম আগে থেকে ঠিক করে রাখা রিসোর্টে। এখানে কিছুটা ছন্দপতন ঘটে। রিসোর্ট সংকটের কারণে দুই রিসোর্টে রুম নিতে হয়েছে আমাদের। ফলে সাময়িকের জন্য আমাদের আট বন্ধু দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেলাম। মোটামুটি আধুনিক সব সুযোগই রাখা হয়েছে এসব রিসোর্টে। রিসোর্টগুলো এমনভাবে বানানো যেখান থেকে উপভোগ করা যায় পুরো পাহাড়ের সৌন্দর্য। দুচোখ যতদূর যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। আপাতত পাহাড়ে দুচোখ বুলিয়ে ভ্রমণের ক্রান্তি দূর করার মিশনে নামলাম। রিসোর্টের ঠান্ডা পানিতে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম দুপুরের খাবার খেতে। অবশ্য সাজেকে খাবার গ্রহণের ঘণ্টাখানেক আগে হোটেলে বলে রাখা ভালো। কারণ হোটেলগুলোতে বাড়তি খাবার করা হয় না। এজন্য আগে থেকে বলে রাখা নিরাপদ। তবে আগে থেকে বলে না রাখলেও আমাদের খাবার পেতে খুব বেগ পেতে হয়নি।

রিসোর্ট থেকে দেখা যায় পুরো পাহাড়ের সৌন্দর্য

কুয়াশার চাদরে মোড়ানো সাজেকের সকালসাজেকে যারা যাবেন, কখনই ভোর মিস করবেন না। সাজেকের ভোর-সকালের সঙ্গে কোনোকিছুরই তুলনা চলে না। মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম ভোর পৌনে ৬টায়। তবে পাহাড়ের ডাকে ঘুম ভাঙে তার আগেই। পাহাড় তার সৌন্দর্য দেখার জন্যই হয়তো কানে কানে বলে যায়, ‘ওঠো হে পথিক, দেখো আমাকে।’ ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলতেই হিমশীতল একরাশ বাতাস এসে ছুঁয়ে যায় শরীর, স্নিগ্ধ করে মন। বাইরে কুয়াশার চাদরে পাহাড়ের যেন নিজেকে লুকানোর চেষ্টা। কিন্তু পাহাড় পারে না তার সৌন্দর্য লুকাতে। কুয়াশা ভেদ করে চোখ খুঁজে নেয় তার সৌন্দর্য। সূর্যিমামা হয়তো প্রস্তুত হচ্ছেন সবকিছু আলোকিত করতে। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম তার অপেক্ষায়। আর চারদিকে দেখতে থাকলাম প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। এভাবে কেটে গেলো বেশ কিছুক্ষণ। সূর্যিমামা উঠে পড়লো। তার রক্তিম আলো পাহাড়ের গায়ে পড়তেই আড়মোড়া ভাঙে সবুজ পাহাড়। হেসে ওঠে সূর্যের সঙ্গে।

পাহাড়ের আকাশে ভোরের লাল সূর্য

চলবে...

ইএ/এএ/এএসএম