ইসলামের আগমনের পর প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের প্রতি অবিশ্বাসী ইয়াহুদি তথা আহলে কিতাবের অনুসারীরা বিভিন্ন চক্রান্ত করতে থাকে। নও মুসলিমদের মধ্যে ফাটল ধরাতে তারা ইসলাম পূর্ব জীবনের বিষয়গুলো কৌশলে তুলে ধরে। এসব চক্রান্তের বিষয়গুলো কোরআনের সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এ আয়াতগুলো মুসলিমদের ঐক্য ও সত্যের পথে থাকার অন্যতম দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা। আল্লাহ তাআলা ইয়াহুদিদের চক্রান্তগুলো এভাবে তুলে ধরেছেন-
Advertisement
১. قُلۡ یٰۤاَهۡلَ الۡکِتٰبِ لِمَ تَکۡفُرُوۡنَ بِاٰیٰتِ اللّٰهِ ٭ۖ وَ اللّٰهُ شَهِیۡدٌ عَلٰی مَا تَعۡمَلُوۡنَ
‘(হে রাসুল! আপনি) বলুন, 'হে আহলে কিতাবগণ! তোমরা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের সাথে কেন কুফরি কর? আর তোমরা যা কর আল্লাহ তার সাক্ষী।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৯৮)
২. قُلۡ یٰۤاَهۡلَ الۡکِتٰبِ لِمَ تَصُدُّوۡنَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ مَنۡ اٰمَنَ تَبۡغُوۡنَهَا عِوَجًا وَّ اَنۡتُمۡ شُهَدَآءُ ؕ وَ مَا اللّٰهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُوۡنَ
Advertisement
‘(হে রাসুল! আপনি) বলুন, 'হে আহলে কিতাবগণ! তোমরা বিশ্বাসীদেরকে আল্লাহর পথে বাধা দান করছ কেন? তোমরা তার বক্রতা অন্বেষণ করছ; অথচ তোমরাই (এ বিষয়ে) সাক্ষী।[1] আর আল্লাহ তোমাদের কর্ম সম্বন্ধে উদাসীন নন।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৯৯)
৩. یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنۡ تُطِیۡعُوۡا فَرِیۡقًا مِّنَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ یَرُدُّوۡکُمۡ بَعۡدَ اِیۡمَانِکُمۡ کٰفِرِیۡنَ
‘হে মুমিনগণ! যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে, তোমরা যদি তাদের দল বিশেষের আনুগত্য কর, তবে তারা তোমাদেরকে ঈমান আনার পর আবার কাফের বানিয়ে ছাড়বে।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১০০)
৪. وَ کَیۡفَ تَکۡفُرُوۡنَ وَ اَنۡتُمۡ تُتۡلٰی عَلَیۡکُمۡ اٰیٰتُ اللّٰهِ وَ فِیۡکُمۡ رَسُوۡلُهٗ ؕ وَ مَنۡ یَّعۡتَصِمۡ بِاللّٰهِ فَقَدۡ هُدِیَ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ
Advertisement
‘কিরূপে তোমরা কাফের হয়ে যাবে? অথচ আল্লাহর আয়াত তোমাদের নিকট পাঠ করা হয় এবং তোমাদের মধ্যেই তাঁর রসূলও বিদ্যমান রয়েছে। আর যে আল্লাহকে অবলম্বন করবে,[1] সে অবশ্যই সরল পথ পাবে।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১০১)
আয়াত নাজিলের কারণ
এ আয়াতগুলোর বিশেষ একটি ঘটনার প্রসঙ্গে নাজিল হয়েছে। ঘটনাটি মুমিন মুসলমানের জন্য ইসলামের উপর অটুট থাকায় বিশেষ দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা।
ইয়াহুদিদের চক্রান্ত ও প্রতারণা এবং তাদের পক্ষ থেকে মুসলিমদের পথভ্রষ্ট করার নিকৃষ্টতম প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করার পর মুসলিমদেরকে সতর্ক করা হচ্ছে যে, তোমরাও তাদের কূট-চক্রান্তের ব্যাপারে হুঁশিয়ার থাকবে। সাবধান! কোরআন তেলাঅত এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তোমরা যেন তাদের জালে ফেঁসে না যাও।
তাফসিরের বর্ণনায় এর প্রেক্ষাপট এইভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে-
ইয়াহুদি শাম্মাস ইবনে কায়স ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি অত্যন্ত হিংসাপরায়ণ ছিল। মদিনার আনসারদের দুটি গোত্র ‘আউস এবং খাযরাজ’ কোনো এক মজলিসে এক সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করছিল। ইয়াহুদি শাম্মাস ইবনে কায়স তাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের পারস্পরিক এই সৌহার্দ্য দেখে জ্বলে উঠল। যারা এক সময় একে অপরের কঠোর শত্রু ছিল, তারা আজ ইসলামে প্রবেশের বরকতে দুধে চিনির মত পরস্পর অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হয়েছে!
এমন সময় সে একজন যুবককে দায়িত্ব দিল যে, তুমি তাদের মাঝে গিয়ে সেই ‘বুআষ’ যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দাও; যা মদিনায় হিজরতের আগে তাদের মাঝে সংঘটিত হয়েছিল। সেই যুদ্ধে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে যে বীরত্ব প্রকাশক কবিতাগুলো পড়েছিল, তা ওদেরকে শুনাও।
শাম্মাস ইবনে কায়সের কথা মতো সে যুবক গিয়ে তা-ই করল। ফলে উভয় গোত্রের আগের আক্রোশের আগুন পুনরায় জ্বলে উঠলো এবং পরস্পরকে গালাগালি করতে লাগলো।
এমন কি অস্ত্র ধারণের জন্য একে অপরকে ডাকাডাকি শুরু করে দিলো। উভয়পক্ষ আপোসে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে পড়েছিল।
এমন সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপস্থিত হয়ে তাদেরকে বুঝালেন। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথায় তারা বিরত হয়ে গেলো। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াত এবং পরের আয়াতও নাযিল হয়। (ইবনে কাসির)
এ আয়াতগুলো নাজিল করে মহান আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে সাবধান করছেন যে, তারা যেন আহলে কিতাব তথা ইয়াহুদি ও নাসারাদের আনুগত্য না করে। কেননা তারা মুমিনদেরকে আল্লাহ তাআলা যে ননি ও কিতাবের নেয়ামত প্রদান করেছেন সেটার হিংসায় জ্বলে যাচ্ছে। কারণ তাদের অনুসরণ করলে তারা মুমিনদেরকে কাফের বানিয়ে ছাড়বে। অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন-
‘কিতাবিদের অনেকেই চায়, যদি তারা তোমাদেরকে তোমাদের ঈমান আনার পর কাফেররূপে ফিরিয়ে নিতে পারত। সত্য স্পষ্ট হওয়ার পরও তাদের নিজেদের পক্ষ থেকে বিদ্বেষবশত (তারা এটা করে থাকে)।’ (সুরা বাকারা : আয়াত [সূরা আল-বাকারাহ ১০৯)
এ আয়াতগুলো থেকে ইয়াহুদি-নাসারাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার ইঙ্গিতও ফুটে এসেছে। হজরত কাতাদাহ বলেন, আয়াতের অর্থ, আল্লাহ তোমাদেরকে ইয়াহুদি-নাসারাদের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছেন; যেমনটি তোমরা শুনলে। তোমাদেরকে তাদের ভ্রষ্টতা সম্পর্কেও সাবধান করেছেন।
সুতরাং তোমরা কোনভাবেই (ইয়াহুদি-নাসারাদের) তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে নিরাপদ ভেবো না। আর তোমাদের জানের ব্যাপারেও কল্যাণকামী মনে করো না। পক্ষেই তারা পথ ভ্রষ্ট হিংসুটে শক্র। কিভাবে তোমরা এমন এক সম্প্রদায়কে নিরাপদ মনে করতে পার যারা তাদের কিতাবের সাথে কুফর করেছে; রাসুলদের হত্যা করেছে; দ্বীনের ব্যাপারে বিভ্রান্তিতে লিপ্ত রয়েছে এবং নিজেরা অপারগ হয়ে গেছে। আল্লাহর শপথ, এরা নিঃসন্দেহে অবিশ্বাস্য ও শক্র।’ (তাফসিরে তাবারি)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআনের দিকনির্দেশনা, সতর্কতাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। অবিশ্বাসীদের চক্রান্ত থেকে নিজেদের হেফাজত করতে কোরআন অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম