দেশজুড়ে

খুন, ধর্ষণ, রাজনীতি আর কুয়েট শিক্ষক নিয়ে আলোচিত খুলনা

মহামারী করোনায় অসংখ্য মৃত্যু, মা-বাবা ও মেয়েকে কুপিয়ে হত্যা, খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবুর উপর কাদা ছোড়া, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নিজ শ্যালীকাকে কুপিয়ে হত্যা, আবাসিক হোটেলে গোয়েন্দা পুলিশের এসআইয়ের হাতে মেয়ের সামনে মাকে ধর্ষণ, একাধিক কিশোর গ্যাংয়ের অস্বাভাবিক দৌরাত্ম্য, করোনা পরীক্ষার আড়াই কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং ছাত্রলীগ নেতাদের মানসিক নির্যাতনে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষকের অস্বাভাবিক মৃত্যুর মতো আলোচিত সমালোচিত ঘটনার সাক্ষী হয়ে বিদায় নিয়েছে ২০২১ সাল।

Advertisement

তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে বছরের শেষ দিকে এসে খুলনা বিএনপি থেকে নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে মাইনাসের ঘটনা। যার সূচনা হয় নগর ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার মধ্যে দিয়ে। খুলনায় বিএনপির রাজনীতিতে তৈরি হয় মেরুকরণ। মঞ্জু মাইনাসের পর দল থেকে ঘোষণা দিয়ে পদত্যাগ করেন ছয় শতাধিক নেতাকর্মী।

চলতি বছরের ৩১ মে সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা উপজেলার দশহালিয়ায় বাঁধ মেরামতে নিয়োজিত এলাকাবাসীর রোষের মুখে পড়েন স্থানীয় সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু। কপোতাক্ষ নদের পাড়ে বাঁধের একটি ভাঙা অংশ এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামতের কাজ করছিলেন। তারাই এমপি বাবুকে দেখে ক্ষেপে ওঠেন, চিৎকার করেন, কেউ কেউ কাদা ছুড়ে মারেন। প্রায় এক ঘণ্টা পর তিনি আবার ঘটনাস্থলে ফিরে যান।

২৬ অক্টোবর কয়রা উপজেলার বাগালী ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন নিজ বাড়িতে ঘুমন্ত অবস্থায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় হাবিবুল্লাহ গাজী (৩৩), তার স্ত্রী বিউটি খাতুন (২৫) ও তাদের একমাত্র সন্তান হাবিবা খাতুন টুনিকে। প্রায় দুই মাস পার হলেও পুলিশ এর ক্লু-উদঘাটন করতে পারেনি।

Advertisement

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পুলিশ পরিদর্শক মো. আসাদুল ইসলাম বলেন, তারা আশাবাদী হত্যার ক্লু অতি দ্রুত উদঘাটন করতে পারবেন।

খুলনার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে (সদর) বিদেশগামীদের করোনার সংক্রমণ শনাক্তের পরীক্ষার ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগও ছিল দেশে আলোচনার কেন্দ্রে। এ ঘটনায় হাসপাতালের টেকনোলজিস্ট প্রকাশ কুমার দাসের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রকাশ বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত করোনা পরীক্ষার ফি বাবদ ৪ কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা আদায় হলেও সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৬৬ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। ল্যাব টেকনোলজিস্ট ও ল্যাব ইনচার্জ প্রকাশ কুমার দাস বাকি ২ কোটি ৫৭ লাখ ৯৭ হাজার টাকা জমা দেননি।

এদিকে শহরের আবাসিক হোটেলে মেয়ের সামনে মাকে ধর্ষণ ছিল বছরের শেষের দিকে খুলনা জেলার আলোচিত ঘটনা। এ ঘটনায় মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) গোয়েন্দা শাখার এসআই মো. জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রেফতার এবং সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। জাহাঙ্গীর চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের মো. আতিয়ার রহমানের ছেলে।

Advertisement

বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার এক নারী তার ১১ বছরের অসুস্থ মেয়েকে ডাক্তার দেখানোর জন্য ভাগ্নেকে সঙ্গে নিয়ে ৭ ডিসেম্বর বিকেলে খুলনায় আসেন। রাত হয়ে যাওয়ায় কোনো ডাক্তারের সিরিয়াল না পেয়ে তারা সুন্দরবন আবাসিক হোটেলে ওঠেন। ওই নারী মেয়েকে নিয়ে হোটেলের একটি কক্ষে এবং তার ভাগ্নে ছিল পাশের কক্ষে। গভীর রাতে মিথ্যা অভিযোগ এনে ওই নারীকে ধর্ষণ করেন জাহাঙ্গীর। পরে মা-মেয়ের চিৎকারে অন্যরা এগিয়ে এসে এসআই জাহাঙ্গীরকে আটকে রেখে পুলিশে দেয়। এসআই জাহাঙ্গীর বর্তমানে খুলনা জেলা কারাগারে রয়েছেন। ঘটনার সময় জাহাঙ্গীর মাদকাসক্ত ছিলেন বলে পুলিশ জানিয়েছে।

বছরের শেষ দিকে এসে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) হলে ডাইনিংয়ের ম্যানেজারের পদ পেতে ছাত্রলীগ নেতাদের মানসিক নির্যাতনে ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের প্রফেসর ড. মো. সেলিম হোসেনের মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনার পর ক্যাম্পাস উত্তাল হয়ে ওঠে। এ ঘটনায় প্রাথমিকভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কুয়েট ছাত্রলীগ সম্পাদকসহ ৯ শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার এবং তদন্ত কমিটি গঠন করে দু’ দফায় বিশ্ববিদ্যলয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ৩০ নভেম্বর কুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ড. সেলিমকে অনুসরণ করে তার ব্যক্তিগত কক্ষে প্রবেশ করেন। আনুমানিক আধা ঘণ্টা শিক্ষকের কক্ষে অবস্থান করেন তারা। সেখানে শিক্ষককে জেরা, অপমান, অবরুদ্ধ করে রাখা ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। পরে ক্যাম্পাস সংলগ্ন বাসায় যান শিক্ষক ড. সেলিম। সেখানে দুপুর ২টার দিকে ওয়াশরুমে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন এবং পরে মারা যান। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা এখনও কাটেনি।

খুলনা বিএনপির রাজনীতিতে চলমান গ্রুপিং বছরের শেষভাগে এসে প্রকাশ্য রূপ নেয়। ৯ ডিসেম্বর অ্যাডভোকেট এসএম শফিকুল আলম মনাকে আহ্বায়ক, তরিকুল ইসলাম জহিরকে ১নং যুগ্ম-আহ্বায়ক ও মো. শফিকুল আলম তুহিনকে সদস্য সচিব করে খুলনা মহানগর; আমির এজাজ খানকে আহ্বায়ক, আবু হোসেন বাবুকে ১নং যুগ্ম-আহ্বায়ক ও মনিরুল হাসান বাপ্পিকে সদস্য সচিব করে খুলনা জেলা বিএনপির আংশিক আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন দেয়া হয়। এরপরই নগর শাখার বিদায়ী সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু ও তার অনুসারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।

বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সংবাদ সম্মেলন করে অযোগ্যদের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে তাদের নেতৃত্ব পুনর্বহালের দাবি জানান নজরুল ইসলাম মঞ্জু। পরে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মেনে না নেওয়ায় মঞ্জুকে শোকজ করা হয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

এছাড়া জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলায় প্রতিপক্ষকে (সৎ ভাইদের) ঘায়েল করতে শ্যালিকা তিলোত্তমা মণ্ডল পুতুলকে বাড়িতে ডেকে এনে কুপিয়ে হত্যা করেন ভাগ্নিপতি প্রকাশ। পরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তিনি। তাকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়।

আলমগীর হান্নান/এফএ/জিকেএস