আমানত, তারল্য, মুনাফা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সংকটের মধ্যে দেশের অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। দিন যত যাচ্ছে অব্যাংকিং আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর সংকট তত বাড়ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বেশিরভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠানই এখন করুণ দশায় রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় বেশি দেখাতে বিশেষ ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এ বিশেষ ছাড়ের ফলে সুবিধা মিলবে কি না তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
Advertisement
তারা বলছেন, এমনিতেই অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে আর্থিক খাতের ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। তার ওপর মহামারি করোনার প্রকোপের কারণে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সবকিছু মিলিয়ে বেশিরভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমস্যায় রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, ২৫ শতাংশ পরিশোধ করে নিয়মিত দেখানো ঋণের বিপরীতেও পুরো সুদ আয় খাতে দেওয়ার সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এ সুবিধা কয়টি প্রতিষ্ঠান নিতে পারবে তা দেখার বিষয়। কারণ যারা ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি তারা এই ২৫ শতাংশও দেবে না। তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ছাড়ের কারণে কিছু প্রতিষ্ঠান সুফল পেতে পারে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, তালিকাভুক্ত ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান লোকসানের কবলে পড়েছে। মুনাফার দেখা পেলেও আগের বছরের তুলনায় তিনটির মুনাফা কমে গেছে। পরিচালন নগদ প্রবাহ বা ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে ছয়টির। সম্পদমূল্য ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে দুটির। আরও সাতটির সম্পদমূল্য কমে গেছে।
Advertisement
সার্বিকভাবে আমানত, তারল্য, মুনাফা, সম্পদমূল্য—সবক্ষেত্রেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংকটের মাত্রা বেড়েছে। মুনাফা, সম্পদমূল্য অথবা ক্যাশ ফ্লো—এই তিনটি সূচকের এক বা একাধিক সূচকে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ১৪টি কোম্পানির। তিন সূচকের কোনোটিতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠানের।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তালিকাভুক্ত ২৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এখনো পর্যন্ত উত্তরা ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি) সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারেনি। এছাড়া পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (পিএলএফএসএল) আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ দীর্ঘদিন ধরেই বন্ধ।
আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ফারইস্ট ফাইন্যান্স, ফাস (এফএএস) ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, মাইডাস ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং এবং ইউনিয়ন ক্যাপিটাল লোকসানে রয়েছে।
এর মধ্যে চলতি বছরের নয় মাসের ব্যবসায় সবচেয়ে বেশি লোকসান করেছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। এই প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ৭ টাকা ৭১ পয়সা। আগের বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ১১ টাকা ৩৮ পয়সা। বড় ধরনের লোকসানের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির সম্পদমূল্যও ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে শেয়ারপ্রতি সম্পদ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ১৫২ টাকা ৬৪ পয়সা, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ১৪৪ টাকা ৯৩ পয়সা।
Advertisement
এর পরের স্থানে রয়েছে ফাস ফাইন্যান্স। চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর এই নয় মাসের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ৭ টাকা ২০ পয়সা। আগের বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ৮ টাকা ৪৫ পয়সা। প্রতিষ্ঠানটির সম্পদমূল্যও ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ২০ টাকা ৫৯ পয়সা, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ঋণাত্মক ১৩ টাকা ৪০ পয়সা।
লোকসানে পতিত হওয়া আর্থিক কোম্পানিগুলোর আর্থিক চিত্র
প্রতিষ্ঠানের নাম
শেয়ারপ্রতি মুনাফা (টাকা)
শেয়ারপ্রতি পরিচালন নগদ প্রবাহ (টাকা)
শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য (টাকা)
জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০২১
জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০২০
জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০২১
জানুয়ারি -সেপ্টেম্বর ২০২০
সেপ্টেম্বর- ২০২১
ডিসেম্বর- ২০২০
ফারইস্ট ফাইন্যান্স
(১.৭০)
(৬.০৮)
১.৩০
(.৮)
১.১৫
২.৮৫
মাইডাস ফাইন্যান্স
(৩.১৭)
.৩১
(.৭৬)
(.১৫)
৮.৫৩
১১.৬৯
প্রিমিয়ার লিজিং
(৬.৩৩)
.১১
৩.৩৫
(.৯৪)
৯.৮১
১৯.০৩
ইউনিয়ন ক্যাপিটাল
(২.২৯)
(২.৬৩)
(.৪১)
(১.১৮)
১.১৮
৪.১২
এদিকে মুনাফায় থাকার পরও ইসলামিক ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স, ফিনিক্স ফাইন্যান্সের মুনাফা গত বছরের তুলনায় কমে গেছে। এর মধ্যে ইসলামিক ফাইন্যান্স চলতি বছরের প্রথম নয় মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৮৯ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৯৯ পয়সা। ন্যাশনাল হাউজিংয়ের শেয়ারপ্রতি মুনাফা দুই টাকা ১৩ পয়সা থেকে কমে দুই টাকা ১১ পয়সা হয়েছে। ফিনিক্স ফাইন্যান্সের শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ৭৩ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৭৭ পয়সা।
বেশিরভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমস্যার মধ্যে থাকায় সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছে। এই ছাড়ের ফলে চলতি বছর মাত্র ২৫ শতাংশ পরিশোধ করে নিয়মিত দেখানো ঋণের বিপরীতে পুরো সুদ আয়খাতে নিতে পারবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে বিশেষ সুবিধায় নিয়মিত দেখানো এ ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত ২ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হবে।
এ সংক্রান্ত জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো একক গ্রাহকের কাছ থেকে ২০২১ সালে যে সুদ আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করেছে, তার ২৫ শতাংশ যদি আদায় করতে পারে, তাহলে ওই গ্রাহকের কাছ থেকে সুদ বাবদ পাওয়া অর্থের পুরোটাকে আয় হিসাবে দেখাতে পারবে। বিদ্যমান নিয়মে কোনো গ্রাহকের কাছ থেকে লক্ষ্যের শতভাগ ঋণ আদায় হলেই তখন পুরো সুদ আয় হিসাবে দেখাতে পারে।
বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও কিছু প্রতিষ্ঠান ভালো মুনাফা করেছে। এর মধ্যে মুনাফার দিক থেকে শীর্ষে আছে ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং ফাইন্যান্স। চলতি বছরের নয় মাসে প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে চার টাকা ৫৮ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল তিন টাকা ৮ পয়সা। মুনাফা বাড়লেও কোম্পানিটির সম্পদমূল্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য দাঁড়িয়েছে ৩৯ টাকা ৫৫ পয়সা, যা গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ৪১ টাকা ৭২ পয়সা।
বড় মুনাফা করা আরেক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ফাইন্যান্স চলতি বছরের প্রথম নয় মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে চার টাকা দুই পয়সা। আগের বছরের একই সময়েও কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি চার টাকা দুই পয়সা মুনাফা করে। মুনাফা একই থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির সম্পদমূল্য বেড়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য দাঁড়িয়েছে ৪১ টাকা ৯ পয়সা, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ৩০ টাকা ৬০ পয়সা।
মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হওয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক চিত্র
প্রতিষ্ঠানের নাম
শেয়ারপ্রতি মুনাফা (টাকা)
শেয়ারপ্রতি পরিচালন নগদ প্রবাহ (টাকা)
শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য (টাকা)
জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০২১
জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০২০
জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০২১
জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০২০
সেপ্টেম্বর- ২০২১
সেপ্টেম্বর- ২০২০
বে-লিজিং
২.৭৫
১.০২
(২.৯৫)
২.০৫
২২.৪৮
১৯.৮০
বিডি ফাইন্যান্স
২.০৭
১.০১
৬.২৯
৩.০২
১৮.৩৫
১৬.৮৫ (ডিসেম্বর)
ডিবিএইচ
৪.৫৮
৩.০৮
১৪.২৫
১০.৭৮
৩৯.৫৫
৪১.৭২
জিএসপি ফাইন্যান্স
১.২৭
১.০১
.৭৮
১.৫২
২১.১৮
১৯.৯১ (ডিসেম্বর)
আইপিডিসি
১.৭০
১.৩৫
(৫.৮০)
১১.৩১
১৬.৪৮
১৬.৩৪ (ডিসেম্বর)
লংকাবাংলা
১.৬৭
০.৮৮
২.৮৩
১০.৫৮
১৯.২০
১৮.৭৩ (ডিসেম্বর)
প্রাইম ফাইন্যান্স
০.২৯
০.০৩
১.৪১
০.০৩
১১.১২
১১.৭৬ (ডিসেম্বর)
ইউনাইটেড ফাইন্যান্স
০.৭১
০.৫০
২.০১
(৪.০৩)
১৬.৮২
১৭.১১
আইসিবি ( জুলাই-সেপ্টেম্বর)
০.৭০
০.৩৮
(৮.৮৭)
(৪.৬০)
৫৫.৭৩
৫৪.৯৭ (জুন ২০২১)
যোগাযোগ করা হলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, লিজিং কোম্পানিগুলোর আর্থিক চিত্র খারাপের দিকে যাওয়ার কারণ বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কম। এখনো অনেক শিল্প কোভিড-১৯ এর ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কাজেই তাদের উৎপাদন হচ্ছে না বা উৎপাদন কম হচ্ছে। সুতরাং তারা ঋণ কম নিচ্ছে। তাছাড়া কিছু কিছু লিজিং কোম্পানির বিরুদ্ধে অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে এসেছে, এটাও কিছু কিছু ক্ষেত্রে গ্রাহকের আস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ ছাড়ের সুফল পাওয়া যাবে কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা আসলে কাগজের ব্যাপার। খেলাপি ঋণ থেকে থাকলে সেগুলো আদায় করা মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। সেটা না করায় আমাদের ব্যাংকের অবনতি হচ্ছে, এখন লিজিং কোম্পানিতেও…। আসলে যারা ঋণ খেলাপি তারা হাজার রকম সুবিধা পাচ্ছেন। এটা কাম্য নয়।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ যে ছাড় দিয়েছে, তা বাস্তবতার আলোকে করা হয়েছে বলে মনে করি। কারণ অনেক প্রতিষ্ঠান আছে- তাদের যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে, সেখানে যেতে পারবে না। এ সুযোগটা যদি কাজে লাগানো যায় তাহলে ভালো কথা। পুরোটা না হলেও আংশিকভাবে কাজে লাগানো যাবে বলে আমি আশাবাদী। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হলে তারা তো কিছু করবে না। তারা ২৫ শতংশও দেবে না।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া এ বিশেষ সুবিধা ভবিষ্যতের জন্য কিছুটা ঝুঁকি তৈরি করবে। বর্তমান সমস্যাটা সামনের দিকে নিয়ে যাবে। কোভিডের কারণে ঝুঁকি ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। এটা ধীরে ধীরে প্রশমিত করতে হবে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সহ-সভাপতি এবং আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মনিরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ ছাড়ের ফলে আর্থিক খাতের ওপর মিশ্র প্রভাব পড়তে পারে। ২ শতাংশ অতিরিক্ত প্রভিশন রাখার কারণে মুনাফা কমে যেতে পারে। তবে এ বিষয়ে আমাদের তেমন এনালাইসিস নেই। এনিয়ে বিস্তারিত কিছু বলা যাচ্ছে না।
এমএএস/কেএসআর/এইচএ/জেআইএম