মতামত

‘ফয়সালা হবে রাজপথে’

দেড় দশক ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি এখন একটা জটিল গর্তে পড়েছে। অবশ্য এখন নয়, গর্তে তারা পড়ে আছে অনেকদিন ধরেই। সেই গর্ত থেকে ওঠার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের কৌশলের সাথে পেরে উঠছে না তারা। বিএনপির দৃষ্টিতে সেটি অপকৌশল। কিন্তু কৌশল হোক আর অপকৌশল, সেটা মোকাবিলার কোনো অস্ত্র অবশিষ্ট নেই তাদের হাতে।

Advertisement

২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করলেও ঠেকাতে পারেনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিলেও নিজেদের পতন ঠেকাতে পারেনি। নির্বাচনে অংশ নেওয়া ভালো না বর্জন করা ভালো; সেটাই ঠিক করতে পারছে না দলটি। ২০২৩ বা ২৪ সালে অনুষ্ঠিত হবে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন। বিএনপি সে নির্বাচনে যাবে নাকি যাবে না? এখন পর্যন্ত দলটির যে রাজনৈতিক অবস্থান, তাতে নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষেই মত বেশি। কিন্তু নির্বাচনে না গেলে কি তারা আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে পারবে?

পরবর্তী নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার একটি ড্রেস রিহার্সাল হচ্ছে এখন। নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করছেন রাষ্ট্রপতি। সংলাপকে ‘তামাশা’ অভিহিত করে তাতে না যাওয়ার অবস্থানেই অনড় বিএনপি। কিন্তু সংলাপে অংশ না নেওয়াই কি পরবর্তী নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা? বিএনপির এই সিদ্ধান্তহীনতার উৎস তাদের অতীত অধারাবাহিকতা।

২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় অনেক কিছুই বিএনপির অনুকূলে ছিল। তার আগে আগে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীরা জয় পেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনা এবং কিছু ছাড় দিতে প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু বিএনপি সেই অনুকূল পরিবেশের সুযোগটি নিতে পারেনি। উল্টো নির্বাচন বর্জনের নামে দেশজুড়ে জ্বালাও-পোড়াও আর সহিংসতায় এক ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে নিজেদের জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

Advertisement

পরের বছর নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতেও পেট্রলবোমা সন্ত্রাস চালিয়ে রাজনীতির ইতিহাসেই এক কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টি করে। কিন্তু এতকিছু করেও তারা আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে পারেনি। ২০১৪ সালের রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনা করলে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়ার কোনো কারণই ছিল না। কারণ কোনো কিছুই বদলায়নি। বরং আগের নির্বাচনে সরকারি দল কিছু ছাড় দিতে চাইলেও ২০১৮ সালে আত্মবিশ্বাসী আওয়ামী লীগ নিজেদের অবস্থানে অনড় ছিল।

যাবো না যাবো না করেও শেষ পর্যন্ত ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট করে নির্বাচনে যায় বিএনপি। কিন্তু ফলাফল বিপর্যয় তাদের সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনে। সুযোগ থাকলে বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচটি তাদের স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে চাইবে। এত যে খারাপ নির্বাচন, নিজেদের অস্তিত্ব প্রায় সংকটের মুখে; সেই নির্বাচনের বিরুদ্ধেও মাঠে বা আদালতে কোনো জনমত গড়তে পারেনি বিএনপি।

যাবো না যাবো না করেও শেষ মুহূর্তে সংসদে যোগ দিয়ে সরকারকে একধরনের বৈধতাই দেয় বিএনপি। দলটির যে রাজনৈতিক অধারাবাহিকতা বা সিদ্ধান্তহীনতা তাতে দলটি রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ নেবে না বা আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে না; এমন বলাটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। শেষ মুহূর্তে পাল্টে যেতে পারে সিদ্ধান্ত।

রাজনৈতিক বিবেচনায় আওয়ামী লীগ-বিএনপির অবস্থান দুই মেরুতে। এটা হতেই পারে। কিন্তু ১৫ আগস্ট বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন উদযাপন এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাষ্ট্রযন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রেনেড হামলায় তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা দল দুটির দূরত্বকে অনতিক্রম্য করে তুলেছে। ২০০৮ সালে নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ তাই বিএনপি এবং তাদের জোটসঙ্গী জামায়াতের ওপর দমন-পীড়নের স্টিম রোলার চালিয়ে দেয়।

Advertisement

কখনো সেটা আইনি, কখনো আইনবহির্ভূত; কখনো রাজনৈতিক, কখনো অরাজনৈতিক; কখনো ন্যায়বিচার, কখনো প্রতিহিংসার; কখনো প্রকাশ্য, কখনো গোপন। সবমিলিয়ে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে ধ্বংস করার সব চেষ্টা করে সরকারি দল। কিন্তু বিএনপির কাছে এ দুর্যোগে টিকে থাকার কোনো রাস্তা জানা ছিল না।

তাই তাদের সংকট গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে বাঁচার চেষ্টা করে। বিএনপিও একবার নির্বাচনে গিয়ে একবার না গিয়ে, কখনো জ্বালাও-পোড়াও করে, কখনো সংসদে যোগ দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার চেষ্টা করছে। ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসলেও তারা উৎফুল্ল হয়, র‌্যাবের কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞায়ও তারা খুশি হয়। কিন্তু কিছুতেই নড়াতে পারে না আওয়ামী লীগকে।

বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থানটি পরিষ্কার। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যেতে রাজি নয়। তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। একসময় আওয়ামী লীগ আন্দোলন করে বিএনপি সরকারের কাছ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করেছিল। আবার আওয়ামী লীগই সংবিধান সংশোধন করে বিষয়টি বাদ দিয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন বাংলাদেশের রাজনীতির অতীত কাল। দাবিটি যৌক্তিক না অযৌক্তিক সে বিবেচনায় না গিয়েও বলা যায়, বিএনপি কি সরকারের ওপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার মতো চাপ সৃষ্টি করতে পারবে? যতটা চাপ সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ বিএনপির কাছ থেকে দাবিটি আদায় করেছিল। এখানেই আওয়ামী লীগ আর বিএনপির পার্থক্য। দাবি আদায়ে আওয়ামী লীগ যতটা সফল, বিএনপি ততটা নয়। আওয়ামী লীগ মাঠের আন্দোলনে যেমন পারদর্শী, আন্দোলন দমনেও ততটাই ওস্তাদ। নির্বাচনী কৌশলেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের হাত ধরে ক্যান্টনমেন্টে জন্ম হলেও বিএনপিকে বদলে দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে টানা নয় বছর আপসহীন আন্দোলন করে বিএনপিকে গণতান্ত্রিক দলে পরিণত করেন তিনি। কিন্তু এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যে সাহস নিয়ে মাঠে ছিল বিএনপি, গত দেড় দশকে সেই সাহসের ছিটেফোটাও তাদের মধ্যে দেখা যায়নি।

গত দেড় দশকে আন্দোলন করার মতো অনেক যৌক্তিক ইস্যু পেয়েছে বিএনপি। কিন্তু কোনোটাই মাঠে কাজে লাগাতে পারেনি। যে খালেদা জিয়া বিএনপিকে নতুন জন্ম দিলেন, সেই খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলায় কারাগারে গেলেন; বিএনপি কিছুই করতে পারেনি। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে গত বছর অনেক কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। কিন্তু দাবি আদায় করার মতো চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি বলে খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ারেই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।

গত বছরের শেষ দিন এক অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘ফয়সালা হবে রাজপথে।’ একটি গণতান্ত্রিক দেশে একটি গণতান্ত্রিক দলের মহাসচিব রাজপথে ফয়সালার কথা বলতে পারেনি। যৌক্তিক দাবিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করার অধিকার সবারই আছে। অতীতেও এই বাংলাদেশে রাজপথে অনেক রাজনীতির ফয়সালা হয়েছে। তবে রাজপথে ফয়সালা করতে হলে জনসমর্থন দরকার।

৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে পতন ঘটেছিল আইয়ুব খানের। সে অভ্যুত্থানেই শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জাসদের ‘বিপ্লব’ ব্যর্থ হয়েছিল জনসমর্থনের অভাবে। আবার স্বৈরাচার এরশাদের পতন ঘটেছিল গণআন্দোলনের মুখেই। ‘৯৬ সালে আওয়ামী লীগ আন্দোলন করেই বিএনপির কাছ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করেছিল।

২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখেই ১/১১ সরকার এসেছিল। তাই বিএনপির রাজপথে ফয়সালা করতে চাওয়াটা অন্যায্য নয়। প্রশ্ন হলো, রাজপথে ফয়সালা করার সক্ষমতা বিএনপির আছে কি না। বিএনপির জনসমর্থন নেই, এটা বলা ঠিক হবে না। কিন্তু সেই সমর্থনকে মটিভেট করে রাজপথে নামানোর ব্যাপারে তারা বারবার নিজেদের ব্যর্থতা প্রমাণ করেছে।

রাজপথে ফয়সালা মানে যদি আন্দোলন হয়, আর সেই আন্দোলন যদি পেট্রল সন্ত্রাস হয়; তাহলে যে জনগণকে পাশে পাবে না, সেটা বিএনপিও জানে। আন্দোলনে নেমে তিনটি গাড়ি ভাঙলে তিনশ জনের বিরুদ্ধে মামলা হবে। বিএনপি আবার রাজপথ ছেড়ে ঘরে ঢুকে যাবে, এটাও সরকার জানে। মির্জা ফখরুল ‘রাজপথে ফয়সালা’ করার ঘোষণাটিও দিয়েছেন রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে।

অনেকদিন ধরেই বিএনপি প্রেস ক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটি আর নয়াপল্টনের অফিসে বসে গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন দেখছে। বিএনপি নেতাদের কথা শুনলে মনে হয়, তারা আশা করছেন, কোনো দৈববলে গণঅভ্যুত্থান হয়ে যাবে। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতা তেমন নয়। ‘রাজপথে ফয়সালা’ করতে হলে প্রেস ক্লাবের হলরুম থেকে রাজপথে নামতে হবে, নিজেদের সাংগঠনিক ভিত্তি শক্ত করতে হবে, সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। কিন্তু এই তিন শর্তেই বিএনপি পিছিয়ে।

সরকারের ভয়ে তারা রাস্তায় নামতে পারছে না। সাংগঠনিক পুনর্বিন্যাস করতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে লেজেগোবরে অবস্থা। খুলনায় দলে দলে নেতাকর্মীরা বিএনপি ছাড়ছেন। ঐক্য যখন দরকার, তখন একে একে জোট ছাড়ছে শরিক দলগুলো। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তো ২০১৮ সালের নির্বাচনের সাথে সাথেই বিলীন হয়ে গেছে। তাই রাজপথে ফয়সালাকে সুদূর পরাহতই মনে হচ্ছে।২ জানুয়ারি, ২০২২

লেখক : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস