বিশেষ প্রতিবেদন

সুস্থ আছেন তো?

রাজধানীর আজিমপুর এলাকার বাসিন্দা গৃহবধু নাজমা বেগম এখনও ঘোরের মধ্যেই আছেন। ভূমিকম্প হওয়ার পাঁচ ঘণ্টা পর কিচেনে রান্না চড়াতে গিয়ে তিনি ভূমিকম্প অনুভব করছেন। ‘শো শো শব্দ করে বিল্ডিংটা দুলছে। নৌকার মতো দুলছে বিছানার শয্যা। ঘুম ভেঙ্গে ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে তাকিয়ে দেখেন গ্লাসের পানিতে ঢেউ খেলছে। আলমারির কাঁচের সামগ্রীগুলো ঝনঝন শব্দ তুলে একটির সঙ্গে আরেকটি ধাক্কা খাচ্ছে। ওই সময় বার বার আল্লাহকে ডাকছিলাম আর ভাবছিলাম আজই বুঝি ভবলীলা সাঙ্গ হবে। মনে পড়ছিল শিশু সন্তান দুটির কথা।’  ৬দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সম্পর্কে এভাবেই বলছিলেন গৃহবধু নাজমা বেগম। শুধু নাজমা বেগমই নন, রাজধানীসহ সারাদেশে আজ সোমবার সবার মুখে মুখে অর্থাৎ  টক অব দি টাউন হলো ভূমিকম্প। ভূমিকম্প শুরু হলে আতঙ্কে অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন। স্ত্রীকে রেখে স্বামী, স্বামীকে রেখে স্ত্রী, স্ত্রী সন্তানদের রেখে স্বামী প্রাণভয়ে ঘরবাড়ি থেকে ছুটে বাইরে বেরিয়ে আসেন। ভূমিকম্প থেমে গেলে স্বজনদের খোঁজ খবর নিতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে সবাই একটিই প্রশ্ন করেন, সুস্থ আছেন তো? পুরান ঢাকার খাজে দেওয়ান প্রথম লাইনের বাসিন্দা জামিল প্রতিদিন সকালে সোহরওয়ার্দী উদ্যানে ফুটবল খেলতে আসেন। আজ খেলা শুরুর আগে তিনি মন খারাপ করে বসেছিলেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, আজ ভূমিকম্পের সময় তিনি স্ত্রী ও সন্তানদের রেখে চারতলার ফ্ল্যাট থেকে নীচে নেমে আসেন। প্রাণভয়ে স্বার্থপরের মতো কাজ করায় তিনি মনোকষ্টে ভুগছেন বলে জানান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও ভূমিকম্প আতঙ্কের বিভিন্ন অনুভূতি ব্যক্ত করা হয়।হুমায়ুন কবীর ঢালি নামে একজন লিখেছেন  ‘বিছানাটা কে যেন জোরে কাঁপাচ্ছিল। এতই জোরে যে, ঘুম ভেঙে গেল। পাশের বাসা থেকে চিৎকার- হইচই। বুঝতে দেরি হলো না ভূমিকম্প হচ্ছে। এই ওঠ সবাই। জলদি ওঠ। ছেলেমেয়ে-বউ, প্রতিবেশীসহ সবাই বিল্ডিং থেকে নেমে এলাম নিচে। ভূমিকম্পের সময় বেরিয়ে যেতে হয়। কিন্তু নিচে নেমে দেখি কেচিগেট বন্ধ। এই চাবি কোথায়? চাবি কোথায়? হায়রে চাবি নাই, চাবি নাই। ততক্ষণে চাবি নিয়ে এলো বাড়িওয়ালা। রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম সবাই। মানুষজন নেমে এসেছে। প্রচণ্ড শীতেও পুরুষদের অনেকেই উদ্যোমে শরীরে নেমে এসেছে। মেয়েদের কেউ কেউ ওড়না নিতে ভুলে গেছে, কিংবা সময় পায়নি।রাস্তায় কতক্ষণ পায়চারি। আত্মীয়-পরিজনকে ফোন। নানাজনের নানারকম মন্তব্য। জীবনে এমনভাবে কখনো ঘুম থেকে কেঁপে উঠিনি। আল্লাহ বাঁচিয়েছে। ইত্যাদি ইত্যাদি। মাহবুবুল হক ওসমানি লিখেন গ্রামেও নাকি ভূমিকম্প হয়। মা জানালেন আমাদের কাঠের ঘর দুলেছে, খাট নাকি ভেঙ্গে পড়ে যাবার উপক্রম, আর বাইরে তুফান ওঠার মত শো-শো আওয়াজ! আজ পুরো কম্পন অনুভব করলাম! কেন যে রাত জাগতে গেলাম! এখনও মনে হচ্ছে সব দুলছে! আল্লাহ আমাদের সবাইকে রক্ষা করুন। আমীনদীপন দেওয়ান নামে একজন লিখেছেন, ‘ফজরের আযান আমাদের ঘুম ভাঙ্গাতে না পারলেও ভূমিকম্পে মৃত্যুর ভয়ে ঠিকই জেগে উঠেছিলাম আমরা। মৃত্যুকে ভয় পেলেও নামাজ না পরার জন্য দোজখের আগুনকে ভয় করি না। বেহিসেবি মানুষ.....’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শিক্ষক আলী রিয়াজ লিখেছেন, বাংলাদেশে প্রতিবার ভূমিকম্পের পরে `ভূমিকম্পের প্রস্ততি,` `করনীয়` এই সব বিষয়ে প্রবন্ধ নিবন্ধ আলোচনা প্রকাশিত বা পুনঃপ্রকাশিত হয় ও সেগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠও করি; ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে এই নিয়ে কথাবার্তা হয় বলেও আমাকে বলা হয়েছে। কিন্তু কখনো কি এই হিসেব করা হয়েছে যে গতবারের ঘটনার পরে আলাপ আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা যে সব বিষয় চিহ্নিত করেছিলেন সে ক্ষেত্রে অগ্রগতি কতটুকু? এই বিষয়ে যারা দায়িত্বে আছেন তাদের প্রশংসা বা নিন্দা করার জন্যে নয়, নির্ভেজালভাবে নাগরিকদের নিরাপত্তার বিবেচনা এবং তাগিদ থেকেই এটা বোঝা দরকার পৃথিবীর সবচেয়ে ঘন বসতিপূর্ণ অঞ্চল বলে চিহ্নিত বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রস্ততি কতটা এবং এই লক্ষ্যে কতটা অগ্রগতি হচ্ছে।মাসুদ পারভেজ নামে একজন লিখেছেন ‘ভোরের দৌড় শরীরের জন্য উপকারী। আজ সকালে হয়ে গেল সেই দৌড়েরই জাতীয় প্রতিযোগিতা! আয়োজক ভূমিকম্প ফেডারেশন’। গোলাম মাওলা নামে একজন লিখেন, ‘আজ আর কাউকে ঘুম থেকে ডাকতে হয়নি...পাবলিক নিজ থেকেই...উঠে..পড়েছে...তাও..আবার ফজরের আযানেরও আগে..এই সুযোগে কিছু পাবলিক ফজরের নামাজও পড়েছে..আজ...ব্যাপারটা মন্দ নয়...এমন ছোট্ট ভূমিকম্পতেই পাবলিক ভয়ে...কেউ ছাদে..কেউ বা নিচে...আ.হা.রে পাবলিক.....একবার সূরা যিলজাল পড়ে দেখুন...সামনে আরও.কতো বড় বড় ভূমিকম্প অপেক্ষা করছে...’।এমইউ/জেডএইচ/এমএস

Advertisement