মতামত

নববর্ষে ‘আদর্শিক সংখ্যালঘু’ মুক্ত বাংলাদেশের প্রত্যাশা

ডিসেম্বরের শেষে এসে একটা ফুর্তির আমেজ থাকে চারপাশে। খ্রিস্ট ধর্মাবল্বীদের বড় দিন আর তার কদিন পরেই ইংরেজি নববর্ষ। সাড়া দুনিয়াতেই একটা উৎসব উৎসব ভাব। আমাদের দেশে এর সাথে যোগ হয় শীতের আমেজ, সব মিলিয়ে দারুণ একটা সময়। এ সময়টা এখন আমরা অতিক্রম করছি।

Advertisement

ওমিক্রনে যখন জর্জরিত অর্ধেকেরও বেশি পৃথিবী আর আমরা যারা এখনও নিরাপদে, শংকায় আছি তারাও। তারপরও উৎসবের আমেজ ছুঁয়ে গেছে সবার হৃদয়ে, সবখানে। করোনার বিধিবিধান মেনেই উৎসবের মাতছে মানুষ সবখানে, সব দেশে। সম্প্রীতি বাংলাদেশের সদস্য সচিব হিসেবে আমার বড় দিনের উদযাপনটা ইদানিং একটা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। বলা চলে খ্রিস্টিয় বড়দিনের সাথে আমার রি-কানেকশন হয়েছে।

আমার লেখা-পড়ায় হাতেখড়ি মিস্টার নেলসন বলে এক খ্রিস্টান ভদ্রলোকের প্রতিষ্ঠা করা বনানীতে রোজী এন সেন্টার নামের একটা কিন্ডারগার্টেনে। প্লে গ্রুপ থেকে ক্লাস ফোর অবধি আমি লেখা-পড়া করেছি এখানে। কালের বিবর্তনে বিলুপ্ত হয়েছে রোজী এন সেন্টার। মিস্টার নেলসনের সাথে ৮৬’র পর আমার আর দেখা হয়নি। রোজী এন সেন্টারের সেই একতলা ছোট্ট বাসাটার জায়গায় এখন বিশাল একটা এপার্টমেন্ট, কিন্তু এখনও মুছে যায়নি সেই কবে কোন ছোট্ট বেলায় রোজী এন সেন্টারে মিস্টার নেলসন আর তার পরিবারের সদস্যদের সাথে খ্রিস্টিয় বড়দিন উদযাপনের সেই সব জ্বল জ্বলে স্মৃতি। রি-কানেকশনের কথা বলছিলাম কারণ এত বছর পর এই সম্প্রীতি বাংলাদেশের কল্যাণেই আমার এখন আবার বড়দিনে নিয়মিত ডাক পরে মিরপুর ব্যাপ্টিস্ট চার্চে। ছুটির দিনে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে হাজির হই চার্চে আর খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সাথে তাদের উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করে বাসায় ফিরি কেক কেটে-খেয়ে দুপুরে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয় নি।

চার্চে আর সবার বক্তব্য শুনতে আর বলতে গিয়ে এবার সহসা একটা উপলব্ধি হলো। এই মানুষগুলো ধর্ম হয়তো আমার চেয়ে আলাদা, কিন্তু তাদের ক্রিসমাস ক্যারোলের ভাষা বাংলাই। তারা ক্রিসমাস ক্যারোলের সাথে সুর মিলিয়ে যখন নাচছে-গাইছে, তার সাথে এই কদিন আগে আমার ভাতিজি ডা. আইশার বিবাহোত্তর সংবর্ধনায় উদযাপনে কোন অমিল আমার চোখে পড়ে নি। চার্চের নেতৃবৃন্দ তাদের বক্তব্যে যিশুর কথা যেমন বলছেন, তেমনি বলছেন বাঙালি সংস্কৃতির কথাও। তাদের বক্তব্যে উঠে আসছে যেমন তিনজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তির বেথেলহেম যাত্রার কথা, তেমনি তারা বলছেন শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের কথাও।

Advertisement

এসব যখন শুনছি, তখন অবাক হয়ে ভাবছি এর বিপরীতে একটি স্রোতও কিন্তু আছে। এখনও এদেশে কিছু মানুষ আছে যারা ছুঁতোয়-নাতায় মানুষের সাথে মানুষের ব্যবধান গড়ে দিয়ে বিকৃত আনন্দ পায়। তারা মানুষের ধর্মীয় উৎসবকে কলংকিত করে আর মানুষকে তার ধর্মীয় পরিচয় চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণেই এই ভূখণ্ডে কারো কারো কর্তৃত্ব থাকবে অন্যদের চেয়ে বেশি।

আমরা নানা অনুষ্ঠানে আমাদের লেখায় আর বলায় প্রায়ই লিখি আর বলি ‘সংখ্যালঘু কনসেপ্টটির’ বিরুদ্ধে এবং যৌক্তিকও তাই-ই। স্বাধীন বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে যে চার মূলনীতির উপর ভর করে তার অন্যতম হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতা। ধর্মের ভিত্তিতে কাউকে বড় আর ছোট করে মাপা হবে না, এই মূল মন্ত্রকে ধারণ করেই এই দেশটির চলার শুরু আজ থেকে পঞ্চাশটি বছর আগে। কিন্তু এই পঞ্চাশ বছরে মাথায় এসে, মিরপুরের ব্যাপ্টিস্ট চার্চে বসে আমার সহসাই উপলব্ধি হলো আমাদের অবশ্যই সংখ্যালঘু কনসেপ্টটি ধারণ করতে হবে, নচেৎ মুক্তি নেই।

তবে এই সংখ্যালঘুর সংজ্ঞা দেশের রাজনৈতিক সীমানা পেরুলেই বদলে যাবে না। এই বাংলাদেশে যে হিন্দু সম্প্রদায় আজ সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরু মুসলমানরা, সেই ইকুয়েশন তো নিমিষেই বদলে যায় সীমানা পেরিয়ে ভারতের মাটিতে পা ফেলা মাত্রই। ঠিক যেমন সংখ্যাতত্বের পাল্লাটা ঝুকে পরে বুদ্ধিষ্ট আর ক্রিশ্চিয়ান কমিউনিটির দিকে আমি যখন জাপানে বা ইউকেতে।

কাজেই এই ‘সংখ্যালঘু ভূত’ অসার-অচল। আমাদের চিনতে হবে সেই সব সংখ্যালঘুদের যাদের চেহারা পাল্টায়, কিন্তু চরিত্র পাল্টায় না সীমানার ওপারে কিংবা এপারে। যারা ধর্মের লেবাস পরে ‘আদর্শিকভাবে সংখ্যালঘু’ হয়েও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সংখ্যাগুরু দেশপ্রেমিক মানুষগুলোর উপর সংখ্যালঘুর শাসন আর দর্শন অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দিতে চায়। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে আমরা যখন আরেকটি নতুন বছরে, তখন নতুন বছরে এসব ‘আদর্শিক সংখ্যালঘু’ মুক্ত বাংলাদেশের প্রত্যাশায় সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।

Advertisement

লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

এইচআর/এমএস