বাংলাদেশে প্রতিদিন আনুপাতিক হারে বাড়ছে নারী নির্যাতনের সংখ্যা। পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে রীতিমত আতংকিত হতে হয়। ঘরে বাইরে কোথাও নেই নিরাপত্তা। এ যেন জলে কুমির ডাঙায় বাঘ। দেশের একটি প্রথম সারির দৈনিকে প্রকাশিত এক জরিপ বলছে গত বছরের তুলনায় এ বছরের (২০২১) জানুয়ারি থেকে নভেম্বর—এই ১১ মাসে পারিবারিক নির্যাতন বেড়েছে ১০ শতাংশ। পারিবারিক নির্যাতনকে ঘিরে হত্যা, আত্মহত্যাসহ মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে ৭ শতাংশ। যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১৯৭টি। এর মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে ৪০ জন।
Advertisement
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুসারে, ঢাকায় গত বছরের তুলনায় নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা বেড়েছে ৩ শতাংশের বেশি। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের মামলা ১৩ শতাংশ এবং যৌতুকের কারণে হত্যা মামলা ২০০ শতাংশ বেড়েছে। ধর্ষণের মামলা গত বছরের তুলনায় এই ১১ মাসে ২টি কম। ডিসেম্বর মাসের হিসাব যুক্ত করলে ধর্ষণের মামলাও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অর্থাৎ, পরিসংখ্যান প্রমাণ দিচ্ছে নারী নির্যাতনের সকল ধরনেই এই হার বেড়েছে। ধর্ষণ, গণধর্ষণের সংখ্যাও বেড়েছে কয়েকগুণ। পত্রিকাটি মামলার একটি পরিসংখ্যানও দিয়েছে। সেখানেও দেখা যাচ্ছে ২০২১ সালে মোট মামলা হয়েছে ২১০৫ টি যার মধ্যে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার সংখ্যা ৬৫২, যৌতুকের কারণে নির্যাতন, জখম ৬৩৩ টি ও যৌতুকের কারণে হত্যা হয়েছে ২১ টি। এই সকল সংখ্যা ২০২০ সালের চেয়ে বেশি। বছরের পর বছর নির্যাতনের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে অথচ সেই তুলনায় নির্যাতন বন্ধে উদ্যোগ চোখে পড়েনা তেমনভাবে।
আমরা সবাই জানি, আমাদের সমাজে নারীরা খুব সহজে নিজের উপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের কথা বাইরে বলেনা বা স্বীকার করতে চায়না। তাই এটা ধরে নেয়াই যায় যে পরিমাণ মামলা হয়েছে বাস্তবের ঘটে যাওয়া ঘটনার সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই এর চেয়ে অনেক বেশিই হবে।
Advertisement
বিপরীতে মামলাগুলোর সুরাহার সংখ্যাটা অতি নগণ্য। প্রশ্ন করতেই হয়। কেন? এমনকি সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকেরাও স্বীকার করেন যে নির্যাতনের ঘটনার বিচার তেমন একটা হচ্ছেনা। মামলাগুলো কোর্ট পর্যন্ত উঠতেই চলে যায় একটা লম্বা সময়। উঠলেও ততদিনে প্রমাণ ও তথ্যের অভাবে বিচার পায়না বেশিরভাগ।
আমরা অনেকদিন ধরেই বলে আসছি, নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল করে দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করার কথা। কিন্তু কে শুনে কার কথা? একদিকে বিচারহীনতা, আরেকদিকে নারীর প্রতি অবমাননাকর দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সামাজিক নিষ্ঠুরতাকে উস্কে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
একটি নারী নির্যাতন বা ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেই শুরু হয়ে যায় নারীকে ভিক্টিম বানিয়ে ব্লেইম গেইম। এর কোনটাই নতুন আলাপ নয়। তাও বলতে হয়। বারবার বলার পর যদি কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। দয়াপরবশ হয়েও যদি তারা নারীদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করে থাকেন।
গণপরিবহনে নারী ধর্ষণের মত ঘটনা ইদানিং অহরহ হচ্ছে। কোনটারই এই পর্যন্ত বিচার হতে দেখিনি আমরা। পরিবহনের মালিকদের দায় নেয়ার জায়গাটিও উপেক্ষিত। ২০২১ সালের সালতামামি নিয়ে আলোচনা করলে তাই নারী নির্যাতনের ইস্যুটি আসা উচিত সবার আগে। করোনাকালীন এই ঘটনার ভয়াবহতা বেড়েছে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি। নারী শিক্ষা আমাদের সরকারের একটি অন্যতম এজেন্ডা। কিন্তু এই নারী শিক্ষার সকল অর্জন ভেস্তে যেতে বসেছে বাল্যবিবাহের অভিশাপে।
Advertisement
নারীর মানসিক বিষয়টিও উপেক্ষিত আমাদের দেশে। নির্যাতনের পাশাপাশি যে পরিমাণ মানসিক আতঙ্কে দিন কাটে নারীদের সেই দিকটি যদি জরিপে আনা হয় তাহলে তার পার্সেন্টিজ হবে শতাংশের কাছাকাছি।
এই যে দিনের পর দিন নারীর প্রতি অবমাননাকর ঘটনা ঘটেই চলেছে এ নিয়ে বিকার আছে কি এই দেশের মানুষের? কোথায় আমাদের আইন, পুলিশ, র্যাব বা আইন প্রণেতারা? ইস্যুভিত্তিক আলোচনার বাইরে সামগ্রিকভাবে বিষয়টিকে একটি জাতীয় সমস্যা হিসাবে আলোচনায় আনার কোন উদ্যোগ নেই সরকারের দিক থেকেও। বছরের পর বছর ধরে একই আলোচনা আর ভালো লাগেনা আমাদের। এবার দরকার নিরাময়ের পথে এগুনো।
আমরা চাই, নতুন বছরে সরকার একটি নারীবান্ধব বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় প্রকাশ করবে। গোটা বাংলাদেশের মানসিক জগতে নারীকে কেন্দ্র করে যেসব নেতিবাচক ও নিপীড়নমূলক বিশ্বাস আছে সেগুলোকে উপড়ে ফেলার জন্য কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। নতুন বছরের বাজেটে নারী ইস্যুটি প্রাধান্য পাবে। নারীর ক্ষমাতায়নের নিয়ামক হিসেবে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে নেয়া হবে বিশেষ কর্মসূচি।
লেখক : অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস