প্রবাস

একুশের প্রাপ্তি, নতুন বছরের প্রত্যাশা

 

সেই আদি যুগ থেকেই সমাজে পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে নারীদের অবদানও বিদ্যমান। বিষয়টি নজরুলের বিখ্যাত সেই কবিতার লাইনের মতোই- ‘পৃথিবীতে যা কিছু চির কল্যাণকর/ অর্ধেক করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’

Advertisement

এই ধারাবাহিকতা সর্বদা চলমান থাকে বা থাকবেই। গত দেড়-দুই বছর করোনার থাবায় সবকিছুই প্রায় স্থির হয়ে ছিল। পৃথিবী করোনার ভয়ংকর ধ্বংসলীলার মুখোমুখি হয়েছিল বা এখনো হচ্ছে। যেহেতু করোনাকালীন সবকিছু প্রায় বন্ধ ছিল তাই অনেক সামাজিক কর্মকাণ্ড কিংবা অর্জন থেকে বিশ্ব পরিবার বঞ্চিত হয়েছে। বিশেষ করে এ অবদান কিংবা অর্জন বলা হচ্ছে নারীদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি।

আমরা জানি গত বছর থার্টি ফার্স্ট থেকে শুরু করে যাবতীয় উৎসবগুলো আলোর মুখ দেখেনি করোনার কারণে। অনেক ইভেন্ট কিংবা স্থগিত করা হয়েছিল। পৃথিবী একটু স্বাভাবিক হতেই, আটকে থাকা ইভেন্টগুলো চালু হচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ক্রিকেট দল বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছে। পরিসংখ্যান বলে বাংলাদেশের নারীরা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য অনেক দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে।

জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০-এ উন্নীত করা হয়েছে। বর্তমানে সংরক্ষিত আসন ও নির্বাচিত ২২ জনসহ ৭২ জন নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন। স্থানীয় পর্যায়ে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিও আছেন ১২ হাজার জনের মতো। এছাড়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও শিক্ষামন্ত্রীও নারী। তাই বলা চলে সবক্ষেত্রে বাংলাদেশে নারীর সক্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে।

Advertisement

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে নারী নেতাদের এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বলেছেন, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বে ৭ম অবস্থানে আছে। বর্ধিত সংখ্যক নারী কর্মী বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি জানান, স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রায় ৭০ শতাংশ নারী এবং তারা মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামনের সারিতে রয়েছে। তৈরি পোশাক কর্মীদের ৮০ শতাংশের বেশি নারী এবং অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে নারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে।

ক্ষমতায়নের অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগেও নারীর পদচারণা গত ৫০ বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। নারী সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে দায়িত্ব পালন করে আসছেন অনেক নারীরা। নারীরা বিচারপতি, সচিব, ডেপুটি গভর্নর, রাষ্ট্রদূত, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপারসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। নিজেদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে এই নারীরা তাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

এসব নারীদের এমন অবদান নিসন্দেহে বড় অর্জনও বলা চলে। কেননা নারীরা একটা সময় শুধুমাত্র ভোগপণ্য ছিল। সেটা দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুরু করে উন্নত দেশগুলোতেও ছিল। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যাপারগুলো ক্রমশ কমছে। তাই একে অর্জন বলতেই হয়।

এখানে মুদ্রার অপর পিঠও রয়েছে নারীর প্রতি চরম অবহেলা, সীমাহীন বৈষম্য ও ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র। এটা বলা বাহুল্য, সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রশ্নে এখনো দেশে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সমাজে এখনো নারী পুরুষ মজুরি বৈষম্য চলমান। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাও ক্রমবর্ধমান। এখনো পথে ঘাটে, গণপরিবহনে, অফিসে, গৃহে নারীরা নিরাপত্তাহীন। সমাজে বহুযুগের পুরোনো পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো প্রবল দাপটে রাজত্ব করে চলছে।

Advertisement

যার ফলে পারিবারিক সহিংসতা, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ এবং যৌন হয়রানির মতো ঘটনা বাড়ছে। নারীর স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা না থাকায়, নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে কন্যা-শিশুদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে দুই কিশোরীর বিয়ের ভয়ে পলায়ন করা, আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। কারণ এসব সমাজের বাস্তব চিত্র এখনো। তথাপি বাল্যবিবাহের ফলে নারীর শিক্ষা-জীবন ব্যাহত হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে তার অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে। মাতৃ-মৃত্যু, নবজাতক মৃত্যু, অপুষ্টি ও দারিদ্র্যের একটি কঠিন দুষ্ট চক্র তৈরি হয়েছে।

আর এসবের প্রভাব সরাসরি পড়ছে নারীর ওপর। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২০’ অনুযায়ী, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ নারী সমতার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অবস্থানে রয়েছে। এই জেন্ডার গ্যাপ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৫০তম। এ সূচকে চারটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এগুলো হচ্ছে: (ক) অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ এবং সুযোগ; (খ) শিক্ষাগত অর্জন; (গ) স্বাস্থ্য এবং বেঁচে থাকা; (ঘ) রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন।

বলা চলে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও নারীদের এসব অপ্রাপ্তিগুলো রয়েই গেলো। একটা সর্বজনীন রাষ্ট্রে পরিণত হতে গেলে অবশ্যই এসব বিষয়ের ওপরে আমাদের তীক্ষ্ম নজর দিতে হবে। আমাদের সংবিধানে নারীদের যেমন বৈষম্যহীন সাম্যের কথা বলা হয়েছে তার পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।

এজন্য সামাজিক সংগঠন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের কর্ণধার তথা সরকারকেও জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। আর এসব প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আসছে বছর গুণগত পরিবর্তন হবে বলে আশাবাদী। সময়ের সাথে সাথে আরো সুদৃঢ় নারীর হাত এবং সহজতর হবে পরিবেশ।

লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী

এমআরএম/এমকেআর