সালতামামি

বিদায়ী বছরে যেমন ছিল জ্বালানিখাত

বিদায়ের শেষলগ্নে আলোচিত ২০২১ সাল। কয়েকঘণ্টা পরই স্বাগত জানানো হবে নতুন বছর ২০২২ সালকে। কেমন ছিল বিদায়ী বছর, এখন চলছে তার হিসাব-নিকাশ। এই হিসাব-নিকাশে দেখা যাচ্ছে, জ্বালানিখাতেও সরকারের কিছু আলোচিত পদক্ষেপ-অর্জন রয়েছে।

Advertisement

যেমন দেশে গ্যাসের চাহিদা মেটাতে বছরজুড়ে খোলা বাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করেছে সরকার। দাম বাড়তি থাকলেও ভর্তুকি দিয়েই খোলা বাজার থেকে মেটানো হয় চাহিদা। যদিও দেশে দফায় দফায় বাড়ে এলপিজির (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস) দাম। এছাড়া দুই দশকেরও বেশি সময় পর অগভীর সমুদ্রে গ্যাসের অনুসন্ধান চালানোর কথা জানায় সরকার।

সরকারি সংস্থা পেট্রোবাংলা প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, দেশে বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৭০ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে নিজস্ব সক্ষমতায় বিভিন্ন গ্যাস ফিল্ড থেকে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে ২৩০ কোটি ঘনফুট। অর্থাৎ চাহিদার বিপরীতে দৈনিক ঘাটতি ১৪০ কোটি ঘনফুট। ঘাটতি মেটাতে আমদানি করা গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে আরও ১০০ কোটি ঘনফুট। এরপরেও ঘাটতি থেকে যাচ্ছে ৪০ কোটি ঘনফুট। এই চাহিদা মেটাতে বছরের শুরুতেই খোলা বাজার থেকে এলএনজি সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার কথা জানানো হলেও তারা আগের সিদ্ধান্তেই অটল থাকে।

ঘাটতি মেটাতে আমদানি করা গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে আরও ১০০ কোটি ঘনফুট/ফাইল ছবি

Advertisement

গ্যাসের চাহিদা পূরণে বিদায়ী বছর স্পট মার্কেট থেকে ১৮ কার্গো এলএনজি আমদানি করে সরকার। এতে এ বছর মোট আমদানি করা এলএনজির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ কোটি ৮৫ লাখ ৬৪ হাজার ৫৫৬ এমএমবিটিইউ (প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থারমাল ইউনিট)। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে যায় এলএনজির দাম। বছরের শুরুতে যে এলএনজি ছিল ৯ ডলার, সর্বশেষ গত অক্টোবরে তা ইউনিটপ্রতি ৩৬ ডলারে কেনে সরকার। জ্বালানি বিভাগ সূত্রের দেওয়া তথ্যমতে, ডিসেম্বর পর্যন্ত এলএনজি আমদানিতে সরকারের ভর্তুকি গিয়ে ঠেকে ১১ হাজার কোটি টাকায়।

এ ব্যাপারে জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব (সদ্য-বিদায়ী) আনিছুর রহমান গত ২৬ ডিসেম্বর জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রয়োজনের খাতিরেই বেশি দাম দিয়ে হলেও খোলা বাজার থেকে এলএনজি কিনতে হয়েছে। আমরা যে নিজেদের সক্ষমতার দিকে নজর দিচ্ছি না বিষয়টা এমন না। আমরা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির দিকেও যাবো।’

এর আগে তিনি জাগো নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের যে গ্যাসের চাহিদা আছে, তা আমরা সরবরাহ করতে পারবো। শিল্পের প্রয়োজনে আমরা স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আনতে বাধ্য হয়েছি। শুধু আমরা নই, আপনি সারাবিশ্বের দিকে তাকান। উন্নত বিশ্বও বিপর্যস্ত। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, চীন, আমাদের প্রতিবেশী ভারতের অবস্থাও দেখুন। সেই তুলনায় আমরা অনেক ভালো আছি।’

নিজস্ব সম্ভাবনার দিকেও নজর দিচ্ছে সরকার/ফাইল ছবি

Advertisement

অবশ্য খোলা বাজার থেকে এলএনজি কেনা দেশের জন্য কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা নিয়ে প্রশ্নও ওঠে। যেমন খোলা বাজার থেকে এলএনজি আমদানিকে অনুৎসাহিত করে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ‘এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক মোল্লা আমজাদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের রাজনীতিকরা ও যারা পরিকল্পনা নেন তারা বলে থাকেন, জাপান-কোরিয়া এলএনজি আমদানি করতে পারে আমরা কেন পারবো না। শুধু এই কথা বলেই ২০০০ সালের পর থেকে গত ২০ বছরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করেনি বাংলাদেশ। অন্যদিকে কয়লাও উত্তোলন করেনি। যুক্তরাষ্ট্র কয়লা উত্তোলন করে, চীন উত্তোলন করে। কিন্তু আমরা সেটা থেকে সরে আসছি।’

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তামিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্পট থেকে সাধারণত তখন এলএনজি কেনা হয় যখন মূল চাহিদা পূরণের পরে অতিরিক্ত প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের মূল চাহিদাতেই ঘাটতি রয়েছে। আমি মনে করি, আমাদের স্পট (খোলা বাজার) থেকে বের হয়ে আসা উচিত। আমরা যখন যথেষ্ট পরিমাণ গ্যাস উৎপাদন করতে পারবো বা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে থাকবো তখন ঘাটতি দেখা দিলে আমরা স্পট থেকে কিনতে পারি। কিন্তু এখন আমাদের স্পট থেকে সরে আসা উচিত।’

দফায় দফায় বাড়ে এলপিজির দামবিদায়ী বছরে দফায় দফায় এলপিজি গ্যাসের দাম বাড়ায় বাংলাদেশ এনার্জি অ্যান্ড রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ১২ কেজির সিলিন্ডারের এলজিপিজির দাম ছিল ৮৪২ টাকা। ধাপে ধাপে সেটা ১ হাজার ৩১৩ টাকায় গিয়ে ঠেকে। জুন মাসে দাম ছিল ৮৪২ টাকা, জুলাই মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ৮৯১ টাকা, আগস্ট মাসে ৯৮৬ টাকা, সেপ্টেম্বরে এক হাজার ৩৩ টাকা, অক্টোবরে এক হাজার ২৫৯ টাকা, নভেম্বরে দাম বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৩১৩ টাকায়।

৮৪২ টাকার এলপিজি দফায় দফায় ৪৭১ টাকা বেড়ে হয় ১ হাজার ৩১৩ টাকা/ফাইল ছবি

বছর শেষে নামেমাত্র দাম কমানোর সিদ্ধান্তটানা পাঁচ মাস দাম বাড়ার পর বছর শেষে এলপিজির দাম কমানোর ঘোষণা দেয় বিইআরসি। ডিসেম্বরের ২ তারিখে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করা হয় এক হাজার ২২৮ টাকা। ৮৪২ টাকার এলপিজি দফায় দফায় ৪৭১ টাকা বেড়ে হয় এক হাজার ৩১৩ টাকা। সেখান থেকে ১২ কেজির এলপিজিতে মাত্র ৮৫ টাকা কমানো হয়।

প্রায় দুই যুগ পর অগভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান শুরুপ্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় পর এ বছর নতুন করে প্রাকৃতিক গ্যাসের অনুসন্ধান শুরু করে সরকার। বাংলাদেশের সাগর সীমানায় চিহ্নিত ২৬টি ব্লকের মধ্যে অগভীর সমুদ্রের সম্ভাব্য দুটি ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করা হয়। গত সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে শুরু হওয়া খনন কাজ এরই মধ্যে অনেকটাই শেষ হয়ে গেছে। কতটুকু সম্ভাবনা রয়েছে তা নতুন বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে জানা যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সাগর সীমানায় চিহ্নিত ২৬টি ব্লকের মধ্যে অগভীর সমুদ্রের সম্ভাব্য দুটি ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধান শুরু হয়েছে/ছবি: জাগো নিউজ

এ বিষয়ে গত ২৬ ডিসেম্বর জ্বালানি সচিব আনিছুর রহমান বলেন, ‘আমরা একটা সম্ভাবনার দিকে এগোচ্ছি। আশা করি সফল হলে গ্যাসের দাম অনেকটাই সাশ্রয়ী হবে।’

গত ১৩ নভেম্বর গ্যাস অনুসন্ধানবিষয়ক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় জাগো নিউজে। ওই সময় পেট্রোবাংলার একজন মহাব্যবস্থাপক জাগো নিউজকে জানিয়েছিলেন, ‘কুতুবদিয়া অঞ্চলে ব্লক এসএস-৪ ও এসএস-৯ দুইটা ব্লকে পরপর তিনটা ড্রিল (খনন) করা হবে। প্রথম ড্রিল শুরু হয়েছে গত ৩০ সেপ্টেম্বর। এই ড্রিলিংটা চার হাজার ২০০ মিটার অর্থাৎ মাটির নিচে চার কিলোমিটারেরও বেশি গভীর পর্যন্ত খনন করা হবে। খননের কাজ অনেকটাই হয়ে গেছে।’

খননের অগ্রগতির ব্যাপারে জানতে চাইলে দায়িত্বে থাকা জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব জাগো নিউজকে জানিয়েছিলেন, ‘২০২২ সালের জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারির মধ্যেই একটা সম্ভাবনার খবর আমরা জানতে পারবো। তারপরেই আমাদের মূল কার্যক্রম শুরু হবে।’

ব্যাপক আকারে গ্যাস অনুসন্ধানের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের/ফাইল ছবি

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু অগভীর সমুদ্রে অনুসন্ধান করলেই চলবে না। আমাদের গভীর সমুদ্রের দিকেও অগ্রসর হতে হবে। আর সেই পরিকল্পনা হতে হবে সামগ্রিকভাবে। ছোট ছোট করেও যদি অনুসন্ধান চালানো হয় তা যেন এক জায়গায় থেমে না থাকে। ব্যাপক আকারেই গ্যাস অনুসন্ধানের পরামর্শ দেন তারা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. এজাজ হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেক জায়গাতেই এ রকম ছোট ছোট সম্ভাবনা রয়েছে। এসব জায়গায় খুঁজলে যে কোনো সময় গ্যাসের খনি পাওয়া যেতে পারে।’

ড. এজাজ বলেন, ‘আমার ধারণা অগভীরে অনুসন্ধান করলে গ্যাস মিলতে পারে। কিন্তু তা খুব বেশি হবে না। তাই দুই-তিনটা জায়গায় ড্রিলিং করলেই হবে না। আমরা হঠাৎ করে একটা খনি পাবো আর সেখানে খনন করবো তাতে হবে না। ছোট ছোট হলেও একসঙ্গে যদি ১০ জায়গায় অনুসন্ধান করি তাহলে ১০ জায়গা মিলে বড় এক জায়গার সমান হবে। আমাদের এই মনোভাব নিয়ে পুরো বাংলাদেশে অনেকগুলো খনির সন্ধানে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কিন্তু সেটা তো করা হয় না। আমার যেটা ধারণা, অগভীরে বড় কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। গ্যাসের সন্ধানে গভীর সমুদ্রে যেতে হবে।’

এমআইএস/এআরএ/এএসএম