# কারোনাকালেও অর্থনৈতিক স্থিতি# দলীয় ব্যর্থতায় তৃণমূলে ঝরেছে ৯২ প্রাণ# সমালোচিত ছিল হেলেনা-মুরাদ-জাহাঙ্গীর কাণ্ড
Advertisement
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে শুরু আর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সংঘাত-সহিংসতা দিয়ে বছর শেষ করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিদায়ী বছরে আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দিলেও দল গোছাতে হয়েছে চরম ব্যর্থ। পাশাপাশি উপ-কমিটির সদস্য হেলেনা জাহাঙ্গীর, গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম এবং তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান কাণ্ডে সমালোচনা ছিল তুঙ্গে।
করোনাকালেও অর্থনৈতিকসহ নানা সূচকে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে সরকার। তবে সারাদেশে আওয়ামী লীগের ৭৮ সাংগঠনিক ইউনিটের ৪২টিই মেয়াদোত্তীর্ণ রয়ে গেছে। পাশাপাশি বছরজুড়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তৃণমূলে অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা রূপ নিয়েছে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে। দলের ভিত্তিখ্যাত তূণমূলের ৯২ কর্মী হয়েছেন লাশ। আহতের সংখ্যা প্রায় সাত হাজার।
সরকারের অর্জন ছিল চোখে পড়ার মতোএ বছর সরকারের বড় অর্জন হলো- করোনায় অর্থনৈতিক স্থিতি ধরে রাখা। স্বাস্থ্য সুরক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৮ বছরে উন্নীত হয়েছে। এ পর্যন্ত চালু করা হয়েছে ১৩ হাজার ৮৮১টি কমিউনিটি ক্লিনিক। ২০২২ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা ১৪ হাজার ৮৯০টি। বিশ্বের ১৬০টি দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। হ্রাস পেয়েছে শিশু ও নবজাতক মৃত্যুর হার।
Advertisement
বছরের দ্বিতীয় মাসেই শুরু হয় করোনা প্রতিরোধে টিকাদান। এরপর কিছুটা হোঁচট খেলেও বছর শেষে টিকাদানে সাফল্য চোখে পড়ার মতো অবস্থায় পৌঁছায়।
স্বাবলম্বী, উদ্যমী যুব সমাজ গড়তে ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট ৬৩ লাখ ৯১ হাজার ৭৬৩ জন যুবককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে সরকার। ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় তিন কোটি বেকার যুবকের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ চলছে।
মুজিববর্ষে দেশের ৮ লাখ ৮২ হাজার ৩৩টি গৃহহীন পরিবারকে ঘর দিয়ে সাধারণের প্রশংসা কুড়িয়েছে সরকার। তবে দু-একটি দুর্নীতিতে সমালোচনাও এসেছে ঢের। ছিন্নমূল বস্তিবাসী ও নিম্নবিত্তের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ করেও সাফল্যের ঝুড়ি ভারী করেছে। পাশাপাশি বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও প্রতিবন্ধী ভাতার মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনা হয়েছে দেশের বিপুল সংখ্যক পিছিয়ে পড়া নাগরিককে। এবারই প্রথম এই খাতে এক লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
সরকারের ঝুলিতে সাফল্যের পাশাপাশি সরকারপ্রধানও পেয়েছেন আন্তর্জাতিক দুটি পুরস্কার। এর মধ্যে- একটি উইটসা এমিনেন্ট পারসনস অ্যাওয়ার্ড ২০২১। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে নেতৃত্বদান এবং তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
Advertisement
আরেকটি ‘এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার’। দারিদ্র্য দূরীকরণ, পৃথিবীর সুরক্ষা এবং সবার জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণের সর্বজনীন আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশকে সঠিক পথে অগ্রসরের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ পুরস্কার দিয়েছে জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশনস নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন)।
দল গোছাতে ব্যর্থতার দিক দিয়ে ছিল প্রথমসরকারে যেভাবে সফলতা দেখিয়েছে, ঠিক উল্টোভাবেই দল গোছাতে ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটির ৭৮ সাংগঠনিক জেলা কমিটির ৪২টিই মেয়াদোত্তীর্ণ রয়ে গেছে। এর মধ্যে ২০২১ সালে পাবনা ও নাটোর জেলা সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা হয়েছে। এছাড়া রাজবাড়ীসহ কয়েকটি জেলার সম্মেলন হয়েছে। এদিকে ২০২১ সালে রাজশাহী বিভাগের ২৭ উপজেলার সম্মেলন শেষ করা হয়। ঢাকা বিভাগের কয়েকটি উপজেলারও সম্মেলন সম্পন্ন হয়। এভাবেই ২০২১ সাল কেটেছে আওয়ামী লীগের।
এছাড়া বছরজুড়ে বিভিন্ন ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার নির্বাচনে গৃহবিবাদ বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপিসহ বিভিন্ন দলকে নির্বাচনে দেখা যায়নি। এ কারণে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের নির্বাচনী লড়াইয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও রক্তপাত হয়েছে চোখে পড়ার মতো। সংসদ সদস্য, জেলা-উপজেলা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের নিজস্ব বলয় তৈরির নোংরা প্রতিযোগিতায় প্রাণ দিয়েছেন অন্তত ৯২ জন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৭ হাজার নেতাকর্মী।
হেলেনা জাহাঙ্গীরকে তার বাসা থেকে আটক করে র্যাব
এ বছরের জুনে প্রথম ধাপে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের উপ-নির্বাচন, ২০৪ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ও দুটি পৌরসভার নির্বাচন হয়। এতে সহিংসতায় নিহত হন তিনজন। আহত হয়েছেন শতাধিক।
সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৮ ইউপিতে নির্বাচন হয়। এতে ভোট গ্রহণ করতে গিয়ে সহিংসতায় সারাদেশে নিহত ৭, আহত হয়েছেন শতাধিক। নভেম্বরে ২৮ তারিখে তৃতীয় ধাপের ১ হাজার ১টি ইউনিয়নে নির্বাচন হয়। এতেও সহিংসতায় একজন বিজিবি সদস্যসহ ১০ জন নিহত হন। আহত হন দুই শতাধিক। চতুর্থ ধাপে ৯৪০ ইউপিতে নির্বাচন হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর আর পঞ্চম ধাপে ৭০৭ ইউপির নির্বাচন ৫ জানুয়ারি হবে। ৬ষ্ঠ ধাপে ২১৯টি ইউপির নির্বাচন হবে ২৯ জানুয়ারি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত ইউপি, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৪৬৯টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন ৬ হাজার ৪৮ জন এবং নিহত হয়েছেন ৮৫ জন। নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ৪১ জন, বিএনপির ২ জন, সাধারণ মানুষ ২২ জন, পুলিশের গুলিতে ১৫ জন এবং একজন সাংবাদিক মারা গেছেন। ১১ নভেম্বর নির্বাচনে ৭ জনসহ মোট মারা গেছেন ৯২ জন।
সহিংসতাগুলো বেশিরভাগই ইউপি নির্বাচন ঘিরে সংঘটিত হয়েছে। আর আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগেই সংঘাত হয়েছে বেশি। কারণ মাঠে ছিল না বিএনপি বা অন্য কোনো দল।
সমালোচনার তুঙ্গে ছিল হেলেনা-জাহাঙ্গীর-মুরাদবছরজুড়ে নানা কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বেশ আলোচনার খোরাক জুগিয়েছেন আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য হেলেনা জাহাঙ্গীর, গাজীপুর সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম এবং তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান।
বছরের মাঝখানে ‘আওয়ামী চাকুরিজীবী লীগে’ যোগ দিয়ে ভাইরাল হন হেলেনা জাহাঙ্গীর। সফল এই ব্যবসায়ী গেলো এক দশকে রাজনীতিতে নিজেকে জাহির করতে গিয়েই মূলত হোঁচট খেয়েছেন। প্রথমে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের সঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটিতে নির্বাচন করার আগ্রহ দেখিয়ে পোস্টারিং করে আলোচনায় আসেন। পরে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পদ বাগিয়ে নেন। খালেদা জিয়া ও সরকারের বিভিন্ন এমপি-মন্ত্রীর সঙ্গে তার ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়।
সর্বশেষ ‘আওয়ামী চাকুরিজীবী লীগে’ যোগ দিয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনেন কথাবার্তায় অসংযত এই নারী। সমালোচনার পারদ যখন তুঙ্গে, তখন হঠাৎ করেই তার বাসায় অভিযান চালায় র্যাব। অভিযানে বাসা থেকে বিদেশি মদ, অবৈধ ওয়াকিটকি সেট, ক্যাসিনো সরঞ্জাম, বিদেশি মুদ্রা ও হরিণের চামড়া জব্দ করে তারা। যদিও মদের লাইসেন্স ছিল তার ছেলের। এসব বিষয়ে সামনে এনে তার বিরুদ্ধে পৃথক চারটি মামলা দায়ের করা হয়। বেশ কয়েকদিনের রিমান্ডেও নেওয়া হয় তাকে।
নীরবে দেশ ছাড়লেও আবার ফিরে আসেন ডা. মুরাদ
সেপ্টেম্বরে স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় গাজীপুর সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের অডিও। যেখানে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে গাজীপুরে সড়ক অবরোধ করে জাহাঙ্গীর আলমের বিচার চেয়ে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করে আওয়ামী লীগের একাংশ। আওয়ামী লীগ থেকে তাকে শোকজ করে। সন্তোষজনক জবাব না পাওয়ায় বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। সিটি মেয়র পদ থেকেও তাকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
আর বছরের শেষে এসে সমালোচনার তুঙ্গে ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। ১ ডিসেম্বর রাতে ফেসবুক লাইভে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার কন্যা জাইমা রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করেন। এ ঘটনায় বিএনপি তার পদত্যাগ দাবি করে। পরে ৬ ডিসেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুরাদ হাসানের সঙ্গে চিত্রনায়ক মামনুন হাসান ইমন ও নায়িকা মাহিয়া মাহির একটি ফোনালাপ ভাইরাল হয়। যেখানে তিনি মাহিয়া মাহির সঙ্গে অশ্লীল কথা বলেন।
ওই কথোপকথনে তথ্য প্রতিমন্ত্রী মাহিকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সহায়তায় তুলে আনার হুমকি দেন। পুরো বক্তব্যে ‘অশ্রাব্য’ কিছু শব্দ উচ্চারিত হয়। বিষয়টি দেশজুড়ে সমালোচনার জন্ম দেয়। পরে তাকে প্রতিমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বলেন প্রধানমন্ত্রী।
৭ ডিসেম্বর ই-মেইলের মাধ্যমে তিনি পদত্যাগপত্র পাঠান। তবে পদত্যাগের জন্য তিনি ‘ব্যক্তিগত কারণের’ কথা উল্লেখ করেন। তাকে প্রতিমন্ত্রী ও জামালপুর জেলার আওয়ামী লীগের কমিটির পদ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়।
পদত্যাগের পর তিনি দেশ ছেড়ে কানাডায় চলে যান। তবে ঢুকতে পারেননি। কানাডায় প্রবেশ করতে না পেরে দুবাই হয়ে ফের ১২ ডিসেম্বর ফেরেন বাংলাদেশে।
এসইউজে/এমএইচআর/এএ/জিকেএস